চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলে বলতাম, বুয়েটের রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছি, সামনেই পলাশীর মোড়। ব্রিটিশ কাঠামোর কলোনি ধাঁচের লাল লাল বাড়ি, গাছ-পাতায় ভর্তি ছায়া জমানো পথ। টুকটাক মনোহারির দোকান ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। গেরুয়া রঙের পুরনো দেয়ালের গা ঘেঁষে এমন এক চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছি, যত দূর চোখ যায়, ঝিম ধরা রোদ ছাড়া কিছু নেই। সমান বিরতিতে যে পাখি ধারেকাছে ডাকছে তার নাম জানি না। শুধু ওই ব্যবধানের ফাঁক গলে বারবার ছুটে আসা বাতাসটা মানুষের দীর্ঘশ্বাসের মতো। যেখানে এসেছি সেখানে অবশ্য দীর্ঘশ্বাসই শোনার কথা। এতক্ষণের
মুখরা সহযাত্রীও দেখলাম বিরস বদনে একবার গাছের পাতা খুটছে, বার্মিজ ভাষা পড়ার মতো অসম্ভব এক চেষ্টায় ব্যস্ত করে রেখেছে নিজেকে। আরো দুজন এসেছেন আমাদের সাথে। সকাল থেকে তারা ধূমপান করতে পারেননি বলে সময় নিয়েছেন। ফিরলে একসাথে যাব। এখানে কোনো গেটপাস লাগে না এবং যে কেউই আসতে পারে। শুধু উচ্চস্বরে শব্দ করা যাবে না। অবশ্য পরিবেশটা এমন, মানুষ আপনাতেই শান্ত হয়ে যায়।
মুখরা সহযাত্রীও দেখলাম বিরস বদনে একবার গাছের পাতা খুটছে, বার্মিজ ভাষা পড়ার মতো অসম্ভব এক চেষ্টায় ব্যস্ত করে রেখেছে নিজেকে। আরো দুজন এসেছেন আমাদের সাথে। সকাল থেকে তারা ধূমপান করতে পারেননি বলে সময় নিয়েছেন। ফিরলে একসাথে যাব। এখানে কোনো গেটপাস লাগে না এবং যে কেউই আসতে পারে। শুধু উচ্চস্বরে শব্দ করা যাবে না। অবশ্য পরিবেশটা এমন, মানুষ আপনাতেই শান্ত হয়ে যায়।
সুফিই বলব তাকে, স্থানীয় মানুষ অমন করেই চেনে। এখানে শুয়ে আছেন সুফি আবুল মুজাফফর সিরাজুদ্দীন বাহাদুর শাহ গাজি। অন্য পরিচয়, শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর যিনি মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দীন মুহাম্মদ বাবরের ২০তম বংশধর।
এসেছি ইয়াঙ্গুনের উইসারা রোডের জিওকা স্ট্রিটে। বিখ্যাত সেই স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত শ্যোডেগং প্যাগোডার দক্ষিণে মাইল তিনেক দূরত্ব। এই ‘উইসারা’ রোডের নামকরণের পেছনে আরো একটা করুণ ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নাম ছিল ‘থিয়েটার রোড’। সে সময় ‘উইসারা’ নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করায় তাকে কারান্তরীণ করা হয়। সেই উইসারা ১৬৬ দিন অনশনের পর মারা যান। তাঁকে সম্মান জানাতেই পরবর্তীতে বার্মিজরা এ সড়কের নামকরণ করে। উইসারার মতো মানুষের ছায়া তার অবয়বের চেয়ে প্রশস্ত, দীর্ঘ হয়। শারীরিকভাবে ফুরিয়ে যাবার পরও শত শত যুগ ধরে ভাষান্তর হতে থাকে সেই মানুষের ভাবনা। উইসারা রোডে যে শুয়ে আছেন তিনি আরো একজন তেমনই, যার ছায়া তার অবয়বের চেয়ে ছিল কালোত্তীর্ণ। যিনি পরাজিত হয়েও বিজয়ী, যার জয়-পরাজয়ের পদকারেণু নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অন্তর্গত গূঢ় অনুভূতির অনুভব হূত্কমলে জয়ী হয়ে আছে নিশ্চিত। তাঁর তরবারি ছলকে না উঠলেও আধ্যাত্মিকতার জ্ঞানচর্চা, সাহিত্যানুরাগ শত বছর পরও দ্যুতি ছড়ায়। শাহ জাফর অন্তর্গত রহস্য খুঁজে ফেরা মানুষ। সবাই সাদা চোখে যা দেখত তিনি সেখানেই দেখতেন রঙের ব্যঞ্জনা। সুফিরা তাই করেন, সৃষ্টির ভেতর স্রষ্টাকে খোঁজেন, তবে সেই ‘সৃষ্টি’ শুরু হয় নিজের কলব বা আত্মা থেকে। জাফরও প্রায়ই নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাতেন তেমন করে। নিজেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জাফর এই রহস্যের ভেদ কি/ আসছে না আমার বুঝে, যে আছে ভেতরে/ সবাই মরছে তাকে বাইরে খুঁজে খুঁজে।’
আপাতদৃষ্টিতে ইতিহাস বলছে, ক্ষমতার দিক থেকে তিনি পরাজিত, দুর্বল আর হেরে যাওয়ার দলে, আসলেই কি বাহাদুর শাহ জাফর তাই! জাফর আসলে আবুল হাসানের কবিতার মতো হিরণদাহ, বিজন ব্যথা। যিনি সংসারী না হয়ে সন্ন্যাসী হওয়ার মতো তীব্র অভিমান পুষে রাখতেন।
ভারতীয় কেতার গেরুয়া সমাধি ভবনটির সামনে শানবাঁধানো উঠোন। প্রবেশের মুখে হাতের ডান দিকে অভ্যর্থনা কক্ষ। শুক্রবার জুমআর নামাজের আগে-পরে ঘরটির তালা খোলা হয়। বাঁয়ে খোলা ঘরের উপরে ছাউনি, মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা। মাহফিল বা আসর হলে রাতে আগরবাতি জ্বালিয়ে সুফি গান, জিকিরের ধ্বনি ওঠে। এখানে দেওয়ান-ই-আমের লাবণ্য, রাজপুতানার পাহাড়ের চূড়ার রূপকথার সব দুর্গ, অন্দরমহলে জাফরি কাটা আলো-ছায়ার নকঁশা বা কল্কি আঁকা দেয়ালের ভেতর শ্বেতপাথরের ম্লান ঘরের মতো কিছুই নেই। ললিত ভৈরবের মতো কোনো সুরও ভেসে বেড়ায় না বাতাসে। জৌলুস নেই গজল, শের-শায়েরির মজলিসের, তবু কিছু একটা আছে যা সেই সব শ্রুতিকেই স্মরণ করায়।
দরগায় একটা দানবাক্স দেখলাম। তদারকির জন্য মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেয়া হয় না। বাঁ দিকে এগিয়ে দীর্ঘ প্রশস্ত ধবল শীতল মেঝে পড়ে আছে গা ছেড়ে দিয়ে। অন্তত শ দুই মানুষ একসাথে বসতে পারে চাইলে। ৯টি ধাপের সিঁড়ি পেরিয়ে মূল ভবনে উঠতেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ মনে হলো সারা শরীরে জড়িয়ে ধরল। ভবনের বাঁ দিকের ঘরটা থেকে আসছে ঘ্রাণ। একপাশে মিম্বর দেখে বোঝা যায় নামাজ পড়া হয়। নারী-পুরুষের প্রার্থনার ভিন্ন ভিন্ন স্থান রয়েছে। সেখানে একটা বড় স্টিলের থালায় মিষ্টান্ন আর ফুল সাজানোর ধরন দেখে বিস্মিত হয়েছি। একজন মুসলিম বাদশাহর সমাধি, সুফির দরগায় অনেকটা পূজার নৈবেদ্যের মতো আয়োজন। একটা গুনগুন শব্দ আসছে বড় ঘরটার ভেতর থেকে। এগিয়ে গেলাম। দরজার ওপরে লাল প্লাস্টিকের নেম প্লেটে সাদা অক্ষরে লেখা ‘রেড ফোর্ট’। দিল্লির লাল দরগার মতো এখানে কখনো ফরমান জারি হয়নি, হুকুমনামা পেশ হয়নি, এমনকি নতুন রাজ্য দখলের পরিকল্পনা বা বিজয়ের উত্সব কিছুই ঘটেনি কোনো দিন, তবু এর নাম রেড ফোর্ট। দ্বিতীয় আকবর শাহ আর সম্রাজ্ঞী লাল বাঈয়ের দ্বিতীয় পুত্র বাহাদুর শাহ জাফরকে তাঁর শৌর্যবীর্যের কথা বলে স্মরণ করে না কেউ এখানে। আতরের নির্যাস নিয়ে রঙমহলে জেগে ওঠেনি কোনো তরুণী বেগম। এ লাল কেল্লার ইতিহাস শুধুই বিয়োগান্তক। তাই ‘লাল কেল্লা’ লেখাটা কেমন করুণ প্রহসনের মতো দেখাল দরজার ওপর। বাহাদুর শাহ জাফর শেষ সময়ে শুধু নিজের মাটিতে মৃত্যুর অনুমতি চেয়েছিলেন, তাও পাননি বলে যেখানে তার সমাধি হয়েছে সে জায়গাকেই লাল দুর্গ নামে ডাকছে ভক্তরা। বাদশাহ নির্বাসনের সময় দিল্লির দুমুঠো মাটি নিয়ে এসেছিলেন সাথে। কয়েক বছরের নির্বাসনের জীবনে সেই মাটি যত্ন করে তুলে রাখতেন নিজের কাছে। মৃত্যুর পর শরীরের ওপর সেই মাটি ছড়িয়ে দিয়ে বাকিটুকু আবৃত করা হয়েছিল রেঙ্গুনের মাটি দিয়ে। যে শব্দ শুনে এগিয়ে এসেছিলাম তা এই ঘরের ভেতর থেকে আসছে। মিলাদ পড়া হচ্ছে দাঁড়িয়ে। তবে এর কিয়ামের ভাষা ঠিক আমাদের অঞ্চলে প্রচলিত রকমের নয়। মোগল বাদশাহদের দরবারে যেমন মুশায়েরার আসর বসত, অনেকটা সে রকম। নবীর নাম থেকে শুরু করে এই কিয়ামের মধ্যে সুফি জালালুদ্দিন রুমির নামও ডাকা হচ্ছে, শেষ হচ্ছে এসে হযরত সিরাজুদ্দিন বাহাদুর শাহ জাফরের নামে এসে। যারা প্রার্থনা করছেন তাঁরা কেউ মোগল বাদশাহর খোঁজ রাখেন না। তাঁরা এসেছেন একজন সুফি সাধকের জন্য প্রার্থনা করতে। এখানকার মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, জাফর পুণ্যাত্মার। তাই তাঁর দরগায় এসে কিছু চাইলে পাওয়া যাবে। করুণ কান্নার মতো একটা সুর তাদের এই কিয়াম থেকেই উত্সারিত হচ্ছে। নিজের অজান্তে আমিও কখন সেই সুরের সাথে বলতে শুরু করেছি...ইয়া রুমি, মুলক-ই-বাদশা, ইয়া জালাল বাদশাহ সুবহানি...। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচ-ছয়জন পুরুষ মিলাদ পড়ছেন। তাদের মাঝখানে মেঝেতে রাখা থালায় লাড্ডুর মতো হলদে রঙের মিষ্টি, গাদা ফুল। ওড়নার প্রচলন নেই এ অঞ্চলে। মহিলারাও ব্লাউজের সাথে কাপড় পেঁচিয়ে লুঙ্গির মতো করে পরে। ঘরের এক কোনায় দাঁড়ানো বৃদ্ধা মাথায় রুমাল দিয়ে সেই সুরের সাথে সাথে আওড়ে যাচ্ছেন। এখানে শুক্রবার জুমআর সময় সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। সেদিন দুপুরে সবাইকে শিন্নি খাওয়ানো হয় দরগার পক্ষ থেকে। আমরা এসেছি শনিবার বিকেলে, মানুষ কম, তাই নীরবতা বেশি।
ছবি তুলব কি না দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। প্রথমত কবরস্থান, তার ওপর আবার ইয়াঙ্গুনের মতো জায়গা। এ অঞ্চলের মানুষগুলো বেশি সংবেদনশীল। সেই বৃদ্ধার কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ছবি তোলা যাবে? ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে তিনি বাংলা বা ইংরেজি না বুঝলেও হিন্দি বুঝেছেন। তিনি জানালেন, শব্দ না করে ছবি তুলো, কিন্তু প্রার্থনায় বিঘ্ন ঘটিয়ো না। ছবি তোলার পর তিনিই আমাকে সবুজ গিলাফে ঢাকা পাশাপাশি তিনটি কবরের বর্ণনা দিলেন। প্রথমটি জিনাত মহলের, এরপর বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্র মির্জা জওয়ান বখত ও অন্যটি প্রিন্সেস রওনাক জাহানের। এত তাজা বেলি ফুল কোথা থেকে এল কে জানে। রীতিমতো বিয়ের আয়োজনের সমান ফুল। তিনটি কবরের গিলাফ প্রায় ঢেকে আছে ফুলে। গোলাপ জল ছিটানো হয়েছে ঘরে। এ ঘ্রাণই মৌতাত করে রেখেছে পুরো ভবনে। কাঠের দেয়ালে একটি ছবি দেখে কেমন মনে হলো, মোগল দরবারেই দাঁড়িয়ে আছি। বেগুনি মখমলের কাপড়ে সোনার সুতোর হাতে কাজ। সেই সোনালি সুতোয় ফার্সিতে লেখা বাহাদুর শাহ জাফরের সাথে জিনাত মহলের কাবিননামা। পাশে আরো কয়েকটি সাদা-কালো ছবি। একটিতে দেখা যাচ্ছে, বাহাদুর শাহ তাঁর শিষ্যদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিচ্ছেন, আরেকটি তাঁকে কোর্টে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, অন্য ছবিতে তাঁর দুই পুত্র ও এক ইংরেজ অফিসার দাঁড়িয়ে। বাহাদুর শাহ মাঝখানে বসে আছেন চেয়ারে। জিনাত মহলের তরুণী বয়সের ছবিটা সম্ভবত তাঁকে নিয়ে আঁকা প্রথম ছবি। জিনাত মহলের আরো একটি ছবি আছে শেষ বয়সের, এটা ফটোগ্রাফ। মুখে অসংখ্য বলিরেখা জানান দিচ্ছে, ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই ছিলেন তিনি। এই ছবিতে জিনাত মহলের হাতে কাচের চুড়ি, ঘোমটার আবরণ সরে কপালের চুলে দীর্ঘ জীবনের ছাপ। পেছনে একটা কুশন দেখা যাচ্ছে। স্থির চোখের ভাষা পড়া যায় না, শীর্ণ হাতের বাহু, একপাশে পানের বাটার সরঞ্জাম। এটাই তাঁর শেষ ছবি।
জিনাত মহল দীর্ঘদিন রোগেশোকে একাকিত্বে ভুগে মারা গিয়েছিলেন ১৮৮৬ সালে। শেষ দিকে একাকিত্ব কাটাতে আফিমে আসক্ত হয়েছেন। জিনাত মহলকে নিয়ে নির্বাসনের সময়ের একটি গল্প আছে। ব্রিটিশরা যখন বাহাদুর শাহ জাফরকে দিল্লিতে কারাগারের মতো এক কুঠুরিতে আটকে রেখেছে তখন বিচারের নামে প্রহসন চলছে। ইংরেজরা তাঁকে সম্রাট বলেই মানত না, তাই ভারত নিয়ে ব্রিটেনে তখন যেসব দিস্তা দিস্তা প্রতিবেদন পাঠানো হতো তার মধ্যে কখনো বড়জোড় একটি প্যারা, কখনো একটি বাক্যে শেষ করা হতো শাহ জাফর প্রসঙ্গ। সে সময়ের কথা খুব ভালো বর্ণনা করেছেন উইলিয়াম ড্যামরিম্পেল। তাঁর ‘দ্য লাস্ট মোগল’ শাহ জাফরকে নিয়ে তৈরি সবচেয়ে নিখুঁত ইতিহাস দলিল।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পরপর ব্রিটিশ নারী-শিশু হত্যাকাণ্ডে মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় বাদশাহর বিরুদ্ধে। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে হুমায়ূনের কবরে আত্মগোপন করেছিলেন পরিবার নিয়ে। সেখান থেকে ধরে আনা হয় শাহ জাফরকে। শেষ বিচার চলাকালে সবাই জানত হয় তাঁর মৃত্যুদণ্ড অথবা নির্বাসনে পাঠানো হবে। যে কুঠুরিতে আটক ছিলেন সেখানে ইংরেজ নারী-পুরুষরা দিনরাত লাইন ধরে তাঁদের দেখতে আসত। আর প্রতিবার তাদের সালাম জানাতেন মোগল বাদশা স্বয়ং। শাহজাদাদের রীতিমতো প্রতিবারই উঠে দাঁড়িয়ে বলতে হতো, আপনাদের দেখে আমরা আনন্দিত, তশরিফ রাখুন। কয়েকশ বছর ধরে ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে বেড়ানো মোগল বাদশা ও শাহজাদাদের এহেন পরিস্থিতি নিজেরা বহুদূর এ অঞ্চলের শত্রুদের কল্পনাতেও স্থান পায়নি। এমনি নজরদারির জীবনযাপন করার সময় জিনাত মহল একদিন রাগেক্ষোভে ফেটে পড়ে বাদশাহর কাছে গিয়ে বললেন, যে জীবন যাপন করছি এর চেয়ে দিল্লির ভিখিরিও ভালোভাবে বেঁচে আছে। যে পাত্রে খেতে দেয়, রাস্তার পাশের ফকিরও তার চেয়ে ভালো পাত্রে খায়। এই কথা শুনে বাদশা তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, জিনাত মহল, ইংরেজদের কাছে গিয়ে মাফ চাইলে তারা এখুনি তোমাকে পেনশন বাড়িয়ে দিবে আর আয়েশি জীবনও পাবে, কিন্তু তাতে কোনো দিন আমার ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তি আসবে না। যদি এই সংকটকালে আয়েশি জীবন চাও, তোমাকে আমি মুক্তি দিতে পারি শুধু। কিন্তু আমার কাছে কিছু চেও না, আমাকে বরং দিল্লি নিয়ে ভাবতে দাও। এমনকি পরিধানের কাপড়ের চেয়ে আমি আমার মানুষের হতাশা নিয়ে ভাবলেও বেশি স্বস্তি বোধ করব। বাদশার কথা শুনে জিনাত মহল ‘গুস্তাকি মাফ কি জিয়ে সুবহানি’ বলে বলেছিলেন, আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আপনার পাশে থাকব। সুন্দরী এই নারী চাইলে শেষ মুহূর্তে অন্য জীবন হয়তো নিতে পারতেন কিন্তু তাঁকে নিয়ে রাজনৈতিক যত বিতর্কই থাকুক, শেষ পর্যন্ত তিনিই বাদশার সাথে ছিলেন (জিনাত মহল ইংরেজদের সাথে আঁতাত করছেন, সিপাহিদের এমন সন্দেহ ছিল)।
জিনাত মহলের ছবিটি দেখলে যৌবনে তাঁর রূপ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বাদশাহর সাথে তার বয়সের ব্যবধানও কম ছিল না।
এই ঘরের আরেকটি ছবি বাহাদুর শাহর দুই ছেলে মির্জা জওয়ান বখত ও মির্জা শাহ আব্বাসের। টুপি মাথায় বাদশাহর দুই সন্তান পাশাপাশি চেয়ারে বসা। খুব কিশোর মুখ, সাদা-কালো ছবিতেও বোঝা যাচ্ছে সহোদরদের চোখের মণি ধূসর। প্রায় কাছাকাছি বয়সের এই দুই ভাইয়ের একজনের কবর এই সমাধি কমপ্লেক্সে। এই মির্জা জওয়ান বখতের বংশধরেরা এখনো কলকাতা শহরে বেঁচে আছেন এমন একটা খবর নব্বইয়ের দশকে পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, তারপর আবার সেই যা তাই। হারিয়ে গিয়েছে। তবে মোগল বংশের শেষ বংশধরদের খোঁজ বের করেছিলেন আনন্দ বাজার পত্রিকার অগ্নি রায়। তিনি লিখেছেন, ‘যে কবার পুরুষশক্তির অগ্ন্যুত্পাত ঘটেছে পৃথিবীতে তার মধ্যে অন্যতম বিস্ময়কর দুই ব্যক্তির রক্ত বইছে যাদের উপেক্ষাহত ধমনীতে। মোঙ্গল চেঙ্গিস খান এবং তুর্কী বীরশ্রেষ্ঠ তৈমুর লঙের রক্ত। তবে, বাস্তব হল ৩৩২ বছর ধরে একের পর এক দোর্দণ্ড প্রতাপ সম্রাটের জন্ম দেওয়া ওই পরম্পরার চিহ্নিত শেষতম সলতেটি অধুনা বড় অবহেলায় জ্বলছে হায়দারাবাদের এক মলিন পাড়ায়। নিভু নিভু করেই।’
দুই শাহাজাদার পাশে একটা ক্যালিগ্রাফি বাঁধাই করা। বাহাদুর শাহের হাতের লেখা। এত নিখুঁত আর সমান মাপের অক্ষর যে দেখেই বোঝা যায় লেখাটা তাঁর কাছে এক শিল্পের চর্চাই ছিল। দেয়ালের ছবির সারির সবশেষটি বাহাদুর শাহের মৃত্যুর কদিন আগে তোলা। এটাই তার জীবনের শেষ ছবি। ইজিচেয়ারে সফেদ সাধারণ পাঞ্জাবি গায়ে আধশোয়া হয়ে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। শরীরের সবকিছু হাড়ের সাথে যেমন মিশে আছে তেমনি শেষ মোগল সম্রাটের দৃষ্টিতে মিশে গিয়েছে যাপিত জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা নিঃশেষ হওয়ার বেদনা। তার অন্য ছবির সাথে এ ছবিটি মেলানো কঠিন।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ছবি দেখে কি বলতেন কে জানে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি হয়তো সহ্যই করতে পারতেন না। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের কিছুদিন আগে তিনি একবার দিল্লি গিয়েছিলেন। বোটে চড়ে শহরের কাছাকাছি যাওয়ার পর প্রথম তাঁর চোখে পড়েছিল অদ্ভুত এক দৃশ্য। পরে আত্মজীবনীতে লিখেছেনও তিনি। দৃশ্যটি এ রকম, একটি মাঠে প্রচুর জনতা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কাছেই ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন দিল্লির বাদশা। দিল্লিতে তখন গালিব, জাউক, দাগের মতো প্রবাদপ্রতিম উর্দু কবিদের নিয়ে আসর বসত দরবারে। বিদগ্ধজনেরা বাদশাহ জাফরের গজল ও কবিতা সংগ্রহ করে নাম দিয়েছেন ‘খুল্লিয়াত-ই-জাফর’। পৃথিবীর অনেক ভাষাতেই অনুবাদ হয়েছে এই সংকলন। সেদিন শুধু বাদশার ঘুড়ি ওড়ানোর নবাবিয়ানা নয়, তার কাব্যপ্রেমেও পড়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। জাফর নিজের পরিবর্তিত জীবন নিয়ে অন্যের কাছে আক্ষেপ করেননি, শব্দ দিয়ে গেঁথেছেন সেই যন্ত্রণা। শাহ জাফরের একটি কবিতাকে গজলে রূপ দিয়ে মেহেদি হাসান অনেকবার গেয়েছেন, ‘বাত কারনে মুঝে মুশকিল কাভি অ্যায়সে তো না থি....’ কথা বলা আমার জন্য কঠিন কিছু তো ছিল না কখনো, তোমার আসরটা এখন যেমন এমন তো ছিল না কখনো, কে আজ সবকিছু কেড়ে নিয়ে গেল। জীবনের প্রায় শেষ সময়ে লেখা এই কবিতায় বাদশা নিজেই নিজের আক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছেন। সেই ঘুড়ি ওড়ানো, গজলের মাহফিল বসানো, মুখে মুখে শের আওড়ে যাওয়া বাদশা করুণ পরিণতিতে জীবনের প্রায় শেষ সময়ে এসে পেছনের দিকে ফিরে তাঁকিয়েছেন, অবাক হয়ে দেখেছেন কেউ একজন কেড়ে নিয়ে গেছে তার সমস্ত অর্জন, এমনকি তাঁর নিজস্ব শব্দও।
আসলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮০৩ সালের পর থেকে মোগল বাদশাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করতে করতে প্রায় বামনের পর্যায়ে নিয়ে আসায় যন্ত্রণা ভুলে থাকতে বাহাদুর শাহ আশ্রয় নিয়েছিলেন গজল, শায়রি আর মুশায়রার। সেই মানুষই লেখার জন্য একটি কাগজও পাননি শেষ কয়েক বছরে। দেশ জয়ের পরও ব্রিটিশদের বাড়াবাড়ি সতর্কতা ছিল যাতে কোনো তথ্য ওই অন্ধ কুঠুরি থেকে না প্রকাশ পায়। এক ধরনের কয়লা দেওয়া হতো দাঁত মাজার জন্য। সম্রাট তাই দিয়ে দেয়ালে কিছু কিছু যদিওবা লিখতেন, সাথে সাথে তা আবার সেনারা এসে সাদা রং করে মুছে ফেলত। শেষ দিকে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে নিজের শরীরটাও নাড়াতে পারতেন না বাদশাহ শাহ জাফর। এই সাদা-কালো ছবিটা সেই সময়ে তোলা। কী নির্মল আর নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। হয়তো কিছুই দেখছেন না অথবা একদৃষ্টিতে দেখছেন সবকিছু। এমন সময় লিখেছিলেন, ‘আমি সেই বসন্তের স্মৃতি / যার বিধ্বস্ত অবয়ব শীতের কবলে/ বাগানের অবস্থা কখনো নির্দয় হয় / কবেকার গোলাপ এখন কেবলই কণ্টক শুধু।’
ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। বাহাদুর শাহ জাফরের এই দৃষ্টিতে আছেন সম্রাট শাহজাহানের বড় ছেলে শাহজাদা দারাশুকো। শাহ জাফরের জন্মের দেড়শ বছর আগে তিনি জন্মেছিলেন মোগল বংশে। তিনিও এমনই ছিলেন যাঁর কাছে সিংহাসনের চেয়ে অধিক প্রিয় ছিল কবিতা ও মানুষ নিয়ে ভাবা। অন্তত শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শাহজাদা দারাশুকো’ বইতে তেমনই বর্ণনা পাওয়া যায়। বাবরের স্বভাবকবিত্ব আর আকবরের সাহিত্যপ্রেম নিয়ে মোগল বংশে দুজনই এসেছিলেন, দারাশুকো আর বাহাদুর শাহ জাফর। জাফর হয়তো তাঁর এই পূর্বসূরিকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন অধিক, তাই নিজের প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘মির্জা দারা বখত মিরান শাহ’। দুজনই সিংহাসন রক্ষার চেয়ে বেশি ঝুঁকেছিলেন আধ্যাত্মিকতা আর সাহিত্যচর্চার দিকে। যার পরিণাম ছিল নিজ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রেই দারার প্রাণ হারানো। আর বাহাদুরের মৃত্যু ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম পরিহাস। তবে এমন আরো ঘটনা আছে যা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। শাহ জাফরকে যেমন ভারত থেকে মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল তেমনি মিয়ানমারের রাজা ‘থিবা মিন’কে পরিবারসহ নির্বাসনে আনা হয়েছিল ভারতের রত্নাগিরিতে। থিবাও পেনশন পেতেন নির্বাসনের সময়, শাহ জাফরও। যে ইংরেজরা ব্যবসার অনুমতির জন্য তাঁরই পূর্বপুরুষের দরবারে মাথা নুয়ে অনুমতি চেয়েছে সেই তারাই নির্বাসনে পাঠিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছে জাফরকে। মৃত্যুর অনেক আগেই বারবার মৃত্যুর স্বাদ পেয়েছেন তিনি। তাঁর পঞ্চম বংশধর উমাহানী বেগম আনন্দ বাজার পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাত্কারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, সত্যি তাঁর মরদেহ রেঙ্গুনে আছে নাকি ব্রিটেনে নিয়ে মমি করে রাখা হয়েছে? তবে আবেগজনিত কারণ ছাড়া এর পেছনে যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এমন হলে দাফনের পর ৩০ বছর পর্যন্ত এই এলাকা সংরক্ষিত করে রাখত না ইংরেজরা। সে সময় ফাতেহা পাঠের জন্য কাউকে প্রবেশের অনুমতি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। আসলে ইংরেজরা ভারতবাসীর আবেগের জায়গাটা ভালোই চিনেছিলেন বলে এই সতর্কতা। নির্বাসনের পর যখন শরীরের চূড়ান্ত অবনতি হয়, বাদশা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর আয়ু ফুরিয়েছে। শেষবারের মতো রেঙ্গুন থেকে পত্র লিখে অনুমতি চেয়েছিলেন, যেন তাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। দিল্লির মাটিতে ঘুমাতে না পারলে তার মৃত্যুতেও শান্তি নেই। কিন্তু ব্রিটিশ সেনাপতি হডসন বলেছিল, জীবিত কম জোরি বাদশাহর চেয়ে মৃত শাহ জাফরের ক্ষমতা অনেক বেশি হবে। এ অঞ্চলের মানুষ মৃতের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। অতএব তার সমাধি দিল্লিতে থাকলে সেখান থেকেই শুরু হতে পারে নতুন বিদ্রোহ। ১৮৬২ সালের ৭ জুন মৃত্যুর পর অত্যন্ত গোপনে দাফন সম্পন্ন করে ঘাস দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ১৯০৩ সালে ভারত থেকে একদল প্রতিনিধি রেঙ্গুনে এসে প্রথম দাবি করেন, তাঁর সমাধি পুনঃস্থাপনের। জিনাত মহলের মৃত্যুর পর জামশেদ বখত ১৯২১ সাল পর্যন্ত এবং জামানী রওনাক ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সমাধি দেখাশোনা করেন। ১৯২৫ সালে পুরো সমাধি এলাকার দাবি করে বসেন মিসেস ডাওসন নামে এক ব্রিটিশ মহিলা। রেঙ্গুন হাইকোর্টে মামলা ওঠে। ১৯৩৫ সালে এ জায়গা মুসলিম সম্প্রদায়কে অর্পণের জন্য স্থানীয় বিশিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিরা জমায়েত হন। তাঁদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কোর্ট মামলা খারিজ করে একটি নতুন লিজ এগ্রিমেন্টে ওয়াকফ কমিটিকে জায়গাটি প্রদান করে। অদ্ভুত বিষয় হলো, মৃত্যুর প্রায় ১৩০ বছর পর আবিষ্কৃত হয় শাহ জাফরের আসল সমাধি। ১৯৯০ সালে পানির লাইন খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া যায় বাদশার কবর।
জিনাত মহলের সমাধির সামনে প্রার্থনারত সেই নারীকে এবার জিজ্ঞেস করলাম, মূল ভবনে সম্রাটের কবর নেই? তিনি খানিকটা বার্মিজ ভাষা আর কিছুটা হিন্দি মিশিয়ে যা বললেন তার অর্থ, সমাধিতে এসে অস্থির হয়ো না। আছে, সেটা অনেকটা ভূতলে। আমি সত্যি অস্থির ছিলাম তাঁর কবরটি দেখতে। ভবনের সেই প্রশস্ত ফাঁকা জায়গা থেকে ডান দিকে এগিয়ে ঝুঁকলে দেখা যায় তাঁর সমাধি অনেকটা ভূতলে। সরাসরি যাওয়ার পথ নেই। চত্বর দিয়ে বেরিয়ে আবার নিচে নামতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম, ভারত ও পাকিস্তানের যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তি এখানে এসেছেন তাঁদের ছবি। এর মধ্যে এপিজে আবুল কালাম, রাজীব গান্ধী ও বেনজির ভুট্টোর ছবি আছে, বার্মিজ ভাষায় প্রকাশিত পেপার কাটিং যার অধিকাংশ পড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের কোনো কোনো নেতা এলেও তাঁদের কোনো ছবি নেই। ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে নিচের দিকে ভূতলে এখনো অনেকটা অন্ধকার, অনেকটা ঘনীভূত ছায়া জমে আছে। এগিয়ে গিয়ে আরো কিছুটা ডানের মোজাইকের দেয়ালের সাথে তাঁর কবরটা। তিন দিকের টাইলসের সাদা দেয়াল। মাঝখানে ঝাড়বাতি ঝুলছে। মূল কবর মাটির নিচে রেখে উপরে বাক্সমতো করা। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, কবরটা ঠিক সোজা নয়, খানিকটা কোনাকুনি করে কাটা। অন্তত ওপরে রাখা তিনটি কবরের সাথে তুলনা করলে একে আড়াআড়িমতো লাগে। মোজাইকের দেয়ালে বাদশার হাতে আঁকা ছবির স্ক্রিনপ্রিন্ট বসানো। দুপাশে কালো কালো হরফে উত্কীর্ণ সুরা ও তার নিজের লেখা এপিটাফ। সেই আক্ষেপ— ‘কত মন্দ ভাগ্য তোমার জাফর, নিজের দেশে কবরের জন্য দুগজ জমিও মিলল না অবশেষে।’ এই বোধহয় ছিল তাঁর শেষ লেখা। তবে এর প্রতি-উত্তরও আছে। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সফরে এসে লিখেছিলেন, হিন্দুস্তানে তুমি দুগজ মাটি পাওনি সত্য, তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই উঠেছিল আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম গৌরবের সাথে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। বর্তমান এই সমাধিটি তৈরি হয়েছে ১৯৯০ সালে কবর পাওয়ার পর ১৯৯১ সালে ভারতের সহায়তায়। প্রশস্ত, ভারি স্টিলের নঁকশাকাটা বন্ধনী দিয়ে ঘিরে রাখা সমাধি। মখমলের সবুজ গিলাফ তাজা গোলাপের পাপড়িতে ঢেকে আছে। উপর থেকে নেমে এসেছে দীর্ঘ ঝাড়বাতি। সেই বাতির আলোর চেয়ে করুণ অনুভূতির প্রলেপই বেশি। ভূতলে হওয়ায় এখানে ওপরকার মিলাদের শব্দ অস্পষ্ট হয়ে ভাসছে। ডান দিকের দেয়ালের পাশ দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়। জাফরের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অচেনা শহরের সন্ধ্যা নামল চোখের সামনে। কে যেন বলল, ‘জীবন আজ অতিক্রান্ত, সন্ধ্যা নেমেছে জীবনে, আমাকে ঘুমাতে হবে, সমাধির দিকে প্রসারিত আমার পা।’ কত দিন আগে ভেবেছিলেন জাফর এভাবে....তাও তো প্রায় দেড়শ বছর আগের গল্প। বাইরে অন্ধকার যত জমছে ভেতরে বাড়ছে ঝাড়বাতির দ্যুতি। আমরা বেরিয়ে এলাম নিঃশব্দে। সন্ধের মুখে অন্য একটা দল তখন নতুন করে কিয়াম করছে...ইয়া জালাল, ইয়া জাফর সালাম আলাইকা...সন্ধ্যা নামছে ইয়াঙ্গুনে।
মৌনতা নিয়ে ফিরে আসার পথে সহযাত্রী আচমকা চমকে দিয়ে বলল, আপা, দুটো লাইন শুনবেন?...দীর্ঘ জীবন চেয়ে পেয়েছি চার দিন সময়, দুদিন কেটে গেল আকাঙ্ক্ষায় আর দু দিন অপেক্ষায়। জাফর বলেছিলেন।
খান-ড্য-জি লেক পেরিয়ে হোটেলে ফেরার পথে সেদিন অন্ধকারের পথে আমরা আর কেউ কোনো শব্দ করিনি।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
Find us on Facebook Nobin Kontho