সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭

ভারতীয় বাঙালি বাংলাদেশি বাঙালি

শত্রু না থাকলে অনেক সময় আত্মপরিচয়ের বোধ আসে না। পাশের বাড়ির লোকে যদি সকাল বিকাল গোষ্ঠী তুলে আর মুখ খারাপ করে গালি দিতে থাকে, তাহলে গালি খাওয়া গোষ্ঠীর মধ্যে একধরনের আত্মপরিচয় ও একতা তৈরি হয়। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নানারকম গালিগালাজ আর অত্যাচারে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এই ধরনের আত্মপরিচয় প্রবল হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের মানুষের সেই আত্মপরিচয়ের নাম হলো বাঙালিত্ব। বাঙালিত্ব আমাদের বহু আগে থেকেই ছিল, কিন্তু অনেক
সময়ে তা ঠিক ঠিক আন্দাজ করা যেত না। বাঙালিত্ব নিয়ে লড়াই করে একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার পরে এখনো অনেকে ঠিক ঠাওর করতে পারেন না যে তিনি বাঙালি কিনা। বস্তুত বাঙালি এখন পৃথিবীর সর্বত্রই, কিন্তু বাঙালিত্বের রূপটায় কিছু কিছু রকমফের হয়েছে। বাড়ির পাশে ভারতীয় বাঙালিদের দিকে তাকালে এই রকমফেরের অনেকটা চোখে পড়ে। দেখতে শুনতে ভারতীয় বাঙালিরা মোটামুটি আমাদের মতোই, তবে ভাবেসাবে খানিকটা যেন আরেক রকমও। বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেলে এই আরেক রকমের বাঙালিদের কিছু কিছু লক্ষণ বোঝা যায়। প্রথমেই যেটা নজরে আসে, সেটা হলো ভারতীয় বাঙালিদের ভাষা।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এই দুই এলাকার মানুষই বাংলা ভাষায় কথা বলে; ত্রিপুরায়ও তা-ই। কিন্তু সে যেন আরেক ধরনের বাংলা, বিশেষত এর উচ্চারণ। বাংলাদেশেও নানারকম বাংলা রয়েছে, সিলেটে যে বাংলা ভাষা চলছে নোয়াখালীতে সে বাংলা চলে না, আবার পাবনায় যে বাংলা চলে চট্টগ্রামে রয়েছে তা থেকে অনেক আলাদা ধরনের বাংলা। সারা বাংলাদেশের মানুষের মুখের যে ভাষা, তার মধ্যে একটাই শুধু মিল; আর তা হলো সব এলাকার উচ্চারণই যথেষ্ট পরিমাণে অপ্রমিত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা পর্যন্ত লোকে যে বাংলায় কথা বলে, তার মধ্যে একধরনের সাধারণ ধ্বনিগত মিল রয়েছে। এমনকি আসাম ও ত্রিপুরায় যারা বাংলায় কথা বলে, সে বাংলাও বহুলাংশে এক ধরনের। বিশেষত শিক্ষিত শ্রেণির ভাষা। শিক্ষিত পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালির মুখের ভাষার উচ্চারণ যথেষ্ট প্রমিত। বাংলাদেশে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এমনকি পার্লামেন্টেও চরম আঞ্চলিক উচ্চারণে বক্তব্য দেয়া হয়, কারণ ওই রকম বাংলা বলা বাংলাদেশের বাঙালিদের চিরকেলে অভ্যাস। পশ্চিমবঙ্গের কোনো বিদ্বত্ সভা কিংবা বিধান সভায় আঞ্চলিক উচ্চারণের বাংলা তেমন চোখে পড়বে না। এর কারণও একই, বহু কালের অভ্যাস।

এই অভ্যাসের ফলেই সম্ভবত ভারতীয় টিভি নাটকের ভাষাটাও প্রমিত ভাষার খুব কাছাকাছি। ভারতের বিভিন্ন চ্যানেলে যে বাংলা নাটক হয়, সেগুলো বাংলাদেশেও খুব জনপ্রিয়। ভারত বিরোধী নানারকম আবেগ সত্ত্বেও বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলের রয়েছে একচেটিয়া আধিপত্য। এখানে একটি অদ্ভুত ব্যাপারও রয়েছে। সেটি হলো, পশ্চিমবঙ্গে মাত্র আট কোটির মতো বাঙালি বাস করে, অথচ তারা বাংলাদেশের ষোলো কোটি বাঙালির বিনোদনের বাজার দখল করে রেখেছে। এই চ্যানেলগুলো ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বাঙালিদের মধ্যেও জনপ্রিয়। ভারতীয় বাঙালিরা হিন্দি চ্যানেলও দেখছে, বাংলা চ্যানেলও দেখছে। বাংলাদেশেও ঠিক তা-ই হয়, হিন্দি ও বাংলা এই উভয় ধরনের ভারতীয় বিনোদন চ্যানেল এখানে সমান জনপ্রিয়। পার্থক্য হলো দৃষ্টিভঙ্গির। ভারতীয় চ্যানেলগুলোর প্রবল নিন্দা করা বাংলাদেশে খুব সংস্কৃতিপ্রেমীর ব্যাপার বলে মনে করা হয়, ভারতে এসব ভাষা সংস্কৃতির নিন্দার ব্যাপার নেই। তারা ভাবে, হিন্দিটাও আমার বাংলাটাও আমার। হিন্দি হোক আর বাংলা হোক, বিনোদন দিতে না পারলে তা যে কেউ দেখবে না, এই সত্যটা তারা ধরতে পেরেছে। টেলিভিশন খোলে লোকে আরাম পাবার জন্য, যেখানেই তা পায় সেই চ্যানেলই দর্শক দেখে; দর্শকের প্রিয় বিনোদন, দেশপ্রেমের বাগাড়ম্বর নয়।

প্রমিত শব্দ ব্যবহারে ভারতীয় বাঙালিরা যেমন এগিয়ে, তাদের মুখে অশ্লীল শব্দের ব্যবহারও খুব কম। কলকাতা যাবার পথে একদিন ট্রেনের মধ্যে মিনিট দশেক ধরে চলা একটি ঝগড়া দেখার সুযোগ হয়েছিল। ট্রেনে বসার জায়গা নিয়ে ঝগড়াটা বাধে, একপর্যায়ে তা তুমুল আকার ধারণ করে। মুহূর্তের মধ্যে দুই পক্ষের দুইজন তড়াক করে লাফিয়ে উঠে শরীর বাঁকিয়ে, আঙুল নাচিয়ে আর চোখ পাকিয়ে চিত্কার করতে থাকেন। খুব অপেক্ষা করে আছি, ভারতীয় বাংলা গালির একদফা লাইভ শো দেখার জন্য। কিন্তু শক্তিশালী গালি তো যখন তখন মুখে আসে না, এর জন্য পর্যাপ্ত মাত্রার উত্তেজনা সৃষ্টির দরকার হয়। বেশ কয়েকবার উত্তেজনা ঠিক ঠিক সেই মাত্রায় পৌঁছালো। কিন্তু দুইজনের কেউই একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করল না। বরং ঝগড়া মোটামুটি প্রমিত বাংলাতেই হলো। এদের একজনের দাঁতের নিচের পাটির একটি দাঁত ছিল না। সেই সুযোগটা নিলো অন্যজন। খুব রেগে গিয়ে সে বলে উঠল, ‘তোর যে একটি দাঁত পড়ে গেছে, আমি বাকি সবগুলো এখন ফেলে দেবো, বুঝতে পারলি?’ জবাবে অপরজন গলার শিরা ভাসিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘একবার দাঁতে হাত দিয়ে দেখ, তোর হাতের কি দশা আমি করি, তখন বুঝবি।’ বুঝতে পারছি বাংলাদেশের পাঠকের কাছে এমন শুদ্ধ বাংলার সংলাপ বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। কিন্তু কী আর করা, যা শুনেছি তা-ই বলে দিলাম।

আরেকটি ঝগড়া দেখার সুযোগ মিলে গিয়েছিল দুই ড্রাইভারের মধ্যে। বর্ধমানের একটি ছোট গলিতে একদিক দিয়ে একটি বাস ঢুকেছে আর বিপরীত দিকে থেকে একটি ট্রাক মুখোমুখি এসে পড়ায় রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। যথারীতি দুই ড্রাইভার রাস্তা বন্ধ করার জন্য একে অন্যকে দায়ি করতে শুরু করল। তর্ক ক্রমে বিশ্রী আকার ধারণ করল, দুই দিকে ট্রাক আর বাসের পেছনে আরও কিছু গাড়ি জমে যাওয়ায় রাস্তাটা গেল আটকে, ফলে সামনে পেছনে অনেকেই চেঁচাতে শুরু করল। ধারণা করলাম, এবার নির্ঘাত কিছু অশ্লীল শব্দের লড়াই চলবে। ঝগড়াঝাটি চেঁচামেটি মিনিট পাঁচেক ধরে চলল, কিন্তু দুই ড্রাইভার এবং তাদের দুই দিকের সমর্থকরা কেউই মুখ খারাপ করল না। বাংলা ভাষার গালি নিয়ে দারুণ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকার। কিন্তু তিনি মূলত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বাংলাদেশের সর্বজনীন গালি ও অশ্লীল শব্দের ব্যবহারের সঙ্গে তিনি হয়তো তেমন পরিচিত নন। তাঁকে বলেছিলাম, শুধু ভারতীয় বাঙালিদের গালি শুনলে বাংলা গালির মূল শক্তিটা অধরা থেকে যায়। কারণ, গালির শব্দের মূল শক্তিটা বাংলাদেশেরই। পবিত্র সরকার বলেছিলেন, না পশ্চিমবঙ্গেও গালিতে অশ্লীল শব্দের ব্যবহার হয়। কিন্তু দুই বাংলার অনেক গালিপ্রবণ এলাকায় ঘুরে মনে হয়েছে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশই ঢের ব্যবধানে এগিয়ে।

বাংলাদেশের কিশোর ও তরুণ ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইদানিং একধরনের বিকৃত উচ্চারণে কথা বলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ‘র’কে ‘ড়’ করা, কথার মধ্যে ঘনঘন অ্যান্ড, বাট ও সো এই শব্দগুলো বারবার ব্যবহার করা—এই হলো তাদের বিকৃতির একটি লক্ষণ। এ কোনো আঞ্চলিকতা নয়, এ হলো কথা বলার বাংলাদেশি হাল ফ্যাশন। ভারতের বাঙালি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই ফ্যাশন অচল। তারা ঝরঝর করে প্রায় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে যাচ্ছে। ফেরিওয়ালাও যেমন বলছে, ভাষাবিজ্ঞানীও প্রায় তেমন বলছে। শান্তিনিকেতন পৌষ মেলায় পরিচয় হলো কয়েকজন বাংলাদেশি বাঙালির সাথে। দেখলাম, দেশের ভাষাটা তারা দেশেই ফেলে রেখে এসেছেন, দিব্যি পশ্চিমবঙ্গীয় স্টাইলে কথা বলছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশি স্টাইলে উচ্চারণ করতে শুনিনি। ভাষার ক্ষেত্রে এ একধরনের আত্মবিশ্বাস বৈকি! বাংলাদেশ থেকে যারা কলকাতায় যাচ্ছেন, তারা জানেন কলকাতায় গিয়ে করতেছি, খাইতেছি, যাইতেছি, আইবা, যাইবা এসব বললে কেমন যেন শোনায়। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জানেন পৃথিবীর সর্বত্রই করছি, খাচ্ছি, যাচ্ছি, আসবে, যাবে এই শব্দগুলো চলবে। প্রমিত ভাষার এ হলো শক্তি আর সৌন্দর্য। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা ভাষার এই শক্তিটা এখনো ঠিকমতো ধরতে পারেনি। ফলে দেখতে তারা অত্যন্ত স্মার্ট হলেও মুখের ভাষাটা রয়ে গেছে অপরিসীম গেঁয়ো।

এ তো গেল বাংলা ভাষার কথা। কিন্তু কলকাতা আগরতলা মানে তো আর কেবল বাংলা নয়। সমস্ত সরকারি সাইনবোর্ড সেখানে অনন্ত তিনটে ভাষায় লেখা : বাংলা, হিন্দি আর ইংরেজি। প্রতিটি রেল স্টেশনে অনবরত রেল আসা আর যাওয়ার ঘোষণা চলছে; সেখানেও এই তিনটে ভাষায়। রেলের ডিজিটাল বোর্ডেও এই তিনটে ভাষা। এছাড়া তাদের মুখের ভাষাও হয়ে গেছে বহুজাতিক। কলকাতা শহরে বাসের মধ্যে চললে কিংবা কোনো মার্কেটে কেনাকাটা করলে এই বহুজাতিক ভাষা শোনা যায়। গাড়ির মধ্যে কেউ হয়তো ভাড়া দিচ্ছে বাংলায় তো অন্যজন দিচ্ছে হিন্দিতে। আর যিনি কনডাকটর, তিনিও ক্ষণে ক্ষণে ভাষা পাল্টে ফেলে ভাড়া বুঝে নিচ্ছেন। ফুটপথ থেকে শপিংমলের দোকানদার প্রায় সকলেই সেখানে গোটা তিনেক ভাষা জানে। দমদম থেকে একটি ট্রেনে চেপে কলকাতায় যেতে যেতে একদিন শুনলাম, একজন তরুণী আর তার বয়স্কা পিসি অনবরত ইংরেজিতে কথা বলে চলেছেন। প্রথমে মনে হলো লোক দেখানোর জন্য এই ইংরেজিতে কথা বলা; কিন্তু যখন দেখলাম, পুরো পথটাই তারা সাবলীল ইংরেজিতে কথা চালিয়ে গেল, তখন ভুল ভাঙল। মেয়েটা মোটামুটি পুরোপুরি ইংরেজি বলছে, পিসিটা মাঝে মাঝে বাংলা। এঁরা এমন কোনো কলকাতার হাই সোসাইটির মানুষ নন, নেহায়েতই মধ্যবিত্ত। ঘরের বাইরে বের হলে নানা ভাষা শোনা ওখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এভাবে শুনে শুনে ওখানকার মানুষ দুই-তিনটে ভাষা শিখে ফেলেছে। ভাষার ব্যবহার সেখানকার মানুষের নামের বানানের ক্ষেত্রেও কিছুটা আলাদা। বাংলাদেশে যা সোহরাব, ভারতে তা হলো সহরব, একাত্তরে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া ভারতে গিয়ে হয়ে গিয়েছিল এহিয়া। অধুনা বাংলাদেশের সাকিব-আল হাসান সেখানে হয়ে গেছেন সাকিবুল হাসান।

বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের লেখ্য ভাষা ব্যবহারের মধ্যেও অনেক পার্থক্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে। দৈনিক পত্রিকা আর বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের দিকে খেয়াল করলে তার অনেকখানি বোঝা যায়। ভারতীয় কয়েকটি বাংলা পত্রিকার কিছু সংবাদের শিরোনাম শুনুন, বুঝতে পারবেন পার্থক্য কোথায়। খোলা আকাশের নীচে মীন কেনাবেচা, বিজেপিকে তোপ তৃণমূলের, ফের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ, পাকিস্তানে তালিবান নিকেশ অভিযান ইত্যাদি। একটি শিরোনাম দেখে তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। দেখলাম, পরিষ্কার বাংলায় বড়ো হরফে লেখা, ‘ভাতারের সেতু ক্ষতিগ্রস্ত’। ভাতার মানে খুব সুবিধের কিছু নয়, ভেতরে উত্তেজক কোনো গল্প আছে মনে করে পড়তে গিয়ে দেখি, ভাতার একটি জায়গার নাম। সংবাদ শিরোনামে মানুষের নামধামের ব্যবহার এমনভাবে হয় যে, বাংলাদেশি কানে তা বিশ্রী শোনাতে পারে। যেমন, প্রণবের জামাইষষ্ঠি। পড়ে মনে হতে পারে, প্রণব বুঝি পাড়ার কোনো নতুন জামাই। কিন্তু এ হলো ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাষ্ট্রপতি হউন আর যেই হউন, খবরে তাঁর নাম লেখা হয় যেন ইয়ার বন্ধুর নাম লেখা হচ্ছে। বহু শব্দের তারতম্য রয়েছে। যেমন—পরিষদ হলো পর্ষদ, অবস্থান ধর্মঘট হলো ধর্ণা, হরতাল হলো বন্ধ, স্লিম হওয়া হলো রোগা হওয়া, দাগহীন ত্বক হলো নিদাগ ত্বক, সেলফি তোলা হলো নিজস্বী তোলা, ‘সংবিধিবদ্ধ’ না লিখে লেখা হয় ‘বিধিবদ্ধ’, দপ্তরকে লেখা হয় করণ, কর্মকর্তা হলো আধিকারিক, সভাপতিত্ব হলো পৌরহিত্য—এমন হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে। দোকানপাঠের নামও নতুন ধরনের, এমনকি অভিনব। যেমন—একটি গার্মেন্টসের দোকানের নাম দেখলাম সঙ্গম। একটি ফাস্টফুডের খাবারের দোকানের নাম কবিগুরু রোল কর্নার। একটি বিউটি পার্লারের নাম রাখা হয়েছে লোকনাথ সাজঘর। কবিগুরুর নামে ফাস্টফুডের দোকান দিলে বাংলাদেশেও কেউ নিষেধ করবে না, কিন্তু এ রকম নাম এখানে অচল। আর লোকনাথ ব্রহ্মচারী সারা জীবন ছিলেন অবিবাহিত, মেয়েদের সেজেগুজে সুন্দর থাকা না থাকা নিয়ে তাঁর একটি বাণী বা উপদেশ নেই। অথচ তাঁর নামে মেয়েদের রূপচর্চার দোকান। আর সঙ্গম শব্দের অর্থ যতই সুন্দর হোক, বাংলাদেশের কেউ এই নামের ধারেকাছেও যাবে না।

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নাম আসায় আরেকটা ঘটনা মনে এল। ঘটনাটা ভারতীয় ইমিগ্রেশান আর কাস্টমসের। এই দুটো অফিসেই এই ব্রহ্মচারী বাবাজির দুটো ছবি দেখেছিলাম। দেখলাম ছবির সামনে কয়েকটি তাজা ফুল এবং ধূপের সাদা ছাই পড়ে রয়েছে। বিউটি পার্লারের মালিক যেমন দুটো পয়সা কামানোর জন্য লোকনাথের নামে দোকান খুলেছেন, ইমিগ্রেশান আর কাস্টমসের লোকনাথ ভক্তরাও প্রায় একই কাজ করেছেন। তবে ‘লোকনাথের কৃপায়’ এখানে তাঁদের আয়-রোজগার বেজায় ভালো; প্রতি মিনিটে যে স্পিডে ঘুষ আসছে, তা ভাবাই যায় না। ইমিগ্রেশানে লোকনাথ বাবার যেসব লক্ষ্মীছেলেরা বসে আছে, তাদের ঘুষ নেওয়ার পদ্ধতিটা খুব সায়েন্টিফিক বলে মনে হলো। আগে ভারতে প্রবেশের সময়ে ইমিগ্রেশানে পঞ্চাশ টাকা এবং ফেরার সময় ত্রিশ টাকা বাধ্যতামূলক ঘুষ দিতে হতো। এতে নিশ্চয়ই ইমিগ্রেশান-বাবুদের দুইবার ঘুষ খাওয়ার পাপ হতো। এবার দেখলাম ইমিগ্রেশানের কর্তারা সেই পাপ কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। এখন শুধু যাওয়ার সময়ে দিতে হবে আশি টাকা; আসার সময়ে কিছু দিতে হবে না; যাওয়া আর আসার ঘুষটা তারা একবারে নিয়ে নিচ্ছে। এতে তাদের এবং যাত্রীদের উভয়েরই সময় বেঁচে যাচ্ছে। কাস্টমসের ঘুষ নেয়াটা অবশ্য এখনো সেকেলে। কারো কাছ থেকে একশ আবার কারো কাছ থেকে দুইশ তিনশ পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। যাত্রীরাও এখন চালাক হয়ে গেছে, ঘুষ দেবার বেলায় তারা এখন দরদাম করেই দেয়। আমার সামনেই একজন মহিলা যাত্রী কাস্টমস-কর্তাকে বললেন, গত সপ্তাহে একবার আপনাকে দেড়শ টাকা দিয়েছি, আজ একশ টাকা নিন। কাস্টমস আর ইমিগ্রেশানের যে অফিস দুটোতে বসে ঘুষ খাওয়া চলছে, সেই অফিসদুটোর দেয়ালে অবশ্য শুধু লোকনাথ ব্রহ্মচারী নেই; আছেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দও। এক কোণায় দেখলাম মহাত্মা গান্ধীর একটি ছবিও। রবীন্দ্রনাথের একটি গানে যে বলা হয়েছে, ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা’, এখানে তা খুবই সত্যি হয়ে উঠেছে। ভাগ্যিস ছবিতে প্রাণ থাকে না, তা না হলে এ ছবির মানুষগুলো প্রতিদিন কয়েকবার করে হার্টফেল করতেন!

ভারত মোটেই বাঙালিপ্রধান দেশ নয়, তবু সেখানে বাংলা ভাষার কারবারটা বেশ এগিয়ে। যেমন, ধরা যাক টেলিভিশনের কথা। শুধু বাংলা সংবাদ চ্যানেল যদি হিসাব করা হয়, তবে সংখ্যার দিক দিয়ে তা বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ছাড়িয়ে যাবে। ২৪ ঘণ্টা, নিউজ টাইম, ABP আনন্দ, স্টার আনন্দ, খবর ৩৬৫ দিন, নিউজ বাংলা, হাই নিউজ প্রভৃতি চ্যানেলের সবগুলোই বাংলা সংবাদ চ্যানেল। এছাড়া ইটিভি বাংলা, দূরদর্শন-সহ আরও কয়েকটি বাংলা চ্যানেলে নিয়মিত খবর প্রচারিত হয়। এর বাইরে হিন্দি খবরের চ্যানেল তো অগণিত। অথচ সারা ভারতে বাঙালি দর্শক দশ-এগারো কোটির বেশি নয়। বাংলাদেশের মতো সেখানে সবসময় গরম গরম খবরও মেলে না। হরতাল একপ্রকার নেই, লোডশেডিং নেই, অবরোধের নামও লোকে জানে না, পেট্রোল বোমা, গাড়িতে আগুন, রেলের পাটি তুলে ফেলা এসব সেখানে হয় না। ফলে নদীয়ার কোন আখক্ষেতে শিয়ালের কামড়ে খেয়ে কে একজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, অথচ প্রশাসনের শিয়াল দমনে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই, সেটি সেখানে একটি খবর। শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পথে একটা লোকাল ট্রেন কিছুক্ষণ বিদ্যুত্ ছিল না বলে মাঠের মধ্যে থেমে ছিল, সেটি একটি খবর। কোথায় কোন প্রাইভেট শিক্ষক ছয় বছরের একটা বাচ্চাকে বাসায় দুটো চড় মেরেছিল, বাসার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় তা ধরা পড়েছে, তাই নিয়ে মহা হৈচৈ। রাজনীতি, খেলাধুলা আর সংষ্কৃতির খবরও রয়েছে। তবে আশ্চর্য হলো, পাকিস্তান নিয়ে কোনো উসকানিমূলক সংবাদ বা নিন্দাসূচক খবর এখানে তেমন চলে না। পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে দেখেছি, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নিয়ম করে সেখানে ভারত বিরোধী কিছু না কিছু প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানে তালেবানি হামলায় একটি স্কুলে যখন শতাধিক শিশু নিহত হয়েছিল, তখন কলকাতায় এর প্রতিক্রিয়া দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি, পাকিস্তান ধ্বংস হচ্ছে বলে একটি মিডিয়ায়ও প্রচ্ছন্ন খুশি চোখে পড়লো না। বরং, পরদিন সমগ্র ভারতের প্রতিটি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মানে নীরবতা পালন করল, প্রার্থনাও করল। ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এই ব্যাপারটি ঘটেনি।

পশ্চিমবঙ্গের ভায়েরা সংসার জীবন নিয়ে বোধহয় কিঞ্চিত ঝামেলায় আছেন। স্বামী-স্ত্রীর অমিল ঠেকানো আর বশীকরণের তাই এত রমরমা প্রচার। ট্রেনে, বাসে, স্টেশনে সর্বত্র চোখে পড়বে নানা রকম বশীকরণের বিজ্ঞাপন। সে সবের ভাষা এমন উত্তেজক যে লোকের সামনে গল্প করে বলা যায় না, বড়োজোর চুপি চুপি পড়ে ফেলানো যায়। বাঙালি যেসব জ্যোতিষীরা এই বশীকরণের কাজটি করে চলেছেন, তারা প্রায় সকলেই নানারকম স্বর্ণপদক প্রাপ্ত। কারো উপাধি আচার্য, কারো উপাধি শাস্ত্রী; যাঁরা মুসলমান তাঁদের অবশ্য এসব শাস্ত্রী আর আচার্য লাগানোর সুযোগ নেই। এজন্য তাঁরা নামের আগে ‘বাবা’ জুড়ে দিয়েছেন : যেমন বাবা শফিউন খান, বাবা মোবারক খান ইত্যাদি। হিন্দু ও মুসলমান এই উভয় ধরনের কাস্টমারের কথা ভেবে অনেকে লিখেছেন, সলেমানি ও হিন্দু তন্ত্রে তীব্র বশীকরণ করা হয়। যেকোনো মেয়ে বা ছেলের সাথে এরা প্রেম বা বিয়ে ঘটিয়ে দিতে পারেন বলে দাবি করেন। এই অবিশ্বাস্য কাজটি করতে কারও আবার এক দিনের বেশি সময় লাগে না। কেউ দাবি করেন, তিনি মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় বশীকরণ করতে পারেন, কেউ পারেন তিন ঘণ্টায়! যারা বেজায় প্রতিভাবান তারা অবশ্য অত দেরি করতে রাজি নন, তারা বলছেন বশীকরণ হবে মাত্র তিন মিনিটে! এতকাল এইসব বশীকরণ বিশেষজ্ঞরা প্রায় সকলেই ছিলেন পুরুষ। কিন্তু কলকাতার বাঙালি নারীরাও এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন। একটি বিজ্ঞাপনে দেখলাম ‘তান্ত্রিক মা জয়া’ নামক একটি সুদর্শন তরুণী বশীকরণ করিয়ে দিচ্ছেন। কে জানে, অমন সুন্দর চেহারা দেখে হ্যাংলা ছেলেরা হয়তো তাকেই বলে বসবে, ‘জয়া, অন্য কোথাও আর ছোটাছুটি করতে চাই না, তোমার সাথেই বশীকরণটা করিয়ে দাও লক্ষ্মী!’ এ তো গেল বশীকরণ করার ব্যাপার, কিন্তু কেউ যদি আপনার অজান্তে অন্য কারো সাথে বশীকরণ করে ফেলে, তখন কী উপায়? উপায় হলো, বশীকরণ কেটে ফেলানো, উপযুক্ত দক্ষিণা দিলে সেটাও করার ব্যবস্থা আছে। তবে যারা এসব বশীকরণে বিশ্বাস রাখতে পারছেন না, তাদের বিয়ে-থা, প্রেম, ঘরের ছেলেমেয়ের গতিবিধি এসবের বাপারে একেবারে অথেনটিক খবর দিচ্ছে কিছু সংস্থা। এসব সংস্থা নাকি চালাচ্ছেন কাজ করছেন প্রাক্তন কিছু সিআইডি ও আইবি-এর গোয়েন্দা। ঘরের গিন্নি অথবা কর্তার মন উড়ুউড়ু, সারাক্ষণ ফেসবুক আর মোবাইলে ঘুটুর ঘুটুর আলাপ করছেন, দেখেশুনে আর আস্থা রাখতে পারছেন না। উপযুক্ত ফি পেলে এই গোয়েন্দারা আপনাকে আসল খবরটা বের করে দেবেন। সত্যি কিনা জানি না, এইসব বশীকরণ এক্সপার্ট ও গোয়েন্দা বিশারদের সকলেই নাকি সরকারি রেজিস্ট্রিকৃত।

রেজিস্টার্ড অবশ্য হতেও পারেন, কারণ পতিতালয়েরও তো রেজিস্ট্রেশন থাকে। বাংলাদেশেও তা রয়েছে। কিন্তু পতিতালয়ের বিজ্ঞাপন প্রথম শ্রেণির কোনো বাংলা দৈনিক পত্রিকায় থাকবে, বাঙালি হিসেবে এই দৃশ্য বাংলাদেশের খুব কম লোকই দেখেছেন। কিন্তু কলকাতায় এই যৌন আনন্দ দেবার বিজ্ঞাপন হরদম চলছে। বিখ্যাত আনন্দবাজার পত্রিকার অনেকটা জুড়েও এই দেহব্যবসার বিজ্ঞাপন থাকে। যার অনেকগুলো আবার ছেলে দেহব্যবসায়ীর বিজ্ঞাপন, ছেলেরা টাকার বিনিময়ে বাসায় বা সুবিধাজনক জায়গায় গিয়ে ললনাদের মনের আশা মিটিয়ে আসবে। বাংলাদেশে এই ধরনের বিজ্ঞাপন কোথাও দেখিনি। এই রকম কয়েকটি বিজ্ঞাপনের ভাষায় একটু নজর বুলিয়ে নেয়া যাক। এর সবগুলো নেয়া আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে। একটিতে লেখা, ‘হাই প্রোফাইল মহিলাদের সাথে রিলেশন করে ইনকাম করুন। সর্বত্র সার্ভিস। ১০০% গ্যারান্টি’, আরেকটিতে লিখেছে, ‘বড় ঘরের মহিলাদের সাথে ঘনিষ্ঠ ও ইনকামের ১০০% গ্যারান্টি। প্রতি জেলায় সার্ভিস।’ খুব সততা পছন্দ করে এমন একটি কোম্পানি লিখেছে, ‘সততা ও বিশ্বাসের সাথে সুন্দরীদের সাথে বন্ধুত্ব। গোপনীয়তা ও ১০০% গ্যারান্টি। সপ্তাহে ৪/৫টি কল। পিক ও ড্রপ সুবিধা।’ যারা এই কাম করতে গিয়ে ঠকেছেন তাদের কথা ভেবে একটি যৌন কোম্পানি লিখেছে, ‘অন্যত্র না ঠকে নিজস্ব এলাকার হাই প্রোফাইল বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে বোল্ড রিলেশন+ইনকাম’, অথবা, ‘আপনার জীবনে প্রতিদিন কাটান নতুন নতুন বান্ধবীদের সাথে। লং ড্রাইভ, নাইট পার্টি। ঠকার ভয় নেই, অফিসে আসুন।’ ঘরের যে সব মেয়ে পার্ট টাইম এই কাজে নামতে চায়, তাদের জন্য বিজ্ঞাপন, ‘বিশ্বাসযোগ্য সংস্থা, প্রতি কলে ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা’। যে সব কোম্পানি এই কারবার চালাচ্ছে, তাঁদের নামগুলোও উত্তেজক। যেমন—রোজ লাভ, স্পেশাল ওয়ান, মুন লাইট, তৃপ্তি কুইন, হাই ক্লাস, ফুল মাস্তি, কল মি, এক্স পোজ, স্বপ্ন সাথী, তুমি যে আমার, তৃষ্ণা, রিয়েল, মনের মানুষ ইত্যাদি। একটির নাম দেখলাম জান্নাত। জান্নাতের মালিক লিখেছেন, ‘স্বপ্নপরীদের সঙ্গে বোল্ড রিলেশন করে জীবনকে জান্নাত বানান।’ এর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে বডি ম্যাসাজ। বিজ্ঞাপনের ভাষাটা শুনুন, ‘সুন্দর পরিবেশে সুন্দরী মহিলা দ্বারা বডি ম্যাসাজের মাধ্যমে পূর্ণ সতেজতা অনুভব করুন,’ কিংবা, ‘বেস্ট ম্যাসাজ বাই স্মার্ট গার্লস, ১০০% এনজয়মেন্ট’। সুন্দর পরিবেশে স্মার্ট গার্লদের দ্বারা সেখানে কী ধরনের ম্যাসাজ চলছে, তা জানি না। তবে অনুমান করতে গিয়ে দেখেছি হার্টবিট বেড়ে যায়। যারা এর চেয়ে বেশি জানতে চান, তাদের জন্য বিজ্ঞাপনের এক পাশে ফোন নম্বর দেয়া আছে।

এই বিরাট যৌন আবেদনের বিজ্ঞাপনের পাশে পত্রিকা জুড়ে রয়েছে নানারকম যৌন ট্যাবলেট আর মালিশের বিজ্ঞাপন। বাংলাদেশে পথেঘাটে অনেকে এই ধরনের ছোট ছোট চিরকুট ছাপিয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ বুঝে তা লোকজনের হাতে গুঁজে দেওয়া হয়। কিন্তু কলকাতায় এই ব্যবসা খুব প্রবল বলে মনে হলো। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় দিনের পর দিন বড়ো আকারের রঙিন বিজ্ঞাপন ছাপানো দু-একটি টাকার ব্যাপার নয়। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন সেখানে এই জাতীয় যৌন সামগ্রীর বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। বাংলাদেশে দেখেছি, যৌন-চিকিত্সার অনেকগুলো হারবাল কোম্পানির নাম ভারতীয় কোনো জায়গার নামে। যেমন কলিকাতা হারবাল, দিল্লি হারবাল, বোম্বে হারবাল, ইন্ডিয়া হারবাল, কামরুপ-কামাক্ষা তেল ইত্যাদি। ভারতে আবার ভারতীয় নামের কদর নেই, তারা বেছে নিয়েছে জাপানি নাম। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রচারিত যৌন উত্তেজক ঔষধের নাম হলো জাপানি তেল আর জাপানি ক্যাপসুল। কলকাতায় অবস্থান করার সময়ে কয়েকদিন সেখানকার বেশ কয়েকটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে বুঝলাম, জাপানি তেল আর জাপানি ক্যাপসুলের সেখানে বেশ কদর রয়েছে। এই তেলটি আবার নারীবান্ধবও, শুধু পুরুষে মেখে মাঠে নামবে এমন নয়, নারীরাও মেখে মাঠে নামলে খেলা নাকি ভালো জমে ওঠে। আগ্রহীরা আরও জেনে রাখুন, তেল আর ক্যাপসুল দিয়েও গ্রাহক সেবা ঠিকঠাক হচ্ছে না ভেবে কোম্পানি স্বয়ং বাত্সায়নকে কন্টাক্ট করেছে। বিজ্ঞাপনের একপাশে তাই ছোট করে লেখা, মহর্ষি বাত্সায়নের পরামর্শ নিন। বাত্সায়ন সেই কবে মরে ভূত হয়ে গেছে, কিন্তু আজও তাঁকে পরামর্শ দিয়ে যেতে হচ্ছে!

পৃথিবীটা বর্তমানে নানা ব্যবসায় সয়লাব হয়ে গেছে। এখানে লজ্জাশরম সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি এসব দেখাদেখির নেই। কলকাতার পত্রিকায় প্রতিদিন যে কনডমের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়, বাংলাদেশের অনেক বড়ো বড়ো কোম্পানিরও অত বড়ো বিজ্ঞাপন সারা বছর চালিয়ে যাওয়ার টাকা নেই। ম্যানফোর্স নামক একটি কনডমের বিজ্ঞাপনে দেখলাম, যিনি মডেল হয়েছেন তিনি একবারে সাক্ষাত্ অপ্সরা। এই অপ্সরার শরীরে কাপড়চোপড় অনিচ্ছাসত্ত্বে একটু আধটু লেগে রয়েছে এই যা; নইলে তাকে ন্যাংটোই বলা যায়। অবশ্য এই অপ্সরার ভিতর বাহির সকলেরই জানা, কনডমের ওই আপুটির নাম যে সানি লিওন! অন্যান্য ব্যবসার মতো ওইসব তেলঠেল-এর সাথে নানা রকম ফ্রি অফারও রয়েছে। যেমন—জাপানি তেলের সাথে ফ্রি হিসেবে দেয়া হচ্ছে একটি কামকলার পুস্তক, কখনো কখনো একটি মেমোরি কার্ড। ওই তেল মেখে কোন ধরনের জিমন্যাসটিকস খেলতে হবে, তার সচিত্র বিবরণ রয়েছে; যাদের তা পড়তে অনীহা, তাদের জন্য রয়েছে মেমরি কার্ড। কার্ডটি একবার মোবাইলে লাগিয়ে নিয়ে অন করলেই চোখের সামনে হাতে কলমে সব শিখিয়ে দিতে থাকবে।

এসব বিজ্ঞাপনের বাইরে এমন কিছু বিজ্ঞাপন রয়েছে, যা বাংলাদেশে দেখা যায় না। যেমন, তালমিছরি। বাংলাদেশে নিশ্চয়ই লোকে তালমিছরি খায়, কিন্তু মিছরি খাওয়াটা এ দেশে এমন জরুরি নয় যে, খবরের কাগজে তার বড়ো বড়ো বিজ্ঞাপন চলবে। রয়েছে অম্লজিনের বিজ্ঞাপনও। এম এ করিম নামক এক ব্যক্তি এই জিনের একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছেন। অম্লজিন কোনো জিনপরীর ব্যাপার নয়, এ হলো বদহজম, পেটের গ্যাস ইত্যাদি পেটরোগাদের নিরাময়ের ঔষধ। বাঙালিদের প্রায় অর্ধেকই তো পেটরোগা। এমনকি কলকাতার ললনাদেরও বেশ পেটরোগা বলে মনে হলো। এভাবে বললে অবশ্য সেখানকার দিদিরা মাইন্ড করতে পারেন। এই দিদিদের সাথে বাংলাদেশের আপুদের বেজায় মিল হলো ফাস্টফুড খাওয়ায়। আর নিয়মিত ফাস্টফুড খেলে পেট একটু তো বিগড়োবেই। বিকেল হলেই বাংলাদেশের পার্ক আর ফুটপথে যেমন ফুচকা খাওয়ার ধুম পড়ে, কলকাতায় পড়ে কচুরি খাওয়ার। কচুরি শব্দটি শুনলে কচুরিপানার কথা মনে হলেও এ মোটেই তা নয়। ফুচকা যেমন ফচকেমি কোনো ব্যাপার নয়। তবে তুলনা করলে কলকাতার দিদিমণিরা ঢাকার আপুমণিদের চেয়ে গড়ে একটু বেশিই মোটা হবেন। বাংলাদেশে নানারকম পর্দার প্রচলন বেড়ে যাওয়ায় অনেকের আকার-আকৃতি অবশ্য বোঝা যায় না। কিন্তু কলকাতায় মেয়েদের স্কিন টাইট জিনস আর টপস-এর খুব চল। ওড়না কারো আছে, কারো নেই। যাদের আছে তাদের বেশিরভাগের শুধু নামেই আছে, গলার দিকে একটু পেঁচানো। বাংলাদেশে অনেকে মেয়েদেরকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করেন, রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলে তাঁদের জিবে নাকি লালা ঝরতে থাকে। এসব ভায়াদের বলি, ভুলেও বর্ডারটা ক্রস করে সীমান্তের ওপারে যাবেন না। গেলে আপনাদের মহান জিবের লালা আর শুকাবে না, খেজুর গাছের রসের মতো অনবরত ঝরতে থাকবে।

শাড়ি বাংলাদেশের মেয়েদের এখনো খুব পছন্দের পোশাক, কিন্তু দুই বাংলার মেয়েদের শাড়ি পরার মধ্যে বেশ ব্যবধান রয়েছে। শাড়ি পরলে পেটের নিম্নাংশটা বেরিয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু বাংলাদেশি নারীরা পেট, পিঠ, হাত সবকিছু দারুণভাবে ঢেকে রেখে শাড়ি পরার কৌশল বের করে ফেলেছে। ভারতে ও সবের তেমন চেষ্টা নেই। রাস্তায় বের হলে হয়তো দেখা যাবে, একের পর এক স্থূলাঙ্গিগণ তাদের ভয়াবহ পেট ও নাভি বের করে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। অনেকের পেটে গর্ভকালীন সময়ে যেসব ডোরাকাটা দাগ পড়েছিল তা হা হয়ে বেরিয়ে আছে। অনেকের ব্লাউজের হাতা স্যান্ডো গেঞ্জির মতো, ব্লাউজের পিছনটাও প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশি চোখ দিয়ে দেখলে অনেকের কাছে এসব নতুন ব্যাপার বলে মনে হবে। কিন্তু এ দৃশ্য সেখানে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। শিয়ালদহ স্টেশনে বসে থাকতে থাকতে একদিন দেখলাম, একটি মেয়ে জিন্স আর গেঞ্জি পরে কেডস পায়ে ইয়াবড়ো এক ট্রাভেল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে মচমচ করে হেঁটে যাচ্ছে। গেঞ্জিটির ঠিক বুক বরাবর বড়ো বড়ো হরফে ইংরেজিতে লেখা ‘ট্রিগার’। বন্দুকে ট্রিগার থাকে এবং সেটিতে টিপ দিতে হয় জানি। তেঁতুল ভায়াদের কথা আবার মনে আসছে; এসব দেখলে লালা পড়ে পড়ে বেচারিদের বুক স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাবে।

বিনা খাটুনিতে বড়োলোক হতে চাওয়া বাঙালিদের আবহমান কালের একটি অভ্যাস। এজন্য কত যে তাবিজ কবচ আর রত্ন পাথরের ব্যবসা দুই বাংলাতে চলছে, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালিরা নামও শোনেননি—এমন অনেক ভাগ্য ফেরানো জিনিস ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যে চালু হয়ে গেছে। এমন একটি জিনিস হলো ধনবর্ষা যন্ত্র, যার আরেকটি নাম ধনলক্ষ্মী যন্ত্র। এই যন্ত্র কিনে বাড়িতে রাখলে আপনার ধনসম্পদ বাড়তে শুরু করবে। একটি যন্ত্রের নাম দেখলাম হনুমান চালিসা যন্ত্র। হনুমান নেহায়েতই একটি বানর জাতীয় প্রাণী। কিন্তু এই প্রাণীটির নামে রামায়ণে একজন বীরের চরিত্র থাকায় তা নিয়ে ভাগ্য ফেরানোর ব্যবসা জমে উঠেছে। হনুমানের নামের এই যন্ত্রও ঘরে রাখলে নাকি সংসারের চারদিকে উন্নতি কানায় কানায় উপচে পড়ে। তাবিজ কবচ, রত্ন-পাথর দিয়ে ভাগ্য পাল্টানোর ব্যবসা প্রাচীনকাল থেকে চলছে; কিন্তু মানুষের যিনি ভাগ্য বিধাতা, তিনি বুঝি আর একঘেয়ে রত্ন-পাথরে খুশি হচ্ছেন না। যন্ত্র সভ্যতার এই বিরাট অগ্রগতির যুগে তিনিও টেকনোলজি-প্রিয় হয়ে উঠেছেন। এজন্য, প্রার্থনা কাকুতি মিনতি এসব ঘ্যানঘেনে ব্যাপার ছেড়ে একেবারে যন্ত্র তৈরি করে বিধাতাকে বাধ্য করানোর চেষ্টা চলছে।

ভারতে গিয়ে দৈব দুর্বিপাক থেকে মুক্ত থাকার একটি অভিনব বই হাতে এসেছিল। একজন শিক্ষকের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে বইটির সন্ধান পাই, বইয়ের নাম ‘বাস্তুবিচার’। ভাবলাম ঘরবাড়ি বানানোর নিয়মকানুন নিয়ে হয়তো লেখা। পড়ে দেখলাম আমার অনুমান ঠিকই আছে, ঘরবাড়ি তৈরির নিয়মই; তবে সে নিয়ম এমন উদ্ভট যে শুনলে মানুষের ভালো মাথা দ্রুত খারাপ হয়ে যেতে পারে। বাড়ির জমি কেনা থেকে শুরু করে বাড়িতে ভাড়াটিয়া ওঠানো পর্যন্ত সর্বত্রই নানারকম গ্রহ নক্ষত্র আর ডাকিনী যোগিনীর বিচার। এমনকি বাড়িতে কী কী গাছ লাগানো যাবে না, তারও একটি বিশাল তালিকা রয়েছে। বইয়ের লেখক রাহুকেতু জীনপরি এসব নানা ব্যাপার হিসাব করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে বাড়িতে কখনো পলাশ, নিম, কুল, খেজুর, জাম, বেদানা, তাল, তেঁতুল, বহেড়া, কতবেল, হরিতকি, ছাতিম কিংবা মনসা গাছ লাগানো যাবে না। লাগালে নির্ঘাত সম্পদহানি হবে। হিসাব করে দেখলাম বাংলাদেশে মদীয় পৈত্রিক বাড়িতে এর অনেকগুলো গাছই রয়েছে। বাস্তুবিচার ঠিকঠাকমতো করতে গেলে বাড়িতে কিছু ছোট ছোট আগাছা বাদে আর তেমন কোনো গাছ রাখা যাবে না। বইটির আরও কিছু অংশ পড়ে যে অপরিসীম জ্ঞান অর্জন করলাম, তাতে লেখক শ্রীমানের বাড়িখানা কেমন হতে পারে তা কল্পনা করেই হাসি পেলো। লেখকের নামটা বাঙালি পাঠকের জেনে রাখা ভালো, কারণ ভারতের বাঙালিদের তিনি যে অশেষ উপকার করে চলেছেন, অচিরেই তা বাংলাদেশেও প্রবেশ করতে পারে। বাংলা ভাষায় লেখা এই বইটির গোটা পাঁচেক সংস্করণও বেরিয়ে গেছে, বইয়ের আকারও বেশ বড়ো। লেখকের নাম হলো শ্রীমত্ স্বামী ১০০৮ ছোবলানন্দ গিরিভূমি মহারাজ। পাঠক ভাববেন না আমি চ্যাংড়ামো করছি, লেখকের নাম সত্যি সত্যিই ছোবলানন্দ। রামকৃষ্ণ মিশনের এক সন্ন্যাসীর কাছে একবার জেনেছিলাম, সন্ন্যাস নেওয়ার পরে তাঁদের নতুন একটি নাম দেয়া হয় এবং সন্ন্যাসীর চেষ্টা থাকে সেই নামকে সার্থক করে তোলা। এভাবেই বিবেকানন্দ, স্বরূপানন্দ, প্রণবানন্দ প্রভৃতি সন্ন্যাসীর নাম স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কিন্তু এ হলো ছোবলানন্দ, তার আগে আবার এক হাজার আট রয়েছে! ছোবলা আর ছোবড়া শব্দদুটো প্রায় এক অর্থেই ব্যবহূত হয়, যার মানে হলো পরিত্যক্ত অংশ বা আবর্জনা; যেমন আখের ছোবলা। আবার ছোবল মারা থেকেও ছোবলা হতে পারে। তাই ছোবলানন্দ নাম সার্থক করতে হলে হয় দুনিয়াকে যত পারা যায় ছোবলা উপহার দিয়ে যেতে হবে, না হয় এলোপাতাড়ি ছোবল মেরে মেরে মানুষের বারোটা বাজানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। বইটার আরও কিছুটা পড়ে লেখকের নামের সার্থকতা চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে ভেসে উঠল। সত্যি কী নিষ্ঠা সহকারে বাঙালিদের কমন সেন্সের ওপর তিনি ছোবল মেরে যাচ্ছেন।

এত যে কুসংস্কার আর যৌন জীবনের হৈচৈ, এই কিন্তু ভারতীয় বাঙালিদের সব পরিচয় নয়। খুবই অবাক করা সংযমের মধ্যেও রয়েছেন এমন অনেক নারী ও পুরুষ, যারা জীবনে কোনোদিন বিপরীত লিঙ্গের কাউকে ছুঁয়েও দেখেননি, ছুঁয়ে দেখার চেষ্টাও করেন না। বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠে গিয়ে এ রকম বেশকিছু সন্ন্যাসী সামনা সামনি দেখলাম। জগতের সেবা করাই নিজেদের পারলৌকিক মুক্তির পথ বলে এঁরা বিশ্বাস করেন। নিজের সমস্ত সহায়-সম্পত্তি এঁরা স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে এসেছেন। এঁরা লেখাপড়া করেন; স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন, হাসপাতাল চালান, ত্রাণ সাহায্য করেন, আবার ভিক্ষাও করেন। বেলুড়ের প্রায় সব সন্ন্যাসীই ইংরেজিতে চমত্কার দক্ষ। অনেকে ফিজিক্স, ক্যামেস্ট্রি, ম্যাথমেটিক্স, মেডিকেল সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইসিটি, চারুকলা, সংগীত প্রভৃতিতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান রাখেন। এই সন্ন্যাসীদের পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান হলো রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার। এটিতে যারা একবার ঘুরে এসেছেন, তারা জানেন বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁদের মানের ধর্ম-সংস্কৃতি ও কলাবিদ্যার গবেষণা হয় না। এ পর্যন্ত পড়ে অনেকে হয়তো ভাবছেন, অতিশয়োক্তি করছি। একটা উদাহরণ দিই, তাহলে সংশয় কিছুটা নিরসন হতে পারে। ১৯৩৭ সালে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার ‘কালচারাল হেরিটেজ অব ইন্ডিয়া’ নামক কয়েক খণ্ডের একটি বিশাল কোষগ্রন্থ বের করে। সবগুলো খণ্ডই ইংরেজিতে; সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, দর্শন প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে এক বা একাধিক খণ্ডের গ্রন্থ বের হয়। স্ব স্ব বিষয়ে ভারতের বিখ্যাত পণ্ডিতরা এর এক-একটি খণ্ড সম্পাদনা করেছিলেন। সাহিত্য খণ্ডের সম্পাদক কে তা শুনে রাখা ভালো : স্বয়ং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটি মাত্র ২০০৯ সালে এই জাতীয় একটি কাজ করতে পেরেছে। আরেকটি উদাহরণ দিই; এই সন্ন্যাসীদের একটি বাংলা পত্রিকা রয়েছে, নাম উদ্বোধন। মাসিক এই পত্রিকাটি গত একশত সতেরো বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে, গ্রাহক সংখ্যা প্রায় আশি হাজার। এছাড়া ভারততত্ত্ব, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন সম্পর্কিত যেসব আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা এই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা করে চলেছেন, তার সাথে তুলনীয় কোনো প্রকাশনা আমাদের অ্যকাডেমিক জগতের পণ্ডিতরাও করতে পারেননি। যদি প্রশ্ন করি, বাংলাদেশের কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কি দেশ, সংস্কৃতি, শিল্পকলা কিংবা দর্শন নিয়ে অ্যাকাডেমিকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি কাজও করেছে, কিংবা উদ্বোধনের মতো এমন অসাধারণ একটি বাংলা পত্রিকা? নিজ ধর্মের প্রাচীন ঢোলটি নির্মমভাবে পেটানোই কি আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একমাত্র ব্রত হয়ে থাকবে?

সত্যি বলতে কি জ্ঞানচর্চার প্রায় সব ক্ষেত্রে ভারতীয় বাঙালিরা বাংলাদেশি বাঙালিদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ অবশ্য এই নয় যে আমরা অলস, খাটাখাটনি করতে চাই না। এর মূল কারণ হলো আমাদের খাটাখাটনি করার তেমন উপায় নেই, প্রতিষ্ঠান নেই, নেই তেমন পৃষ্ঠপোষকতাও। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতের টাকি নামক স্থানে একটি লাইব্রেরিতে প্রবেশ করি। দেখলাম সেখানে ব্রিটেনিকা বিশ্বকোষের সর্বশেষ সংস্করণ অর্থাত্ ২০১৩ সালের সংস্করণটি রয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সেখানে বিশ বছর আগের কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া বিনামূল্যে হয়তো কেউ খয়রাত দিয়েছিল, ধুলোমলিন হয়ে সেটিই রেফারেন্স সেকশনে পড়ে আছে। বছর দশেক আগে একবার খুলনা শহরের বিভাগীয় লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কোনো পত্র-পত্রিকা আছে কিনা দেখতে। খুব অনুরোধ করার পর লাইব্রেরির একজন কর্মচারী পান খেতে খেতে অতিজীর্ণ ও ধুলোয় তলিয়ে যাওয়া একটি পত্রিকার ফাইল এনে টেবিলের পরে ফেললেন। সেটি খুলে বেশকিছু ছেঁড়া আধাছেঁড়া ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার টুকরো পেলাম। যেগুলো একটার সাথে একটা জুড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলাম যে, পত্রিকার পাতাগুলো পাপর ভাজার মতো হয়ে গেছে, যেখানে ধরছি সেখান থেকে খুলে আসছে। বাংলাদেশে তখন চারটে মাত্র বিভাগ, তার একটির সবচেয়ে অভিজাত লাইব্রেরিতে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত ওই মাত্র কয়েক পাতা ‘দলিল’ তখন ছিল। আশঙ্কা করি দশ বছর আগের সেই পাপর ভাজাগুলো এতদিনে ছাতুতে পরিণত হয়েছে। টাকির ওই লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ার চেয়ে বিষণ্নতাই ভর করল বেশি। দেখলাম, তাঁদের রেফারেন্স রুমে সংগ্রহ করে রাখা রয়েছে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই, পত্রিকা ও সাময়িকী। অনেকগুলো পত্রিকা দেখলাম ব্রিটিশ আমলের। মনে হলো, ব্রিটিশের অধীনে তো আমরাও ছিলাম, আমাদের কয়টি দলিল এমন সংগ্রহ করে রাখা আছে। বাংলাদেশের থানা বা জেলা শহরের লাইব্রেরি কথা বাদ দিলাম, বিভাগীয় এমনকি কেন্দ্রীয় কোনো লাইব্রেরিতে কি এসব সংগ্রহ রয়েছে? ঢাকার যে দু-একটি লাইব্রেরিতে এলোমেলোভাবে এসব দলিল রয়েছে, তার অধিকাংশ তো পড়ারই উপযোগী নয়। বলে রাখি পশ্চিবঙ্গের টাকি শহরটি একটি থানা পর্যায়ের শহরও নয়; এর একদিকে মাত্র ভারত, পূর্বদিকে তাকালেই বাংলাদেশ দেখা যায়।

দলিল প্রসঙ্গে এসে খুব আশ্চর্য ধরনের একটি দুঃখের কথা মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের যে পনেরো খণ্ডের দলিল রয়েছে, তাতে মোটামুটি পনেরো হাজার মতো পৃষ্ঠা রয়েছে। এই দলিল যাঁরা সংকলন করেছিলেন, তাঁরা বিভিন্ন উত্স থেকে তিন লক্ষ পৃষ্ঠার মতো সংগ্রহ করেছিলেন। শোনা যায়, এর মধ্যে ওই পনেরো খণ্ড ছাপা হওয়ার পরে বাকি প্রায় দুই লাখ পঁচাশি হাজার পৃষ্ঠার দলিল রয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশের বিভিন্ন দপ্তরের সুধী বিশেষজ্ঞরা খুব চিন্তাভাবনা করে একটি উপায় বের করেন। দলিলপত্রগুলো প্রথমে বেশকিছু বস্তায় ভরা হয় এবং পরে জাতীয় জাদুঘরের একটি কক্ষে ফেলে রাখা হয়। না, দর্শকের দেখার জন্য ওগুলো জাদুঘরে নেয়া হয়নি, নেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বিশাল সংগ্রহটিকে নিয়ে একটি বিস্ময়কর জাদু দেখানোর জন্য! সেই জাদু ইতোমধ্যে দেখানো শেষ হয়ে গেছে, ফলে দলিলগুলো সব স্থায়ীভাবে গায়েব হয়ে গেছে। অমূল্য সেই দলিলগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেছে, সে প্রশ্নের উত্তর এখন আর কারও কাছে নেই।

মুক্তিযুদ্ধের মতো অসাধারণ ঘটনার দলিলের প্রতি যে জঘন্য অযত্ন আমরা দেখিয়েছি, তাতে জ্ঞানচর্চার প্রতি আমাদের আগ্রহের দিকটি বোঝা যায়। এইসব দলিল দিয়ে কমপক্ষে একশ খণ্ডের দলিল প্রকাশিত হওয়ার দরকার ছিল। আমার এই কথা যাদের কাছে অতিশয়োক্তি বলে মনে হচ্ছে, তাদের একটি ছোট তথ্য জানাই। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি এমন কোনো বিরাট রাজনৈতিক দল নয়; দু-একটি রাজ্য ছাড়া কেন্দ্রে তারা কখনো সরকার গঠন করতে পারেনি, নিকট ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনাও নেই। তবু শুধু কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে সেখানে বাইশ খণ্ডের দলিলগ্রন্থ বেরিয়েছে, যার এক-একটি খণ্ডের আয়তন হাজার পৃষ্ঠারও বেশি। ভারতের একটি রাজনৈতিক দলের দলিল যেখানে বাইশ খণ্ডের হতে পারে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া পৃথিবীর একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের দলিল মাত্র পনেরো খণ্ডের। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জঘন্য ওলট-পালট দেখে এখন অবশ্য এই ভেবে সান্ত্বনা পাই, পনেরোটা খণ্ড তবু তো রক্ষা করা গেছে। সব দলিলই যদি বস্তায় পুরে ফেলে দেয়া হতো, আমাদের কিইবা করার ছিল। 

পুরানো দলিল কীভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে হয়, তা দেখলাম কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। সেসব যত দেখেছি দেশের কথা ভেবে তত মন খারাপ হয়েছে। চল্লিশ বছরের পুরোনো সব দলিল সেখানে ফিল্ম করে রাখা রয়েছে। সেসব ডকুমেন্ট পড়তে চাইলে আপনার হাতে একটি ফিল্মের রিল ধরিয়ে দিয়ে একটি মেশিনের সামনে বসিয়ে দেবে। এরপর মেশিনটির সুইচ অন করে ছোট একটি হাতল ঘুরাতে থাকলে চোখের সামনে একটি স্ক্রিনে একের পর এক ডকুমেন্টগুলো ভেসে উঠবে। প্রয়োজন হলে আপনাকে এর একটি ডুপ্লিকেট কপিও তারা দিতে পারে। আমাদের দেশে লাইব্রেরির বই খোঁজা কখনো কখনো গরু খোঁজার চেয়েও বিরক্তিকর। বই খোঁজার জন্য আমাদের রয়েছে পুরোনো আমলের কিছু কার্ড ক্যাটালগ। সেখানে গিয়ে খুঁজে খুঁজে একটি বই পছন্দ হলো তো খোঁজ নিয়ে জানলেন, বইটি লাইব্রেরিতে পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেও কার্ড ক্যাটালগ রয়েছে, তবে সেগুলো এখন আর তেমন ব্যবহূত হয় না। কারণ, সমস্ত লাইব্রেরির সব বই আর ডকুমেন্টগুলো এখন একটি কম্পিউটার নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। লাইব্রেরির কম্পিউটারে গিয়ে চাহিদামতো বিষয়ে সার্চ দিলেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেই বিষয়ের উপর লাইব্রেরির যত বই বা প্রকাশনা রয়েছে, তা দেখিয়ে দেবে। সাথে সাথে কম্পিউটারে ওইসব বইয়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া যাবে, দেখা যাবে চ্যাপ্টার আউটলাইনও। এছাড়া বইটির লেখক, কল নাম্বার-সহ জরুরি প্রয়োজনের সবকিছু স্ক্রিন থেকে জেনে নিতে পারবেন। নির্দিষ্ট ফরমে বইয়ের নম্বরটা টুকে কাউন্টারে জমা দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে আপনার হাতে সেই বই এসে যাবে। এরপর ইচ্ছে হলে পড়বেন, ইচ্ছে হলে ফটোকপি করতে দিয়ে লাইব্ররির একপাশের কফিশপে বসে গলা ভিজিয়ে নেবেন। সত্যি বলতে কি, অন্য কোথাও না গিয়ে এই একটি লাইব্রেরিতে গিয়ে কাজ করে একজন ব্যক্তি বড়ো বড়ো বই লিখে ফেলতে পারবেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত প্রথম আলো ও সেই সময় উপন্যাসদুটির অধিকাংশ মালমশলা এই লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। যতবার এই লাইব্রেরিতে গিয়ে বসেছি, ততবার মনে হয়েছে আমরা কি পারি না এমন মানের মাত্র একটি লাইব্রেরিও করতে। এর জন্য কত টাকা লাগে, একটি শপিংমলের চেয়ে বেশি?

ভারতীয় অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মুখে বলতে শুনেছি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যত্ রয়েছে বাংলাদেশে। এটা ঠিক যে বাংলা ভাষা ভারতের একটি প্রাদেশিক ভাষা, ভারত রাষ্ট্রের মূল কারবার ও লেখাপড়া এই ভাষায় হয় না। কিন্তু কোটি কোটি লোক একটি ভাষা ব্যবহার করলেই আপনা আপনি সেই ভাষার সমৃদ্ধি ঘটে না। ফলে ভবিষ্যতের এই উজ্জ্বল আশাবাদের কথা মনে রেখেও প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশ কি এই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যথার্থভাবে প্রস্তুত হচ্ছে? অদূর ভবিষ্যতের কথা বাদ দিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতার শততম বছরেও কি এখানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি কিংবা শান্তি নিকেতনের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে? বছরে বছরে বাংলাদেশ ছয় শতাংশ হারে বড়োলোক হচ্ছে, প্রচুর দালান আর রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে চারদিকে। কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রসরতা, জ্ঞানচর্চার মান ও পরিমাণ, গবেষণা আর মননশীল চর্চা কি দালানগুলোর মতো প্রতিনিয়ত উঁচু হচ্ছে? তা যদি না হয়, তাহলে কি শুধু দৈবের উপর ভরসা করে আমরা আশা করতে থাকব? এমন আশাহীনতার কথায় খুব স্বদেশপ্রেমিকরা হয়তো রাগ করছেন, কারণ দেশে যে একধরনের উন্নতি হচ্ছে, তা তো চর্মচক্ষেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শুধু দালানের পর দালান, ব্রিজের পর ব্রিজ আর ব্যাংকে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা থাকলেই কি একটি জাতি বড়ো হয়?  

দিব্যদ্যুতি সরকার