রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৭

‘পিঙ্ক’, নারীর অধিকার এবং ‘নো’ | চিররঞ্জন সরকার

কোনও মেয়ের ‘না’-এর উপর জোর খাটানো যায় না। খাটাতে চাওয়াটা আসলে পৌরুষহীনতার প্রতীক। সেটাকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ভারতের আলোচিত ‘পিঙ্ক’ সিনেমায়। নিজের মত করে চলা, নিজের ইচ্ছের স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকা এটাই তো প্রত্যেক মানুষের আরাধ্য। এটা অবশ্য মানবাধিকারেরও মূল কথা। কারও ওপর খবরদারি, জোর-জবরদস্তি
করা যাবে না। কিন্তু আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা সারাক্ষণ পুরুষতান্ত্রিক জবরদস্তির শিকার। এই জবরদস্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কাহিনিই হচ্ছে ‘পিঙ্ক’।

সিনেমার মূল কাহিনী হচ্ছে, মিনল, ফলক আর অ্যান্ড্রেয়া দিল্লির মধ্যবিত্ত এলাকায় থাকে। তাদের নিজেদের মতো করে জীবন যাপন অনেকের চোখে লাগে। বাড়িতে ছেলে বন্ধুরা এলেই পড়শিরা ধরে নেয়, মেয়েগুলোর চরিত্র নিশ্চয়ই খারাপ। তিনবন্ধু একদিন আচমকাই ঝামেলায় ফেঁসে যায়। অল্পচেনা কিছু ছেলের সঙ্গে রিসোর্টে যাওয়ার ভুলটা করে ফেলে। বুঝতে পারেনি, ছেলেগুলো তাদের হেসে কথা বলা দেখে ‘সহজলভ্য’ বলে ভেবে নিয়েছিলো। ছেলেগুলোও বুঝতে পারেনি, মেয়েগুলোকে তারা সহজে ‘পাবে’ না। মূল্য দিতে হবে। জোর খাটানোর এক পর্যায়ে দলের পাণ্ডা এবং হোমরাচোমরা মন্ত্রীর ভাইপো রাজবীরের মাথায় মিনাল কাচের বোতল ভাঙে। এর পরেই শুরু হয় কঠিন অস্তিত্বের লড়াই, নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রাম, আইন-আদালত ইত্যাদি।

নিজের জীবন বাঁচাতে গিয়ে সমাজের কাছে কী কী জবাব দিতে হয় প্রত্যেক নারীকে, তা আদালত কক্ষে ফুটে উঠেছে। আদালতের সওয়াল-জবাবের এক পর্যায়ে আইনজীবী দীপক সেহগালের চরিত্রে রূপদানকারী অমিতাভ বচ্চন আসল কথাগুলো বলেন। ‘বেটি বাঁচাও’য়ের বদলে আমাদের ‘বেটা বাঁচাও’য়ে মন দেওয়া উচিত। মেয়েদের খাটো পোশাক দেখলেই ছেলেদের হামলে পড়তে ইচ্ছে করে। বেহায়া মেয়েগুলো তো শুনবে না! উল্টে নারী স্বাধীনতার বুলি কপচাবে। তারচেয়ে ছেলেদেরই সামলে রাখা ভালো। মদ খায়, এমন মেয়েদের দিকে না তাকালেই হলো। স্বাধীনভাবে থাকা মেয়ে মানেই ফাঁড়া। এদের নাগাল থেকে ছেলেদের আগলে রাখলে শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ঘটবে না হয়তো। আদালতে অমিতাভের গলায় এই সওয়ালগুলোই উঠে আসে।

আদালতে সবকিছুই প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু তার ফাঁকে কোথাও মানবিকতা জড়ানো থাকে। তিনটে মেয়ের কাছে কোনও প্রমাণ ছিলো না যে, টাকার বিনিময়ে তারা রিসোর্টে যায়নি। ছেলেগুলোকে ‘মানুষ’ ভেবে গিয়েছিলো। যে ছেলেদের একজন তাদের বন্ধুও বটে! ক্রমাগত দেহব্যবসার অভিযোগ শুনতে শুনতে ফলক বলে বসে, তারা টাকা নিয়েছে। বিচারক বোঝে, মেয়েটি পরিস্থিতির চাপ এড়াতেই মিথ্যে বলছে। পুরুষ মাত্রেই যে অসংবেদনশীল নয়, তার প্রমাণ মিনলদের বাড়িওয়ালা, অমিতাভ, ধৃতিমানের চরিত্রগুলো। ‘পিঙ্ক’ দেখতে দেখতে মনে পড়ে তনুর কথা। আফসানার কথা। পুরুষতান্ত্রিক লালসার শিকার আরও অনেকের কথা! মিনল, ফলক আর অ্যান্ড্রেয়ারা শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তনু-আফসানারা তা পারেন নি!

‘পিঙ্ক’ মানে গোলাপি। বাংলায় মানে করলে এমনটাই দাঁড়ায়। অর্থাৎ এক বিশেষ রংকেই বোঝায় এটা। সাধারণত এই ‘পিঙ্ক’ রংটির নানা অর্থ থাকলেও মূলত এটিকে মেলানো হয় নারী চরিত্রের সঙ্গে। একজন নারীর মানসিক শক্তি, তার সৌন্দর্য এবং তার মধ্যে থাকা প্রেমকে বোঝাতে এই ‘পিঙ্ক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, এর বাইরেও ‘পিঙ্ক’র’ সাংঘাতিক এক অর্থ আছে। যা চমকে যাবার মত। শহুরে জীবনে ‘পিঙ্ক’ মূলত একটি ‘স্ল্যাং ওয়ার্ড’ অর্থাৎ চলতি মুখের ভাষা। ‘পিঙ্ক’-এর ‘স্ল্যাং’ প্রয়োগের অর্থ জোর করে এবং নিষ্ঠুরতার সঙ্গে কোনও পুরুষাঙ্গ দিয়ে যোনিকে ক্ষতবিক্ষত করা।

‘পিঙ্ক’ একদিকে নারীদের জন্য যেমন গালাগাল তেমনি নারীশক্তি ও নারীর মধ্যে থাকা সৌন্দর্য এবং নারীর লড়াইকেও ব্যাখ্যা করে। তাই নারীদের নিয়ে সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতাকে ঘিরে এমন ছবির নামকরণে ‘পিঙ্ক’ শব্দটি অবশ্যই লাগসই। গোলাপি। যোনির রং। যেখানে অধিকার একমাত্র নারীরই। যেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী তার ‘পিঙ্ক’ সিনেমায় । এই সিনেমার বার্তাটা স্পষ্ট। নিজের শরীর, গোলাপি ঠোঁট, যোনির কমনীয়তা যেখানে অধিকার একমাত্র নারীরই। যদিও পুরুষ জাত্যাভিমানের চোটে নিজেদের অধিকারী মনে করে নেয়। দাবি চাপাতে থাকে। বোঝে না, মেয়েটি স্বেচ্ছায় রাজি না হলে ছেলেটির কোনও দাবিই ধোপে টিকবে না। একটি মেয়ে সে টিন এজার হতে পারে, তরুণী হতে পারে, ক্লাবে যেতে পারে, পার্টিতে যেতে পারে, পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে বসে মদ খেতে পারে, টাকার বিনিময়ে শরীর বেচতে পারে, কারও বিয়ে করা বউ হতে পারে-কিন্তু সে যদি উচ্চারণ করে নো-না, তাহলে সেটা ‘না’ই হবে, জোর করে এই ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করানো যাবে না, কোনও যৌনকর্মী হলেও, না।

কোনও স্ত্রী নিজের স্বামীকে বললেও, না। কোনও অধিকারেই নয়। ‘না’ বলবার অধিকার সর্বত্রই সব সময়ে সব মেয়েদের ছিল আছে-থাকবেই। এতদিন যা হয়েছে-হচ্ছে এখন আর হবে না। কোনো কারণেই হবে না কোনও অধিকারেই হবে না। শরীরের উপর অধিকার মেয়েদের নিজস্ব অধিকার। সেই অধিকার আইনে স্বীকৃত। নিজেদের শরীরের মালিক মেয়েরা নিজেরাই। একজন পুরুষের মতই তার নিজের শরীরের অধিকার। সেই অধিকারে হাত দিতে চাওয়াটাই অপরাধ।

‘পিঙ্ক’ সজোরে ঘোষণা করেছে শুধু মেয়েদের কোনও ট্যাবু, কোনও সামাজিক বদ্ধ সংস্কারের শিকলে আটকে রাখা যাবে না। চাকরি করা মেয়েকে একটা ঘর ভাড়া দেওয়া যাবে না? কয়েকজন মেয়ে মিলে একটা ঘরে বা একটা বাড়িতে অথবা ফ্ল্যাটে একসঙ্গে থাকবে, তাতেও সমাজের চোখরাঙানি। যদি ভাড়া বাড়ি বা ঘর বা ফ্ল্যাট জুটে যায় ভাল, তবুও আশেপাশে গুঞ্জন, ফিসফিসানি, কয়েকজোড়া চোখ অনুসরণ করে যাচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টা। কখন বেরোয়-কোথায় যায়- কি করে, অত রাত হবে কেন? কে পৌঁছে দিল- তারা কত রাতে ফিরল, কার সঙ্গে ফিরল -কোনও পুরুষবন্ধু আসে কিনা? সমাজের গোয়েন্দার চোখ সর্বত্র অনুসরণ করে। একই বয়সি কর্মরত ছেলেদের স্বাধীন ইচ্ছা কুর্নিশ পায়, তারা একা বা কয়েকজন একসঙ্গে থাকতে পারে, সমাজের কর্তাব্যক্তিদের কোনও কৌতূহলী চোখ উঁকি দেয় না।

ছেলেরা পানশালায় গেলে দোষ নেই, নাইট ক্লাবে হুমড়ি খেয়ে পড়লেও কোনও পাপ তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু একটি মেয়ে পানশালায় গেলে উদ্বেগে আছড়ে পড়বে সমাজ, ইস্ গোল্লায় গেল! নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে পেতে ব্যর্থ হলেই পুরুষরা চটে যায়। পুরুষতন্ত্রের জেহাদ সব সময়ই মেয়েদের বিরুদ্ধে। প্রথমেই একটি মেয়েকে চরিত্রহীন হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়। ধর্ষকের যুক্তি পুরুষের যুক্তি। ও খারাপ মেয়ে ও চরিত্রহীন মেয়ে কারণ ও পানশালায় যায়। তার মানে ও যদি আগের দিন বা পরের দিন মন্দিরে যেত তাহলেই চরিত্রবর্তী হয়ে যেত। তাহলে স্থান দেখে চরিত্র ঠিক হবে। ভালো না মন্দ! যদি দুপুরে কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা হয় তা হলে সে ভাল মেয়ে আর রাত দশটায় দেখা হলে মন্দ মেয়ে।

আইনজীবী দীপক সায়গলের (অমিতাভ বচ্চন) প্রশ্ন: তা হলে স্থান, কাল অনুযায়ী মেয়েদের চরিত্রের মান ঠিক হবে?

আদালতে আইনজীবী দীপকের অমোঘ উচ্চারণ-মেয়েটি বলেছে নো……ও। তবুও পুরুষটির হাত সাপের মতো সর্বাঙ্গ জড়াতে চাইছে। আত্মরক্ষায় বাধ্য হয়ে তখনও মেয়েটি বলেছে নো…..।

‘‘তাই মেয়েটি অপরাধী নয়। অপরাধী এই ছেলেগুলো।’’

হ্যাঁ, আইনজীবী দীপকের কথাগুলো মর্মার্থ আত্মস্থ করার সময় এসছে। শুধু আদালত চত্বরের মধ্যে নয়, ঘরে, পাড়ায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিসে, রাস্তায়, যানবাহনে, মেলায়, শপিংমলে, মার্কেটে, কফি হাউসে, সর্বত্র কোনও মেয়ে যদি বলে ‘নো’-সেই ‘নো’ মানে না। এর বিপরীতে আর কোনও শব্দ নেই। এটাই হোক শেষ কথা।

চিররঞ্জন সরকার, লেখক








Find Nobin Kontho on Facebook