ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অ্যালম্যানাক’, ‘পঞ্জিকা’ তারই হুবহু বঙ্গীয় রূপমাত্র নয়। ধর্মীয় আচারাদি ও দিনক্ষণের খুঁটিনাটি হিসাব মেলাবার প্রয়োজনে ব্যবহৃত এই পুস্তকটি কালের পরিক্রমায় কী করে সব ধর্মের বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল, সে কাহিনি কৌতূহলোদ্দীপক বৈকি। ‘পঞ্জিকা’ শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে সংস্কৃত থেকে। বাংলাভাষী অঞ্চলের বাইরে পঞ্জিকাকে বলা হয়ে থাকে ‘পঞ্চাঙ্গ’। কারণ বার, তিথি, নক্ষত্র, করণ ও যোগ—এই পাঁচ ‘অঙ্গ’ বা বিষয়ে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এখানে। বাংলা বছরের
শেষে গ্রামের জমিদারবাড়িতে কিংবা খোলা মাঠে পণ্ডিত মশাইরা হাতে লেখা পঞ্জিকা বা ‘পাঁজি’ পাঠ করে শোনাতেন ও গ্রহ-নক্ষত্রভিত্তিক জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী আসন্ন দিন কেমন কাটবে—দিতেন তার আগাম বার্তা। নতুন বছরের ব্রত-পার্বণ, কৃষিকাজে করণীয় বা ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচাল সম্পর্কেও থাকত দিকনির্দেশনা। সুতরাং বেশ আগে থেকেই পঞ্জিকা বাঙালির মানসে পাকাপাকি স্থান গড়েছে।
ওষুধ প্রস্তুতকারক ‘বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোং’ কতৃর্ক প্রকাশিত পঞ্জিকার অলংকরণ। ছবির নিচেই তাদের পণ্য ‘পানা সিরাপ’-এর উল্লেখ
ওষুধ প্রস্তুতকারক ‘বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোং’ কতৃর্ক প্রকাশিত পঞ্জিকার অলংকরণ। ছবির নিচেই তাদের পণ্য ‘পানা সিরাপ’-এর উল্লেখ
মুদ্রণযন্ত্র আসার আগে পঞ্জিকা সংকলনের কাজটি করতেন পণ্ডিতেরা। তাঁদের হাতে লেখা পঞ্জিকাও বিক্রি হতো তখন। প্রতিটির দর ছিল দুই আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এতে বিরূপ ফলও হয়—একেক এলাকার পণ্ডিতেরা একেক নিয়ম ও ধরনে পঞ্জিকা সংকলনের ফলে পঞ্জিকা তৈরির ক্ষেত্রে মতভেদ চূড়ান্তে পৌঁছায়। তাই আচার-অনুষ্ঠানে গোল বাঁধা প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
তো তারিখ নিয়ে নানা মুনির নানা মতের কারণে প্রশাসনিক কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটছিল। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাই বিভিন্ন এলাকার খ্যাতিমান পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ করে এনে একটি সর্বসম্মত পঞ্জিকা নির্মাণপ্রণালি বেঁধে দিলেন। পরবর্তীকালে পঞ্জিকাগুলো ওই বিধি মেনেই তৈরি হয়েছে। এ কারণে হাতে লেখা পঞ্জিকার মতো প্রথম দিককার মুদ্রিত পঞ্জিকাতেও ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমত্যানুসারে’ কথাটি নামপত্রে ঠাঁই পেত আবশ্যিকভাবে।
প্রথম মুদ্রিত বাংলা পঞ্জিকা কোনটি? এ নিয়ে আছে মতভেদ। গবেষক চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮১৮ সালে জনৈক রামহরি কর্তৃক প্রকাশিত ১৫৩ পৃষ্ঠার একটি পঞ্জিকার কথা উল্লেখ করেছেন। নগেন্দ্রনাথ বসু সংকলিত বিশ্বকোষ-এ আবার বলা হয়েছে, কলকাতার স্যান্ডার্স কোম্পানি হলধর বিদ্যানিধিকে নিয়ে পঞ্জিকা সংকলন করিয়ে ছাপিয়ে বের করেছিল। তবে এসব পঞ্জিকার কোনো সন্ধান আজ অব্দি মেলেনি। জোড়াসাঁকো নিবাসী জনৈক দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণ নামের এক ব্যক্তির সংকলিত ১২২৫ বঙ্গাব্দের পঞ্জিকাটিই এযাবৎ প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন বাংলা পঞ্জিকা। কলকাতা জাতীয় গ্রন্থাগারে এটি সংরক্ষিত আছে। কাকতালীয়ভাবে এর শেষে ‘প্রকাশকের নিবেদন’ অংশে লেখা হয়েছিল, ‘শ্রীযুক্ত রামহরি নাম হৃদয় মুঞ্চতেধাম ত্রিজগতে তিনি সারাৎসার। সেই পদ সেবা করি সম্পদ কামনা করি করিলাম পঞ্জিকা প্রকাশ।’
এই রামহরি কি সম্ভাব্য পঞ্জিকা-প্রকাশক সেই ব্যক্তিই কি না, তা অবশ্য অস্পষ্ট। তবে উদ্ধৃত অংশ থেকে একটা বিষয় বোঝা যায়, দুর্গাপ্রসাদ অর্থাগমের আশাতেই পঞ্জিকা সংকলনের কাজে হাত দিয়েছিলেন।
আগে যা ছিল প্রায় অলভ্য-দুর্লভ অথচ আবশ্যিক পুঁথি, মুদ্রণযন্ত্রের প্রসারে তা মূলত বটতলাকেন্দ্রিক বাঙালি প্রকাশকদের হাত দিয়ে জনসাধারণের অনেকটা হাতের নাগালে চলে এল। আর মুদ্রিত পঞ্জিকাসমূহ আগেকার হাতে লেখা পঞ্জিকার তুলনায় বেশি সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করে লেখা হয়েছিল। ফলে পঞ্জিকা বোঝার জন্য ‘মাতব্বর’ পণ্ডিতদের ডাকার দরকারও হ্রাস পেল ক্রমে ক্রমে। ছাপা পঞ্জিকার চাহিদা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে বেড়ে গিয়েছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। প্রথম দিকে শ্রীরামপুরের ‘চন্দ্রোদয় প্রেস’ থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকাটি কুশলী ছাপার মানের জন্য দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। হ্যালেডের বাংলা ব্যাকরণের হরফ-নির্মাতা পঞ্চানন কর্মকারের দৌহিত্র কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকার ছিলেন এই প্রকাশনালয়ের মালিক। পরে একাধিক প্রকাশনা সংস্থা পঞ্জিকা ছাপতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। জেমস লঙের হিসাব অনুযায়ী, স্যান্ডার্স কোম্পানি ১৮৪৬ সালে একটি পঞ্জিকা বের করেছিল, যার মুদ্রণসংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার কপি। তবে এর দশ বছর পর ১৮৫৬-তে তাদের পঞ্জিকা ছাপতে হয় বিশ হাজার কপি। জেমস লঙের তথ্যমতে, ১৮৫৭ সালে শুধু কলকাতা শহরেই বিক্রি হয়েছিল এক লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার কপি পঞ্জিকা। বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছিল পঞ্জিকার দামও। ১৮২৫-এ যে পঞ্জিকার দাম ছিল এক টাকা, তিরিশ বছর পর তার দাম দাঁড়ায় মাত্র দুই আনা।
তবে পঞ্জিকা-প্রকাশকদের মধ্যকার রেষারেষি কিংবা পাল্টাপাল্টি কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগও কম নয়। গুপ্তপ্রেশপঞ্জিকার প্রকাশক দুর্গাচরণ গুপ্ত ১২৯৫ বঙ্গাব্দের পঞ্জিকার ভূমিকায় অন্য পঞ্জিকার মুদ্রাকরদের সমালোচনা করে লিখেছিলেন, ‘কতিপয় বটতলার পঞ্জিকা ব্যবসায়ী আমার পঞ্জিকার ন্যায় সমুদয় বিষয়ই নকল করিয়াছেন এমনকি পঞ্জিকার আকার এরূপ করিয়াছেন যে তাহা গুপ্তপ্রেশ পঞ্জিকা বলিয়া ভ্রম হয়, সেটি আমার সৌভাগ্যের বিষয় বলিতে হইবে, কারণ যদি লোকে আমার অনুকরণ করিয়া প্রতিপন্ন হয়েন ইহা অপেক্ষা সুখের বিষয় আর কি আছে...’। অন্যদিকে, ১৮৯৬ সালে বাঙালি মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিধিবদ্ধ নিয়ম মেনে চান্দ্রমাসের হিসাব-নিকাশসংবলিত ও ধর্মীয় কর্তব্যের বিবরণসমৃদ্ধ বৃহৎমোহাম্মদীয়পঞ্জিকা প্রকাশ আরম্ভ করেন মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ। ওই বছর ১৮৪ পৃষ্ঠার পঞ্জিকাটির দাম ছিল তিন আনা। ছাপা হয়েছিল পাঁচ হাজার আট শ কপি।
বাংলা পঞ্জিকা যেমন ইংরেজি অ্যালম্যানাকের সীমা ছাড়িয়েছে, তেমনি নিছক ‘পঞ্চাঙ্গ’-এর ঘরানাতেও আটকে থাকেনি। সন-তারিখ ও ধর্মীয় আচারদির বিবরণ ছাপিয়ে অচিরেই এ পুস্তক ‘এক অঙ্গে বহু কিছু’ ধারণ করেছে। ১২৩২ বঙ্গাব্দের একটি পঞ্জিকায় দেখা যায় তখনকার ডাকমাশুলের তালিকা। পরে ট্রেন-স্টিমারের সময়সূচি থেকে শুরু করে রাশিফল, ডাকটিকিটের দাম, গঙ্গার জোয়ার-ভাটার সময়, ওজন-মাপের হিসাবনিকাশ, বাংলার বিখ্যাত জমিদারদের নামধাম—কত-কী-ই না স্থান পেয়েছে এখানে! এই নানাবিধ দরকারি-বেদরকারি জিনিস জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা অবশ্য ইংরেজ পরিচালিত ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত ডাইরেক্টরির মাধ্যমে বাংলা পঞ্জিকায় অনুপ্রবেশ করেছিল বলে কোনো কোনো গবেষকের ধারণা। ১২৭৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত নবপঞ্জিকার ভূমিকায় প্রকাশক আনন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমাদের এই পঞ্জিকাতে ইংরেজি ডাইরেক্টরির মতো স্ট্যাম্প আইনের সারমর্ম, রেজিস্টারি করার ফিঃ, রেলভাড়া, টেলিগ্রাফের কর, মিউনিসিপেল নিয়ম, জেলা কোটের নালিসের স্ট্যাম্প, ছোট আদালতের ডিস্ট্রীং বিধি, জজ, কালেক্টর, মুনসেফ, এশেসর, ওবরসিয়র, মেজেষ্টর, চিহ্নিত ও অচিহ্নিত কর্ম্মচারিদের মাসিক বেতনের হিসাব, ডাক্তারদিগের নাম, কোম্পানির কাগজের সুদের হিসাব, নানা দেশীয় ওজন প্রভৃতি অন্যান্য বিষয় সন্নিবেশিত করা হইয়াছে, ইহাতে ভরসা করি জনসমাজের প্রয়োজনীয় হইতে পারে।’
তবে ডাইরেক্টরিতে থাকত না পঞ্জিকার মতো সমসাময়িক নানান বিচিত্র সংবাদ বা স্বাস্থ্যসংক্রান্ত টোটকা। ১২৬২ বঙ্গাব্দে ‘ভার্নাকুলার লিটারেচর কমিটি’র প্রকাশিত পঞ্জিকায় মিলছে হাত-পা মচকে গেলে বেদনাস্থলে চোটের মাত্রা অনুযায়ী ছয়টি থেকে আটটি জোঁক লাগিয়ে দেওয়ার পরামর্শও। প্রথম বাঙালি হিসেবে রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেলুনে চড়ার সংবাদটি প্রকাশ পেয়েছিল বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে, ১২৯৮ বঙ্গাব্দের নৃত্যলাল শীলের পঞ্জিকায় বেলুনের একটি কাঠখোদাই চিত্রসমেত। আবার বিজ্ঞাপন, নিয়মকানুন বা এ রকম প্রচলিত কিছু নয়—১৩২০ বঙ্গাব্দের বৃহৎমোহাম্মদীয়পঞ্জিকায় পাওয়া যায় বাংলা বারো মাসের প্রতিটিকে নিয়ে চমৎকার এক পদ্য, এখানে কিছুটা উদ্ধৃত করছি:
‘বাংলা বর্ষের মাস বৈশাখ প্রথম/ সর্বত্র গ্রীষ্মের বটে পূর্ণ পরাক্রম।/ সুখদ বৈশাখ মাস যাহার সৃজন/ মজরে তাঁহার প্রেমে ওরে মূঢ় মন। [...] কার্তিকে হেমান্তগত দুরন্ত শিশির/ বঙ্গের সর্বত্র হয় প্রকোপ ব্যাধির/ না গর্জ্জে আকাশে মেঘ, নাহি বারিপাত/ ডাকহ আল্লাকে, যিনি অনাথের নাথ।’
সে কালের পঞ্জিকায় প্রকাশিত ছবিগুলোও ছিল কৌতূহলোদ্দীপক। বটতলার কাঠখোদাই শিল্পীদের কাজের বড় একটা অংশ মূলত পঞ্জিকা থেকেই উদ্ধার করা গিয়েছে।
ছিল মজাদার সব বিজ্ঞাপনও। সে কালের পঞ্জিকায় মুদ্রিত হওয়া বিজ্ঞাপনগুলো সেই সময়ের সামাজিক ইতিহাস রচনার জরুরি উপাদান বটে। জানা যাচ্ছে, প্রথম বিজ্ঞাপনসংবলিত পঞ্জিকার প্রকাশ ১৮৬৯ সালে। কবিরাজি-ভেষজ ঔষধপত্রের বিজ্ঞাপন উনিশ শতকের পঞ্জিকায় বেশি দেখা যায়। যেমন, ‘বাতবিজয়ী তৈল: সর্ব্বপ্রকার বাতনাশক পরীক্ষিত অব্যর্থ তৈল’, ‘সুবাসিত দন্তরক্ষকচূর্ণ: দন্ত শক্ত রাখিবার অব্যর্থ মহৌষধ’, ‘নেত্রসখা: চক্ষুরোগের মহৌষধ’ ইত্যাদি। কখনো রূপচর্চায় ব্যবহৃত সামগ্রীর চটকদার বিজ্ঞাপনও নজরে পড়ে: ‘ললনা সোহাগ কেশ তৈল’, ‘পাউডার ডি জেসমিন’ বা ‘লোমনাশক চূর্ণ’। মেলে গয়না, হাতঘড়ি, অস্ত্রশস্ত্র এমনকি ‘পকেট ফ্যান’-এর বিজ্ঞাপনও, যাতে গর্বিত ঘোষণা: ‘জার্ম্মান হইতে নূতন পকেটফ্যান আমদানি করিয়াছি। এই দারুণ গ্রীষ্মে বৈঠকখানা ও শুভবিবাহে ১টী পকেটফ্যান রাখিলে অন্য কোন পাখার আবশ্যক হয় না। মূল্য দুই টাকা, মাশুল ছয় আনা।’ শাকসবজি, বই কিংবা খেলাধুলার সামগ্রীর বিজ্ঞাপনও অতীতকালের পঞ্জিকায় দুর্লক্ষ্য ছিল না। সেকালের দুই ওষুধ-প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোং’ ও ‘ডি গুপ্ত অ্যান্ড কোং’ নিজেদের পণ্যের প্রচারের বাহন হিসেবে পেশাদার প্রকাশকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজ্ঞাপনময় পঞ্জিকা ছাপানো শুরু করেছিলেন। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, তখন পঞ্জিকা অদ্ভুত সব বিজ্ঞাপনের সমাহারের জন্য জনগণের কাছে কতটাই না আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।
বাংলা পঞ্জিকা মুদ্রিতরূপে প্রকাশের দু শ বছর (আনুমানিক) পূর্ণ হওয়ার বেশি দেরি নেই। কালের পরিক্রমায় বাঙালির অতীত ঐতিহ্যের মধ্যে যে কয়টি বিষয় টিকে আছে, পঞ্জিকা তার একটি। এখনো নতুন বাংলা বছরের শুরুতে পঞ্জিকা কেনার জন্য হুড়োহুড়ি কম নজর কাড়ে না। কেউ বলতে পারেন, পঞ্জিকা কুসংস্কার ও অচল সব রীতিনীতির একত্রবাস মাত্র। কিন্তু পঞ্জিকা যে বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের এক বিরাট দর্পণ—এ কথা তো ভোলার উপায় নেই।
পূর্ববঙ্গে পঞ্জিকা
সেই সময় পূর্ববঙ্গের প্রকাশনার মূল কেন্দ্র ঢাকা শহর থেকে মাত্র দুটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়েছিল। একটির নাম নবপঞ্জিকা। ছেপেছিলেন নবীনচন্দ্র দে
উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ থেকে পঞ্জিকা প্রকাশের প্রবণতা খুব সুলভ ছিল না। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকাগুলোই মূলত পূর্ববঙ্গের শহর-গ্রামের বাজার দখল করেছিল। পূর্ববঙ্গ-গবেষক মুনতাসীর মামুনের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়,সেই সময় পূর্ববঙ্গের প্রকাশনার মূল কেন্দ্র ঢাকা শহর থেকে মাত্র দুটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়েছিল। একটির নাম নবপঞ্জিকা। ছেপেছিলেন নবীনচন্দ্র দে। ছাপাখানার নাম ইস্ট বেঙ্গল প্রেস। বেরিয়েছিল ১৮৮৮ সালের মার্চ মাসের দশ তারিখে, ১২৮৭ বঙ্গাব্দের নতুন পঞ্জিকা হিসেবে। তবে কলকাতা বা বটতলা থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকার তুলনায় এর আকার ছিল বড়ই ক্ষীণ—২৫ পৃষ্ঠা। তাই দামও ছিল কম—দুই পয়সা মাত্র। এর মুদ্রণসংখ্যা অবশ্য অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। পঞ্জিকার আবশ্যিক বিষয় বাদে এখানে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ের বিভিন্ন যাত্রাপথে টিকিটের দামদর, ঢাকা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির স্টিমারের টিকিটের মূল্য, তখনকার ডাকমাশুল, মানি অর্ডারের নিয়ম ও ঢাকার বিশিষ্ট কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের প্রধানের নামধাম সংকলিত হয়েছিল।
এটি প্রকাশের ঠিক দশ বছর পর ১৮৯৮-তে ঢাকা থেকে ফতেজঙ্গপুরিয়াপঞ্জিকা নামে আরেকটি পঞ্জিকা মুদ্রিত হয়েছিল। এর সংকলক ছিলেন মদনমোহন বিদ্যাভূষণ। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল নবপঞ্জিকার তিন গুণ—৭৬ পৃষ্ঠা। দাম রাখা হয়েছিল চার আনা। মুদ্রণসংখ্যা ছয় শ। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো নির্ভেজাল আঞ্চলিকতা—এখানে কেবল বর্তমান শরীয়তপুর জেলার ফতেজঙ্গপুর অঞ্চল সম্পর্কিত তথ্য ও ওই এলাকা সংক্রান্ত জ্যোতিষ-বাণী ঠাঁই পেয়েছিল।
এই ফতেজঙ্গপুরের সঙ্গে পঞ্জিকার ঐতিহ্য জড়িত, এমন তথ্য দেওয়া হয়েছিল ১৯৪০ সালে পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে থেকে প্রকাশিত ভ্রমণ-গাইড বাংলায়ভ্রমণ-এর প্রথম খণ্ডেও: ‘পূর্ব্ববঙ্গের জ্যোতির্ব্বেত্তা ও পণ্ডিতগণের ইহা প্রধান কেন্দ্র ছিল। বহু পুরুষ ধরিয়া এখানকার জ্যোতিষীগণ পঞ্জিকা প্রকাশ করতেন এবং সমগ্র বাংলার পঞ্জিকার সময় গণনা এখানকার পঞ্জিকার সময় ধরিয়া করা হইত। জ্যোতির্ব্বিদদিগের পুরাতন মন্দির ও বাটী এখনও বর্ত্তমান।’
১৩২৭ বঙ্গাব্দে (১৯২২ সাল) বরিশাল থেকে বরিশালেরপঞ্জিকাশিরোনামে একটি পঞ্জিকা বেরিয়েছিল। এই পঞ্জিকার মধ্যে মোটাদাগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকাগুলোকে অনুকরণের প্রয়াস নজরে পড়ে। তবে দুটি বিষয় বেশ অভিনব, যা অন্য পঞ্জিকায় সচরাচর দেখা যায়নি—‘নৌকা গঠন’ ও ‘গঠনস্থান হইতে নৌকাচালন’। নদী বিস্তৃত জেলা থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকা বলেই কি এই দুটি বিষয়ের অবতারণা? কে জানে।
মুহিত হাসান
Find Nobin Kontho on Facebook