শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭

নজরুলের কারাজীবন

মত প্রকাশের অধিকার প্রত্যেক মানুষের আছে। সেই মত প্রকাশ হতে পারে কোনো লেখনির মাধ্যমে, রং-তুলির মাধ্যমে, নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে, নাটক-চলচ্চিত্রের সংলাপের মাধ্যমে অথবা হতে পারে কোনো বক্তৃতার মাধ্যমে। সভ্যতার শুরু থেকে নেতৃস্থানীয় শক্তিমান গোষ্ঠীর বিপক্ষে গেলেই তারা খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে যেত।
লেখক সম্প্রদায়ই সবচেয়ে বেশি রোষানলে পড়েছে রাজ-রাজড়াদের। ইতিহাসের সেইসব স্বেচ্ছাচারী, ক্রোধান্ধ, দাম্ভিক, অশিক্ষিত, লম্পট, নিপীড়ক ধর্মগুরু ও রাজন্যবর্গের নির্মম কাহিনিতে কতশত লেখকগোষ্ঠী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সভ্য সমাজ পর্যন্ত এ নির্যাতনের ধারা বদলায়নি, ধরন পাল্টেছে মাত্র। প্রাচীনকালে শাসকরা যে নিপীড়ন প্রকাশ্যে করত, একালে তা করা হয় কারান্তরালে। ক্ষমতাদর্পীরা লেখকদের নির্যাতন করতেন—কারাগারে নিক্ষেপ করে, অভুক্ত রেখে, শারীরিক নির্যাতন করে, অঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে, শুলে চড়িয়ে, আগুনে নিক্ষেপ করে, ভয়ংকর পশুর খাঁচায় নিক্ষেপ করে, স্লো পয়জনিং করে, ইলেকট্রিক শক দিয়ে, আঙুলে সূচ ফুটিয়ে, প্লাস দিয়ে হাত-পায়ের নখ তুলে, হাতুড়ি দিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলে, নোংরা খাদ্য দিয়ে, এসিডে শরীর ঝলসে দিয়ে, চামড়া কেটে লবণ-মরিচ ঘষে দিয়ে, নারীদের যৌন নিপীড়ন করে, দেশ থেকে বের করে দিয়ে, নাক-কান কেটে দিয়ে, হাতের আঙুল কবজি কেটে দিয়ে, চোখের পাপড়ি কেটে দিয়ে, আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে। সেই সঙ্গে লেখকদের রচনা বা গ্রন্থ নিষিদ্ধ, বাজেয়াপ্ত এবং আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হতো। সমাজপতিদের স্বপক্ষে থাকত অশ্লীলতার অভিযোগ, রাজদ্রোহ ও কালো আইন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজ রোষানলে পড়ে কত জগদ্বিখ্যাত মনীষীদের যে শাস্তি পেতে হয়েছে তার হিসাব নেই। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো মত প্রকাশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অনেক লেখকদের মৃত্যুর পরে প্রমাণ হয়েছে—তাঁর মত সটিক ছিল। রচনা ফিরে এলেও লেখককে আর ফিরে পাওয়া গেল না।

আইরিশ রাজা ‘গ্যালিভার ট্রাভেলস’-এর মতো হাস্যরস প্রধান রচনাকে অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ‘The Sun moves round The Earth’ নয়, ‘The Earth moves round The Sun’—এই বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কারের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপারনিকাস, ব্রুনো ও গ্যালিলিও ধর্মব্যবসায়ী যাযকদের ক্রোধের শিকার হয়েছিলেন। শিষ্যদের অনুরোধে গ্যালিলিও সেদিন ভুল স্বীকার করে বেঁচেছিলেন। গ্যালিলিও’র সত্য-মত আজো পৃথিবীতে বর্তমান। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে চীন দেশে কনফুসিয়াসের ওপর রাজশক্তি ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর অনুসারীদের জ্যান্ত কবর দিয়েছে। রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা হোমারের ‘ওডিসি’র ওপর খড়্গহস্ত হয়েছিলেন। জগত্খ্যাত সব লেখক-দার্শনিক—দান্তে, ম্যাকিয়াভেলি, ভলতেয়ার, মিলটন, তলস্তয়, ডারউইন, পাবলো নেরুদা, বরিসপাস্তর নাক, সলঝিনিত্ প্রমুখ যুগে যুগে দেশে দেশে রাজরোষ-কবলিত হয়ে নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগ করেছেন, নিক্ষিপ্ত হয়েছেন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। রোমান নৃপতি টাইবেরিয়ান তাঁর কাজের সমালোচনা করায় ইতিহাসবিদ কসডাসকে কারাপ্রকোষ্ঠে অভুক্ত রেখে তিলে তিলে হত্যা করেন। চতুর্থ লুই লেখক বোমারসের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে কারাগরে নিক্ষেপ করেন। টমাস পেইন তাঁর ‘মানুষের অধিকার’ শীর্ষক গ্রন্থের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কারের জন্য রোজার বেকন দশ বছর কারাগারে বন্দি ছিলেন। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হয়েছিলেন। হেমলক নামক বিষের পেয়ালা হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেন—‘I to die, you to live, which is better only God knows’। বার বার সতর্ক করে দিয়েও মত না পাল্টানোর জন্য গণিতবিদ হাইপেশিয়াকে প্রকাশ্যে পথে গির্জার যাজকরা সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে ছিঁড়ে ফেলে মৃত্যু ঘটান।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাস্ত করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাসহ সমস্ত ভারতবর্ষ দখল ও নিয়ন্ত্রণ করে। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রতিবাদী ধারার রচনা প্রকাশ হতে থাকে। প্রেস অ্যাক্ট দ্বারা তার কতগুলিকে সরকার বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। কখনো কখনো লেখকদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হতো এবং প্রকাশকগণও দণ্ডিত হতেন।

রাজশক্তি ব্রিটিশের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গ্রন্থ রচনার জন্য বহু সংখ্যক লেখকের রচনা ব্রিটিশরা এদেশে বাজেয়াপ্ত করে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—বালগঙ্গাধর তিলক, কবি মুকুন্দ দাস, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, সখারাম, গনেশ দেউস্কর, গিরিশ চন্দ্র, সৈয়দ আবু মুহম্মদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানবেন্দ্রনাথ রায়, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সৌমেন ঠাকুর, সোমনাথ লাহিড়ী, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। আবার বাজেয়াপ্ত না হলেও ইংরেজ সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন—এমন লেখক ও তাঁদের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি হচ্ছে—বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ, সধবার একাদশী, নবীচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ, প্রবাসের পথে, স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলী, অরবিন্দের ভবানীমন্দির, রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মেবার পতন ও রানা প্রতাপ ইত্যাদি।

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ও তাঁর রচনার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ছিল। কারণ একদিকে তাঁর রচনার গুণে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক সচেতনায় অন্যদের উদ্বুদ্ধকরণ। নজরুলের এই দুটি গুণই ব্রিটিশদের কাছে সবচেয়ে বড় দোষের ছিল। তাই তারা বারবার তত্পর হয়েছে নজরুলের কণ্ঠরোধ করার জন্য। ইংরেজরা কাজী নজরুল ইসলামের সর্বাধিক গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করে। কবির মোট ১২টি গ্রন্থের ওপর খড়্গহস্ত হয়েছিল সরকার। এছাড়া ছিল নবযুগ ও ধূমকেতু দুটি পত্রিকা। তবে চূড়ান্তভাবে ৬টি বই বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ হয় এবং বাকি ৬টি বই আদেশ জারির মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ না করলেও পুলিশ বইগুলোর কপি জব্দ করে হয়রানিমূলক ব্যবস্থা আরোপ করেছে। পুলিশ পত্রিকা দুটিকে তিন বার সতর্কবাণী উচ্চারণ করে জামানত বাজেয়াপ্তির মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়। এর জন্য কবিকে দুই বার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তারমধ্যে প্রথমবার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার জন্য প্রায় তিনি বছরাধিক কাল কারাগার ভোগ করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত অর্ধ সাপ্তাহিক ধূমকেতু বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় পত্রিকা। এত জনপ্রিয় পত্রিকা বাংলা ভাষায় আর দ্বিতীয়টি ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস রায়, বারীন্দ্রকুমার, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, পবিত্রকুমার, মুজফ্ফর আহমদ প্রমুখ গুণীজন ‘ধূমকেতু’ কে আশীর্বাদ করেছিলেন, স্বাগত জানিয়েছেন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ ধূমকেতুর ১২ নং সংখ্যায় নজরুল রচিত ৭৯ পঙিক্তর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হলে তিনি রাজরোষে পড়েন। বিভিন্ন মহলে আলোচনা হতে থাকে যে, ‘ধূমকেতু’ ও তার সারথী নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সরকার শীঘ্রই ব্যবস্থা নেবে। নজরুলের কানেও এসব খবর আসতে থাকে। তিনিও উপলব্ধি করেন হাতে আর সময় নেই। বিলম্বে বিফল হতে পারে ধূমকেতুর আরাধ্য কাজ। তাই পরের ১৩শ সংখ্যাতেই প্রকাশ করলেন তিরিশ কোটি ভারতীয়ের প্রাণের দাবি, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি। কিন্তু শাসকরা নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করল স্বাধীনতার দাবি ঘোষণার মাধ্যমে বিদ্রোহ করার জন্য বা রাজদ্রোহের অভিযোগে নয়, পূর্ববর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য। কবিতার প্রথম ও শেষের কয়েকটি লাইন তুলে ধরা হলো—

‘আর কতকাল থাকবি বেটি ঢেলার মূর্তি আড়াল?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল।

দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি, ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,—আসবি কখন সর্বনাশী?

....            ...        ...         ...      ...

....            ....            ....            ...             ...

সেই দিন জননী তোর সত্যিকারের আগমনী

বাজবে বোধন-বাজনা সেদিন গাইব নব জাগরণী।

‘ময় ভুখাহুঁমায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী

কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা-দুলালী কন্যা অয়ি!

আয় উমা আনন্দময়ী।’

ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ১২৪ এ ধারা অনুসারে ৮ নভেম্বর ১৯২২ তারিখে পুলিশ নজরুলকে গ্রেফতারের জন্য ওয়ারেন্ট নিয়ে যুগপত্ ‘ধূমকেতু’ কার্যালয় ও প্রেসে তল্লাশি চালায়। তাঁকে না পেয়ে পত্রিকার ১২শ সংখ্যার যে কয়টি কপি পায় তা-ই নিয়ে চলে যায় পুলিশ। একই সময় পুলিশের অন্য একটি দল ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বাড়িতেও হানা দেয় এবং সেখান থেকে ধূমকেতুর মুদ্রাকর ও প্রকাশক আফ্জালুল হক সাহেবকে গ্রেফতার করে। সে-সময় গিরিবালা দেবী কন্যা আশালতাকে নিয়ে বিহারের সমন্তিপুরে তাঁর ভাইয়ের কাছে অবস্থান করছিলেন। নজরুল চারিদিকে ব্যাপক তল্লাশির মুখে পুলিশের নজর এড়িয়ে সমন্তিপুরে যান এবং সেখান থেকে সুদূর কুমিল্লা পৌঁছাতে পারলেও ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় থেকে পুলিশ লাইন অভিমুখী সড়কের মাঝামাঝি অংশে (বর্তমানে ঝাউতলা) কবি গ্রেফতার হন। তাঁর গ্রেফতারের সংবাদ শুনে তাঁকে দেখার জন্য লোক ভিড় করতে থাকে। অবস্থা সামলাতে প্রশাসন দ্রুত নজরুলকে কলকাতায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। কবির সাহসের তারিফ না করে উপায় নেই। কেননা যে পুলিশ বাহিনী তাঁকে গ্রেফতারের জন্য দেশময় চষে বেড়াচ্ছে, সেই পুলিশ লাইনের দিকেই কবি যাচ্ছিলেন। গ্রেফতারের দিনই তাঁকে চাঁটগা মেলে কলকাতা এনে মামলার কাজ শুরু করা হয়।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ নভেম্বর চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ইংরেজ কবি সুইন হোর এজলাশে নজরুলকে হাজির এবং ২৯ নভেম্বর শুনানীর দিন ধার্য হয়। নজরুলের পক্ষ সমর্থনে বেশ কয়েকজন আইনজীবি বিনা পারিশ্রমিকে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মলিন মুখোপাধ্যায় আদালতে নজরুলের পক্ষ সমর্থন করেন। মামলায় সাক্ষী সাবুদের দরকার পড়েনি। একই মামলার আসামী ও জামিনে মুক্ত নজরুলের বন্ধু, ধূমকেতুর মুদ্রাকর ও প্রকাশক আফজালুল হক এ মামলায় নজরুলের বিপক্ষে ‘সরকারী এপ্রুভার’ হয়ে সাক্ষ্য দেন। তিনি মামলার ক্ষতি বৃদ্ধি না ঘটিয়ে কেবল নিজের মুক্তির সুযোগ নিতে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। বিচারের সময় নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে যে বিবৃতি দেন, তা বাংলা সাহিত্যে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে পরিচিত। যা তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি রবিবার দুপুর বেলা রচনা করেছিলেন। অনবদ্য ভাষায় রচিত এ জবানবন্দিটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। বাংলা রাজনৈতিক সাহিত্যের ইতিহাসেও এটি বিশেষ উল্লেযোগ্য রচনা। দীর্ঘ জবানবন্দির সারকথা হলো—

‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী! তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।

এক ধারে রাজার মুকুট; আর ধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর জন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড। রাজার পক্ষে নিযুক্ত রাজবেতনভোগী রাজকর্মচারী। আমার পক্ষে-সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অনন্তকাল ধরে সত্য-জাগ্রত ভগবান।...

রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পেছনে রুদ্র। রাজার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য স্বার্থ, লাভ অর্থ; আমার পক্ষে যিনি তাঁর লক্ষ্য সত্য, লাভ পরমানন্দ।

...আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে-বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে যে-বাণী ন্যায়-দ্রোহী নয়, সত্য-দ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরাপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্য-স্বরূপ।”...

নজরুল তাঁর জবানবন্দি প্রদান করলেন। আইনজীবি তাঁর সুবিধামতো আইনি কর্তব্য সম্পাদন করলেন। জবানবন্দিটি আদালতে গৃহীত হলো না। ১৯ জানুয়ারি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো Swinhoe প্রহসমূলক মামলার রায় দেন। ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪-ক ধারা অনুযায়ী ‘ধূমকেতু’ রাজদ্রোহ মামলায় নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায়ের পর নজরুলের উকিল বিচারককে অনুরোধ জানান কারাগারে কবিকে বিশেষ শ্রেণির মর্যাদা দানের জন্য। বিচারক উত্তরে জানান যে, তার কোনো প্রয়োজন নাই। কেননা রাজনৈতিক বন্দিদের এমনিতেই বিশেষ শ্রেণির কয়েদি হিসেবে গণ্য করা হয়। রায় শোনার জন্য আদালতে বেশ ভিড় হয়েছিল। নজরুলকে যখন আদালত থেকে জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাঁর বন্ধুরা বিমর্ষ হয়ে পড়ছিলেন আর নজরুল তাঁদের  সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, ‘একটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে, হয়তো এ কারাবাসের প্রয়োজন ছিল।’ উল্লেখ্য, নজরুলের সেই ঐতিহাসিক জবানবন্দিটি ১২ মাঘ ১৩২৯ সালে ধূমকেতুতে প্রকাশিত হয়।

দণ্ডিত রাজবন্দি হিসেবে ১৬ জানুয়ারি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে নজরুল ইসলামকে প্রেসিডেন্সি জেলে রাখা হয়। জেলের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা অনুসারে পরের দিন ১৭ জানুয়ারি সকাল বেলা তাঁকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেখানে নজরুল বিশেষ শ্রেণির কয়েদির ব্যবহার পান। বিশেষ শ্রেণির কয়েদিদের বাড়ির মতো পোশাক পরতে দেওয়া হতো। খাওয়া-দাওয়া উন্নত তো ছিলই। তাছাড়া চিঠিপত্র লেখা ও দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ছিল। আর থাকার স্থান নির্দিষ্ট ছিল বম্ব ইয়ার্ডের পেছনের মহলে আকরম খাঁ, বাদশা মিঞা, চাঁদ মিয়া, শামসুদ্দিন প্রমুখ কারাবন্দির সঙ্গে। কিন্তু নিজের ডেরায় থাকার চেয়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘোরাঘুরি করেই নজরুল আনন্দ পেতেন। এভাবে কয়েকমাস নজরুলের আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে কাটল।

দেশে তখন আন্দোলন ছিল না। তাই বাংলার প্রাদেশিক সরকারকে দুষ্ট বুদ্ধিতে পেয়ে বসল। তারা ঠিক করল রাজবন্দিদের দু’ভাগে ভাগ করে হুগলী ডিস্ট্রিক্ট জেলে ও বহরমপুর ডিস্ট্রিক জেলে রাখা হবে। তাদের বেশির ভাগকেই সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে নামিয়ে হুগলী ডিস্ট্রিক্ট জেলে রাখা হবে, আর খুব অল্প সংখ্যক বিশেষ শ্রেণির কয়েদিরূপে রাখা হবে বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে। হুগলী ডিস্ট্রিক্ট জেলে যাদের পাঠানো হলো তাদেরও মিথ্যা বলা হলো যে, তারা বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় তারা গোলমাল করতে পারেন এটা ছিল জেল কর্তৃপক্ষের ভয়। তাদের পোশাক বদলানো হলো না, কিন্তু তাদের প্রত্যেককের হিস্ট্রিশিটে লিখে দেয়া হলো যে, এই কয়েদিকে সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে দেয়া হলো। বন্দিদের নিকট কিন্তু কথাটা গোপন রাখা হলো এবং পুলিশ গার্ডকেও বলে দেয়া হলো যে, নৈহাটি স্টেশনের আগে যেন তারাও কোনো কথা বন্দিদের না জানান। বলা বাহুল্য, নজরুল ইসলামকেও সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৪ এপ্রিল ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে নজরুলকে হুগলী জেলে স্থানান্তর করা হয়। নৈহাটি রেলওয়ে স্টেশনে তাঁকেও ট্রেন থেকে নামিয়ে ব্যান্ডেলের ট্রেনে চড়িয়ে হুগলীঘাট স্টেশনে নিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে নেয়া হলো। হুগলীঘাট রেলওয়ে স্টেশন খুব উঁচু ব্রিজের ওপরে অবস্থিত। তার তলায় পাশের দিকে হুগলী ডিস্ট্রিক্ট জেল। হুগলী স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়ালে জেলের সেই উঁচু দেয়ালের ওপর দিয়ে জেলের ভিতরকার অনেকখানি দেখতে পাওয়া যেত। জেলের ভিতর জিনিসপত্র ছুড়েও ফেলা যেত।

নজরুল যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে-সময় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সদ্য রচিত ‘বসন্ত’ নাটক নজরুলকে উত্সর্গ করেন। একই দিকে ম্যাডান থিয়েটারে ‘বসন্ত’ মঞ্চস্থ হয়। তিনি উত্সর্গপত্রে লিখেছিলেন—

                                                     উত্সর্গ

                                শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম   

                                                 স্নেহভাজনেষু

                                                ১০ই ফাল্গুন ১৩২৯

‘বসন্ত’ নজরুলকে আলীপুর জেলে পৌঁছে দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে জোড়াসাঁকোয় ডেকে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ সেখানে ভক্তজন পরিবৃত্ত হয়ে বসেছিলেন। পবিত্র বাবুকে তিনি বললেন, ‘‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উত্সর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।”

রবীন্দ্রনাথের উপস্থিত ভক্তরা সবাই খুশি হতে পারেননি এই উত্সর্গে। এটি সম্ভবত ঠাকুর পরিবারের বা ব্রাহ্মসমাজের বাইরে কাউকে রবীন্দ্রনাথের কোনো গ্রন্থের প্রথম উত্সর্গ। রবীন্দ্রনাথ একখানা ‘বসন্ত’-এ নিজের নাম দস্তখত করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তাকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’ সেদিন জেলখানার ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডার বিস্মিত হয়েছিলেন—‘টেগোর ঐ প্রিজনারকে বই ডেডিকেট করেছেন’ শুনে। আর নজরুল ‘বসন্ত’খানা তুলে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বুকে চেপে ধরেছিলেন।

শাহীনুর রেজা






Find Nobin Kontho on Facebook