বুধবার, ১২ জুলাই, ২০১৭

অদম্য কণ্ঠস্বর: মালালা ইউসুফজাই

মালালা ইউসুফজাই তখন পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার প্রধান শহর মিনগোরার একটি বিদ্যালয়ের ছাত্রী। উপত্যকাটি নিয়ন্ত্রণে ছিল তালেবান জঙ্গিদের। তাদের পরোয়ানা—মেয়েদের কোনো স্কুল চলবে না। কিশোরী মালালা তখন ছদ্মনামে দিনলিপি লেখেন রেডিওতে। প্রকাশ্যে কথা বলেন মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার অধিকার নিয়ে।

ছুটির পর স্কুলবাসে করে বাড়ি ফিরছিলেন মালালা। পথে দুই যুবক বাসটির গতিরোধ করে। একজন চালকের সঙ্গে কথা বলে। অন্যজন লাফিয়ে ওঠে বাসে। যুবকের এক হাতে একটা রুমাল নাকের কাছে ধরা, যেন সর্দিতে আক্রান্ত। যুবক ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের মধ্যে মালালা কে?’ কোনো উত্তর নেই। তবে প্রায় সবাই একযোগে তাকিয়েছিল মামালার দিকে। বুঝতে বাকি থাকে না। পিস্তল বের করে যুবক। হাত তাঁর কাঁপছিল। পরপর তিনটি গুলির শব্দ। মালালা ও তার দুই সহপাঠী গুলিবিদ্ধ। তবে মালার গুলি লেগেছে কপালের বাম পাশে। তাঁর অবস্থা গুরুতর। তিনি সহপাঠিনীর কোলে লুটিয়ে পড়েন। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আই অ্যাম মালালায় সহপাঠীদের বরাত দিয়ে এ বর্ণনা দিয়েছেন মালালা।
এই ঘটনার দুই বছর পর ২০১৪ সালের ১০ ডিসেম্বর মালালা যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার নিচ্ছিলেন তাঁর বয়স তখন ১৭। এত কম বয়সে এর আগে কেউ নোবেল পুরস্কার পায়নি। পুরস্কার হাতে নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম পশতুন ও পাকিস্তানি হিসেবে এ সম্মানজনক পুরস্কার পেয়ে আমি গর্বিত।...আমিই সম্ভবত প্রথম নোবেলজয়ী, যে কিনা এখনো ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হয়।’
মালালা সোয়াত উপত্যকার মেয়ে। যে উপত্যকাকে এক সময় বলা হতো ‘পাকিস্তানের সুইজারল্যান্ড’। রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। এ উপত্যকাতেই মালালার জন্ম ১৯৯৭ সালে। তখনো জায়গাটি ছিল শান্ত। পড়াশোনার দিক থেকেও দেশটির অন্য অঞ্চলের থেকে এগিয়ে। তবে সেখানে মেয়েশিশুদের উপেক্ষা করা হয় বরাবর। ছেলেশিশুর জন্ম হলে পরিবারের লোকজন আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে উৎসব করে। আর নবজাতক মেয়ে হলে সবাই চুপ মেরে থাকে।
মালালার ভাগ্য ছিল ভালো। তার স্কুলশিক্ষক বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই অগ্রসর চিন্তার মানুষ। শত দারিদ্র্যের মধ্যেও তিনি মেয়েকে পড়াশোনা করার উৎসাহ দিতেন। বাবার প্রতিষ্ঠা করা বিদ্যালয়ে যেতেন মালালা।
২০০৮ সালের শেষের দিকে তেহরিক-ই-তালেবানের স্থানীয় নেতা মোল্লা ফজলুল্লাহ ফতোয়া জারি করেন, সোয়াত উপত্যকায় নারীশিক্ষার যত প্রতিষ্ঠান আছে, এক মাসের মধ্যে বন্ধ করতে হবে। না হলে পরিণাম হবে ভয়াবহ।
সে সময় মালালা পশতুন লোকগাথার নায়িকা গুল মাকাই ছদ্মনামে বিবিসি উর্দুতে আবেগময় ভাষায় দিনলিপি (ডায়েরি) লিখতেন। সেই দিনলিপিতে মেয়েদের দুর্দশার কথা থাকত। বলা হতো, তালেবান জঙ্গিদের শ্যেন দৃষ্টি থেকে নিজেদের আড়াল করতে মেয়েরা কীভাবে স্কুলের ইউনিফর্ম না পরে সাধারণ পোশাক পরত।

নরওয়ের অসলোতে নোবেল পুরস্কার নিচ্ছেন এ যাবৎ কালের সর্বকনিষ্ঠ বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪একদিন গুল মাকাই তাঁর দিনলিপিতে লেখেন: ‘সামরিক হেলিকপ্টার ও তালেবানকে নিয়ে গত রাতে ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন দেখেছি। সোয়াতে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে এ ধরনের স্বপ্ন আমাকে বারবার তাড়া করছে।’
কিশোরী মালালা ছিলেন বিদ্যালয়ে যাওয়ার পক্ষে অনড়। তাঁর বয়সের সব মেয়ের শিক্ষার অধিকার আদায়ে বজ্রকণ্ঠ। ২০০৮ সালেই পেশোয়ারে প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে মালালা প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন। ‘তালেবানের সাহস কত যে আমার শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিতে চায়?’ বলেন তিনি। তোলপাড় শুরু হয়। তখনো অনেকেই জানতেন না, দিনলিপি লিখে নাম কুড়ানো গুল মাকাই আর মালালা অভিন্ন কিশোরী।
২০০৯ সালে স্কুলের শীতকালীন ছুটি শুরু হচ্ছে। গুল মাকাই তখন লিখছেন, ‘এ ছুটি নিয়ে মেয়েরা বেশি উৎফুল্ল নয়; বরং অজানা আশঙ্কা তাদের তাড়া করছে, যদি সত্যি তালেবানরা আর স্কুল খুলতে না দেয়! সেদিন বাড়ি ফেরার সময় বিদ্যালয়ের ভবনটির দিকে তাকাই, যেন আর ফিরে আসার সুযোগ পাব না সেখানে, যদিও আমি ভাবছিলাম, ছুটি শেষে আবার ঠিকই খুলবে।’
গুল মাকাই আরও লিখছেন: ‘আমার বাবা বলেছেন, সরকার আমাদের বিদ্যালয় রক্ষা করবে। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। আমি প্রথমে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। এখানে সোয়াতে প্রতিদিন শুনতে পাই, কোথায় কোথায় কত কত সেনাকে হত্যা করা হয়েছে আর অপহরণ হয়েছে আরও কতজন। কোথাও পুলিশের টিকিটিও নেই।’
গুল মাকাইয়ের নানা আশা-আশঙ্কার এসব কথা বিবিসির ইংরেজি ওয়েবসাইটে প্রকাশ হয়। বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো এই অনামা কিশোরীর প্রতি কৌতূহলী হতে শুরু করে। তাঁর দিনলিপি খবরের মর্যাদা লাভ করে। বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে এ দিনলিপি নিয়মিত পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকে। ছোট্ট এক কিশোরীর কণ্ঠে কী দুঃসাহস, কী প্রবল আত্মবিশ্বাস।

২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুর আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার ‘অ্যাওয়ার্ড ফর চিলড্রেন পিস প্রাইজ’ লাভ করেন মালালা। একই বছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি ‘ন্যাশনাল পিস অ্যাওয়ার্ড ফর ইয়ুথ’ তুলে দেন মালালার হাতে। এসব স্বীকৃতি মালালাকে আরও দুর্বার করে তোলে।

২০১২ সালে হাটে হাঁড়ি ভাঙেন মালালা। তিনি আবির্ভূত হয় স্বনামে। পাকিস্তানের খ্যাতিমান সাংবাদিক হামিদ মির তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। টেলিভিশনে তা সম্প্রচারিত হয়। মালালা জানান, তিনিই গুল মাকাই। মুহূর্তে গণমাধ্যমের প্রচারের আলো এসে পড়ে সোয়াতের এই কিশোরীর ওপর। আর এটাই কাল হয়। তালেবানের চক্ষুশূল হন মালালা।

২০১২ সালের ৯ অক্টোবর বাসের মধ্যে সেই গুলির ঘটনা মালালার একপ্রকার নিয়তিই ছিল। যেভাবে বুলেটবিদ্ধ হয়েছিলেন, বাঁচার কথা ছিল না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে নিজ দেশের সামরিক হাসপাতালে মালালার অস্ত্রোপচার হয়। তবে সংজ্ঞা ফেরেনি। এরপর তাঁকে নেওয়া হয় যুক্তরাজ্যে। সেখানে তাঁর শারীরিক অবস্থার প্রতিদিনের খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার হতে থাকে গণমাধ্যম। সারা বিশ্বের অগুনতি মানুষের রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা।

যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে সংজ্ঞা ফেরে মালালার। আট দিন কোমায় থাকার পর চোখ মেলে তিনি দেখেন কতগুলো অপরিচিত মুখ। তিন মাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া মালালা ভিন্ন এক কিশোরী। গোটা বিশ্ব তাঁর দিকে তাকিয়ে। সোয়াতের গুল মাকাই হয়ে উঠেছেন বিশ্বের নানা দেশের নানান সংস্কৃতির কোটি মেয়ের প্রেরণার উৎস।

সে বছর টাইম সাময়িকীর সবচেয়ে প্রভাবশালীদের তালিকায় নাম ওঠে মালালার। একই বছর তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ আই অ্যাম মালালা প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয় এ বই।

মালালা সোয়াতে ফিরে যাননি। যুক্তরাজ্যে সপরিবারে আশ্রয় মেলে তাঁর। পড়াশোনার ব্যবস্থাও হয়। তিনি এখন নারী মুক্তির দূত। জাতিসংঘে ভাষণে তিনি বলেন, এক শিশু, এক শিক্ষক, একটি বই, একটি কলম পারে দুনিয়াকে বদলে দিতে।

২০১৩ সালেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন মালালা। পরের বছর পুরস্কারটি তিনি লাভ করেন।

নোবেল ভাষণে তিনি বলেন, ‘...আমার সামনে খোলা ছিল দুটি পথ। একটি হলো: চুপ করে থাকা আর খুন হওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করা। দ্বিতীয়টি হলো: কথা বলা এবং এরপর খুন হওয়া। আমি দ্বিতীয় পথ ধরি।...আমি আমার গল্প বলি, এ জন্য নয় যে তা অনন্য; বরং এমনটি নয় বলেই বলি। এ গল্প বহু মেয়ের।...এই যে কথা বলছি, এ আমার নয়, এ হলো শিক্ষাবঞ্চিত ৬ কোটি ৬০ লাখ মেয়ের কণ্ঠস্বর।’

মালালা এখন ১৯। সারা বিশ্বের অত্যন্ত পরিচিত এক নাম। অনেক বেশি প্রভাবশালী, অনেক বেশি অনুপ্রেরণাদায়ী। জাতিসংঘ তাঁর জন্মদিনকে মালালা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

মিজান মল্লিক: কবি ও সাংবাদিক