জাতীয় সংসদ বিটে দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক কাজ করার সুবাদে অনেক খবরই না খুঁজলেও অনেক সময় হাতে এসে পড়ত। পড়ে সেসবই অনেক আলোচিত সংবাদ হয়েছে। দীর্ঘদিন সংসদ বিটে আলোচিত অনেক রিপোর্ট করা এবং সংসদ সচিবালয়ের সকলের সঙ্গে সম্পর্কের কারণেই এসব সম্ভব হতো। কখনো অনেক অনুসন্ধানী খবরের সূত্র হয়েছেন স্পিকার নিজেই। আবার কখনো
সংসদ ভবনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা তথ্য দিয়েছেন অনেকটাই গোপনে। ওই সময় তথ্য অধিকার আইন না থাকায় তথ্য গোপনীয়তার সংস্কৃতি ভাঙা কঠিন ছিল। ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরেই অনেক খবরের তথ্য আসত।
সংসদ ভবনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা তথ্য দিয়েছেন অনেকটাই গোপনে। ওই সময় তথ্য অধিকার আইন না থাকায় তথ্য গোপনীয়তার সংস্কৃতি ভাঙা কঠিন ছিল। ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরেই অনেক খবরের তথ্য আসত।
এভাবেই একদিন সংসদ সচিবালয়ের একজন অফিস সহকারী এক মজার তথ্য দেন। তথ্য অনুসারে সংসদের জন্য ৬টি লিফট এনে দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। তাঁর তথ্য অনুসারে লিফটগুলো নিম্নমানের। এই সূত্র ধরে রিপোর্টের অনুসন্ধানপর্ব শুরু হয়। সেটি ২০১০ সালের জুলাই মাসে। খবর নিয়ে জানা যায়, ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ২৭ জুলাই পূর্তবিভাগ এসব লিফট প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। তড়িঘড়ি করে তিন মাসের মধ্যে কোরিয়ায় তৈরি ৬টি লিফট আমদানির জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। আর লিফট কেনার সুযোগে পূর্ত অধিদপ্তর এবং সংসদ সচিবালয়ের একদল কর্মকর্তা কোরিয়া সফর করে আসেন। লিফট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এবং অর্থায়নে লিফট পরিদর্শনের নামে এ সফর শেষ হয়। ওই সময় সংসদের স্পিকার ছিলেন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। তিনিও এসব জানতেন না বলে পরবর্তী সময়ে জানা যায়। পরে ২০০৯ সালে নতুন সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন বর্তমান রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। বিপত্তি শুরু হয় তখন থেকেই। লিফট আমদানি হলে তা স্পিকারকে কেউ জানানোর সাহস না পাওয়ায় দিনের পর দিন লিফটগুলো পড়ে থাকে।
না জানানোর মূল কারণ ছিল, সংসদ ভবনের মতো ভিভিআইপি স্থাপনায় এ ধরনের লিফট লাগানো হবে কি-না। কারণ, সংসদ ভবনে থাকা ১৯টি লিফটের সবগুলোই জার্মানির তৈরি। ১৯৭৫ সালে এই লিফটগুলো লাগানো হয়। এরপর ২০০৪ সালে চারটি লিফট প্রতিস্থাপন করা হলেও এর সবগুলোই ছিল জার্মানির। কিন্তু এবার কোরিয়ান লিফট আনার যুক্তি হিসেবে বলা হয়, দাম কম বিবেচনায় এগুলো লাগানো হচ্ছে।
রিপোর্টের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ওই সময়ে স্পিকার আবদুল হামিদের মন্তব্য জানতে তাঁর কাছে যাওয়া হয়। স্পিকারের কক্ষে লিফট কেনার এ খবর শুনে তিনি অনেকটা আঁতকে ওঠেন। বলেন, ‘সাংবাদিকরা জানে সংসদের জন্য লিফট কেনা হয়েছে, অথচ স্পিকার জানে না। তাহলে তো ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’ এ নিয়ে স্বভাবসুলভ রসিকতার মধ্যেই তিনি সংসদ সচিব এবং সংসদ সচিবালয়ে থাকা পূর্ত অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠান। শুরু হয়, সাংবাদিক হিসেবে বিব্রতকর এক ক্ষণ। আমার সামনেই তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর। সংসদ ভবনে জার্মানির লিফট লাগানোর স্পেশিফিকেশন থাকলেও কারা কোরিয়ান লিফট আনার নির্দেশ দিল? আর এ লিফট যে এসে গেছে বা সংসদে লাগানো হবে তা কেন এতদিন স্পিকারকে জানানো হয়নি? সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বিষয়টি তদন্তের জন্য কমিটি গঠনের নির্দেশ দিলেন।
সঙ্গে আমাকে বললেন, ‘ভালো কইরা রিপোর্ট করেন। লেখেন, স্পিকার জানে না অথচ সংসদে নিম্নমানের লিফট লাগানো হচ্ছে।’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) আমাকে সহায়তা না করলে আমি কিন্তু সামলাতে পারব না। কোটি কোটি টাকার খেলা তো, বুঝতেই পারছেন।’
এরপর ২০১০ সালের ৯ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলোতে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয় সেই খবর ‘সংসদের জন্য ৬টি লিফট, স্পিকার জানেন না’ শিরোনামে।
পত্রিকায় প্রকাশের পরদিন সকালেই বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছির ফোন। ‘কি ভাই, রিপোর্ট বলে ঠিক নাই, লিফট নাকি ভালো। মতি ভাইকে ফোন করেন, খেপে আছেন।’ সম্পাদক মতিউর রহমানকে ফোন করার সুযোগ হলো না। তার আগেই বেজে উঠল মতি ভাইয়ের ফোন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘কি মিয়া, কাগজপত্র ছাড়া, ভালো করে না বুঝে রিপোর্ট কেন করে দিলা। এটি ভুল হয়েছে।’ সম্পাদককে যতই বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু লাভ হয় না। বললেন, তাড়াতাড়ি অফিসে আসো। আমার বাসা তখন অফিসের কাছাকাছি পশ্চিম তেজতুরি বাজারে। সাড়ে ১১টার দিকে অফিসে এসে দেখি মতি ভাই খেপে আছেন। শুধু বললেন, ‘ওদের একটা প্রতিবাদ আসবে, যা লেখা থাকবে হুবহু দিয়ে দেবে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিবাদ এল। সঙ্গে এল একটি ফোন। এবার আমার কাছে অনেক কিছু খোলাসা হতে শুরু করেছে। যিনি ফোন করেছেন তাঁর এক আত্মীয় হলেন এ লিফটগুলোর আমদানিকারক। খ্যাতিমান ওই ব্যক্তিটি আবার মতি ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ। আমি বিনয়ের সঙ্গে ফোনকর্তাকে শুধু বললাম, আমি যা লিখেছি তার সব প্রমাণ দেওয়ার দায়িত্ব আমার। তবে আপনারা প্রতিবাদটি দিয়েছেন, সম্পাদক মহোদয়ের নির্দেশে তা ছাপা হবে। এরপর তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনার প্রতিবাদ পেয়েছি, ছাপা হবে। পরে আমি গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব। বেরসিক রিপোর্টার ভেবে ভদ্রলোক ফোন রেখে দিলেন।
পরদিন সেই প্রতিবাদ প্রথম আলোতে ছাপা হলো।
সংসদের খবর সংগ্রহে তখন প্রতিদিন সংসদ ভবনে যাই। যথারীতি প্রতিবাদ ছাপার দিনও গিয়েছি। ওই দিন গিয়েই শুনি, স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি) আমাকে খুঁজছেন। স্পিকারের দফতরে ঢোকার পরই সহাস্যে তিনি বলে উঠলেন, ‘কি, প্রতিবাদ দিলেই ছাপতে হবে নাকি সাংবাদিক সাহেব। দেশটা তাহলে চলবে কীভাবে? ঠিক কাজও করা যাবে না।’ ঘটনার কিছু অংশ বললাম তাঁকে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমি আমার মতো চেষ্টা করব। একদিকে অনিয়ম, অন্যদিকে ভিভিআইপিদের ঝুঁকির বিষয়টি আমি ছেড়ে দেবো না। এটি আমার কাজ এবং দায়িত্ব।’
এরপর তিনি তদন্ত কমিটির পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) লিফটগুলো দেখে এ সম্পর্কে রিপোর্ট নেওয়ার উদ্যোগ নিতে সংসদ সচিবকে নির্দেশ দিলেন। এ সংক্রান্ত সব খরচও যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে তাও জানিয়ে দিলেন। এরপর একের পর এক তদন্ত হতে লাগল। কিন্তু সংসদ ভবনে এ লিফট লাগানোর পক্ষে মত এল খুবই কম। ছাড়পত্রও পাওয়া গেল না। এভাবে চলে গেল প্রায় আরো দুই বছর। লিফটগুলো দীর্ঘদিন বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকায় সেগুলো নষ্ট হওয়ার উপক্রম হলো। স্পিকার অনড় নিম্নমানের কোনো লিফট তিনি গ্রহণ করবেন না। এভাবেই চলতে থাকল। নানাভাবে তারা স্পিকার আবদুল হামিদের সঙ্গে দেখা করা, তাঁর বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। স্পিকার স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘এটি দেখার কাজ এক্সপার্ট ইঞ্জিনিয়ারদের, স্পিকারদের নয়।’ এর মধ্যে ওই লিফট আমদানিকারক ব্যবসায়ীর খ্যাতিমান আত্মীয়ও বুঝে গেছেন, টাকা দিয়ে সব জায়গায় কাজ হয় না। সব রাজনীতিবিদদের কেনাও যায় না।
কিছুদিন পরে একদিন ডেকে মতি ভাইও (মতিউর রহমান) বললেন, ‘তোমার রিপোর্ট ঠিকই ছিল। ব্যবসায়ীদের আসলে বিশ্বাস করা কষ্টকর।’
লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক।
সেই আলোচিত রিপোর্ট
সংসদের জন্য ছয়টি লিফট স্পিকার জানেন না
আশিস সৈকত
জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদের অগোচরে সংসদ ভবনের জন্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা দামের ছয়টি নতুন লিফট আনা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে স্পিকার এসব লিফট প্রতিস্থাপনের কাজ আটকে দিয়েছেন। স্পিকারের চাহিদা কিংবা অনুমোদন ছাড়া কীভাবে সংসদ ভবনের জন্য এসব লিফট কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।
জানা যায়, গণপূর্ত অধিদপ্তরের কার্যাদেশ পেয়ে ‘মান বাংলাদেশ’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব লিফট আমদানি করে। এগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইতিমধ্যে ঢাকায় আনা হয়েছে।
স্পিকার আবদুল হামিদ গত সপ্তাহে গণপূর্ত অধিদপ্তরের শেরেবাংলা নগর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুবাস কুমার ঘোষসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠান। তিনি জানতে চান, সংসদ ভবনে লিফটের প্রয়োজনীয়তার কথা কে জানিয়েছে? এ বিষয়ে পূর্ত বিভাগের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি স্পিকার আবদুল হামিদ। তিনি সংসদ ভবনে লিফট প্রতিস্থাপনের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংসদ সচিবকে বলেন।
জানতে চাইলে স্পিকার আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে নতুন লিফট প্রয়োজন হলে সংসদ থেকে পূর্ত বিভাগকে বলা হবে। সংসদের পছন্দ অনুসারেই এসব লিফট প্রতিস্থাপন করতে হবে। কিন্তু গোপনে এভাবে সংসদের জন্য লিফট কেনা রহস্যজনক। বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে স্পিকার জানান।
স্পিকারকে না জানানো প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুবাস কুমার ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার বিষয়টি জানতেন। তবে বর্তমান স্পিকারকে বিষয়টি না জানানো ভুল হয়েছে। তাই স্পিকারের কাছে গিয়ে আমরা ভুল স্বীকার করেছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের যেকোনো কেনাকাটার আগে স্পিকারকে জানানো হবে।’
জানা গেছে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ২৭ জুলাই পূর্ত বিভাগের এক সমন্বয় সভায় ছয়টি ত্রুটিপূর্ণ লিফট প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এক মাস পর সেপ্টেম্বরে লিফট কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। একই বছরের ২৫ নভেম্বর লিফট কেনার জন্য গঠিত দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে মান বাংলাদেশ লিমিটেডকে দুই কোটি ২৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় লিফট আনার কার্যাদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোরিয়ার একটি কোম্পানি থেকে এ লিফট আনা হবে বলে দরপত্রে উল্লেখ করা হয়। আর এসব লিফট দেখাতে পূর্ত বিভাগের তিন জন কর্মকর্তা চলতি বছরের ২২ মার্চ কোরিয়া সফর করেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই এ সফরের আয়োজন করা হয় বলে জানা গেছে।
পূর্ত বিভাগ এত সব কাজ করলেও বিষয়টি রহস্যজনক কারণে গোপন রাখা হয়। প্রায় দেড় বছরেও বিষয়টি স্পিকারকে অবহিত করা হয়নি।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সংসদ ভবনে বর্তমানে থাকা ১৯টি লিফটের সব ক’টিই জার্মানির তৈরি। ১৯৭৫ সালে প্রতিটি ১৬০০ কেজি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এসব লিফট আনা হয়। এর মধ্যে বিগত বিএনপি সরকারের সময় চারটি লিফট প্রতিস্থাপন করা হয়। এগুলো ছিল জার্মানির তৈরি।
জার্মানি থেকে না এনে কোরিয়ার একটি কোম্পানির লিফট আনা নিয়েও সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সংসদ ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় কোরিয়ান লিফট লাগানোর উদ্যোগ নিয়েও কথা উঠেছে।
তবে সুবাস কুমার ঘোষ বলেন, আইন অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়েছে। এজন্য জার্মানির বদলে কোরিয়ার তৈরি লিফট আনা হয়েছে।