শেক্সপিয়র বলেছিলেন, ‘দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ হোরেশিও, দ্যান আর ড্রেমট/// অব ইন ইওর ফিলোসফি।’ স্বর্গ ও মর্ত্যে এমন অনেক কিছু ঘটে যা কিনা অতিবুদ্ধিমানের দর্শনও ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্রাচীন ভারতবর্ষে একধরনের যোগচর্চা হতো যা কিনা ঋষি-যোগীরা বছরের পর বছর ধরে ধ্যান আর সাধনা করে আত্মস্থ করতেন। তাঁরা মন, বুদ্ধি আর আত্মা এই তিন শক্তিকে
প্রয়োগ করে দেহকে বাতাসে পরিচালিত করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন, কখনো হতেন বাঘ, কখনো হরিণ। কখনো বা হিমালয়ের স্রোতস্বিনী নদীর জলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ইংরেজিতে একে বলা হয় গুংঃরপ ণড়মধ বা অলৌকিক যোগ। তুমি দেহসর্বস্ব নও। তুমি আত্মা, আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আত্মা অবিনশ্বর। এমন দর্শন সাধারণের পক্ষে ব্যাখ্যা বা ধারণ সম্ভবপর নয়।
প্রয়োগ করে দেহকে বাতাসে পরিচালিত করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন, কখনো হতেন বাঘ, কখনো হরিণ। কখনো বা হিমালয়ের স্রোতস্বিনী নদীর জলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ইংরেজিতে একে বলা হয় গুংঃরপ ণড়মধ বা অলৌকিক যোগ। তুমি দেহসর্বস্ব নও। তুমি আত্মা, আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আত্মা অবিনশ্বর। এমন দর্শন সাধারণের পক্ষে ব্যাখ্যা বা ধারণ সম্ভবপর নয়।
এই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। মহাত্মা গান্ধী যখন জেলে গেলেন, তখন গান্ধীর নির্যাতিত সমর্থকদের অত্যাচারে সমব্যথী এই লেখক অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলেন। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ভারত ছেড়ে ইংল্যান্ড চলে যাবেন। কিন্তু হঠাত্ এক মায়াময় যোগীর ইশারায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে হিমালয়ের পথে পা বাড়ালেন তিনি। মা ভাইকে ইংল্যান্ড যাবেন—এই মিথ্যা বলে ঘর ত্যাগ করলেন। সেই যোগীর কাছে তিনি অলৌকিক যোগের দীক্ষা নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেই মায়াময় চোখের যোগী তাঁকে কী করে বিভিন্ন ভয়াল, কণ্টকময় ঘটনাপ্রবাহ আর উদাহরণ হাজির করে অলৌকিক যোগের দীক্ষা দেন তার চমকপ্রদ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এই বইয়ে। তার সাথে হিমালয়ের সৌন্দর্যেও অবগাহন করেছেন এই লেখক। শেষপর্যন্ত লেখক অলৌকিক যোগের দীক্ষা নিয়ে , ভারত ছেড়ে ইংল্যান্ড গমনের পারমিট পান এবং ইংল্যান্ড চলে যান।
১৯২২ এবং ১৯২৩ সালের রাজনৈতিক গোলযোগের সময়, ভারতের জনসাধারণের প্রিয় নেতা মহাত্মা গান্ধী আটক হলেন। জেলের দেয়াল তাকে বিচ্ছিন্ন করলেও তার অহিংস আন্দোলন তার অনুসারীরা জোরেশোরেই চালিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে আকালি পার্টির লোকেরা গুরুদুয়ারায় গিয়ে প্রতিজ্ঞা করল যে, হিংসার বদলে হিংসার চেয়ে তারা নির্যাতন আর মৃত্যু সহ্য করবে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, সত্যের শক্তি একদিন জয় লাভ করবেই।
অহিংস নীতির প্রতি আমার সহানুভূতি ছিল, তাই তাদের নির্যাতন করলে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। আমার বন্ধু আমাকে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল, কারণ আমার বাড়িতে গান্ধীর অনুসারীদের অহরহ যাতায়াত ছিল। যে আমি জীবনে প্রতিজ্ঞা করেছি আদর্শিক জ্ঞান আর শান্তির পথে চলব, ভাবলাম দেশ ছেড়ে যাব না। অবশেষে আমি একজন মানসিক চিকিত্সকের কাছে গেলাম এবং আমার মনকে শান্ত করতে চাইলাম। অবশেষে ভারত ছেড়ে ইংল্যান্ড চলে যাব মনস্থির করলাম।
অফিসার আমাকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পারমিট দিবেন বললেন, কিন্তু সময় লাগবে বলে জানিয়ে দিলেন। পারমিট দেয়ার আগ পর্যন্ত দেশের এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। একদিন একটা ছায়া শীতল গাছের তলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুমিয়ে পড়লাম, স্বপ্নে বৃন্দাবন দেখতে পেলাম।
বৃন্দাবন, যেখানে মানবতার মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণ তার শিশুকাল কাটিয়েছিলেন। হঠাত্ কেউ যেন আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলো, আমি বসে পড়লাম এবং একজন সাধু আমাকে ইশারা করলেন। তিনি আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। তার সুন্দর চোখে তাকিয়ে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। তিনি আমাকে ডাকলেন, ‘বত্স্য, কী হয়েছে তোমার?’
আমি কিছু বলতে পারলাম না।
তিনি বললেন, ‘তুমি কি বৃন্দাবন যাবে?’
‘অবশ্যই যাব।’ অবশেষে আমি আমার জবান ফিরে পেলাম।
‘কিন্তু কে আপনি?’
‘আমি স্বয়ং আমিই।’
হঠাত্ বুঝতে পারলাম, অলৌকিকভাবে লোকটি জানে আমি কোথায় যাব।
বললাম, ‘আপনি জানলেন কী করে যে আমি বৃন্দাবন যেতে চাই!?’
তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি তা-ই ভেবেছিলাম। আমি জানি তুমি বৃন্দাবন যাবে এবং সেখানে তোমার সাথে আমার দেখা হবে।’ বলতে বলতে তিনি উঠে চলে গেলেন। চিন্তা করলাম, এই লোকটির সাথে আর দেখা হবে না, যার মায়াভরা দৃষ্টি দেখে ঈশ্বরপ্রদত্ত শান্তিতে মনে ভরে গেল আমার! মনের ভেতর থেকে কে যেন ধাক্কা দিলো। আমি সাধুকে জিজ্ঞেস করলাম যে, ‘আমাদের আবার কখন দেখা হবে?’
‘বত্স্য’ তার গলার স্বর পথের ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘বৃন্দাবনে তোমার সাথে অবশ্যই আমার সাক্ষাত্ হবে।’
তিনি চলে যাওয়ার পর বসে পড়লাম, কী করে উনি ঠিক বুঝে গেলেন সেটা ভেবে বিস্মিত হলাম।
বাড়িতে এসে মা আর ভাইকে বললাম, আমি এক সপ্তাহের মধ্যে ইংল্যান্ড চলে যাব। কিন্তু বন্ধুকে আসল কথা বললাম যে, মন ঠিক করে ফেলেছি আমি তিব্বত যাব।
২.
পরিকল্পনা করলাম, পরিবারের কাউকে জানাব না যে আমি বৃন্দাবন যাচ্ছি, ইংল্যান্ড যাচ্ছি না। আমি জানি, যদি গোপান না রাখি আমার ছোট ভাই আমার পিছু নিবে এবং আমি কেন বৃন্দাবন যাচ্ছি সেটা জেনে যাবে। মায়ের কাছে বললাম, ‘আমি আজ রাতে যাব, তুমি আমার বন্ধুদের বিদায় জানাতে আসতে বলো না। যাওয়ার আগে এত লোক ঘটা করে বিদায় দিবে ব্যাপারটা আমার ভালো লাগবে না।’ বলা সত্ত্বেও ওই রাতে আমার অনেক বন্ধু এলো এবং সবাই আমাকে অভিনন্দন জানালো। তাদের শুভেচ্ছা আমার মনকে আনন্দ দিলো, কিন্তু তারা জানালো যে আমি ইংল্যান্ড যাচ্ছি।
এক রাত ভ্রমণ করে বৃন্দাবন পৌঁছে গেলাম। এই সেই বৃন্দাবন, যেখানে বার বছর পরপর ভারতের সব মহান আর ধার্মিক ব্যাক্তিরা জড়ো হন—সাধু, যোগী, স্বামী। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে তাদের প্রিয় কৃষ্ণের জন্মদিনে ভালোবাসা আর সম্মান প্রদর্শন করে যান।
মথুরা থেকে বৃন্দাবন পাঁচ মাইল পশ্চিমে। মথুরা নগরটি একটি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত, সেই পাহাড়টি বনে ঘেরা, সেই বনে রয়েছে অসংখ্য গাছ আর লতাগুল্ম। এই বনের কোকিল যে গান করে, সে মাধুর্যের তুলনা হয় না। এ গান একবার শুনলে স্মৃতিতে গেঁথে যায়। মথুরায় চকর বনবেহায়া পাখিও গান করে। কিন্তু আমার কাছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক হলো কোকিল। এই পাখিদের গানে বৃন্দাবন যেন হয়ে উঠেছে একটি সুখময় স্বর্গ। যমুনা নদীর উত্পত্তিস্থলে এ এক মনোরম দৃশ্য।
আমার মনে হয়, এই বিচিত্র পাখিরা তাদের মিষ্টি গান গাইবে শুধুমাত্র মানবতার মহান অধিপতি শ্রীকৃষ্ণের জন্য। এই বাগিচায় ছেলেবেলায় কৃষ্ণ খেলা করেছেন। সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। বংশীবাদক কৃষ্ণ এখানেই ঈশ্বরের গান গাইতেন, সেই গান ভগবত গীতার কিছু অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি এখানেই বাস করেছেন। তার শিক্ষা চিন্তাশীলদের মানবের চিন্তার খোরাক জুুগিয়েছে। এখানেই কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ‘দাঁড়াও বন্ধু, যুদ্ধ করো তোমার ধর্মের জন্য।’
সুশোভিত গোবর্ধন পাহাড়ে দাঁড়িয়ে যমুনা নদীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কেন আমি বৃন্দাবনে এলাম। গোধূলির আলো পড়ে এলো যখন, ঠিক তখন পেছন থেকে আমাকে একজন ডাকল।
‘বৃন্দাবন কেমন লাগছে? এক সপ্তাহ আগে যেমন দেখেছিলে এখনও কি তেমন?’
‘আপনি ভুল করছেন। এক সপ্তাহ আগে আমি এখানে ছিলাম না।’ বলেই ঘুরে তার দিকে তাকালাম।
‘চিন্তা করে দেখো বত্স্য, তুমি কি সত্যিই এক সপ্তাহ আগে গোবর্ধন পাহাড় অবলোকন করনি?’
‘ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। লুধিয়ানা নগরের বাইরে একটি গাছের নিচে যখন শুয়ে ছিলাম, তখন স্বপ্নে দেখেছিলাম তাকে। আচ্ছা আপনি কি সেই, যাকে আমি ওই গাছের নিচে দেখেছিলাম?
তিনি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ। চলো আগে মন্দিরে চলো, তোমাকে খুব ক্ষুধার্ত দেখাচ্ছে।’
মন্দিরে এক ব্যক্তি আমদেরকে কিছু সুস্বাদু খাবার দিল এবং আমি এই ব্যক্তির সঙ্গ পেয়ে আনন্দিত হলাম। খাবারের পরে মন্দিরের ভেতরের খোলা জায়গাগুলো ঘুরে দেখলাম। এরপর এর মেঝেতে ঘুমিয়ে গেলাম। খুব ভালো ঘুম হলো আমার।
পরের দিন সকালে মন্দিরের দ্বাররক্ষক আমাকে বলল, ঋষি বলে গেছেন যে আমি যেন তার সাথে হরিদ্বারে সাক্ষাত্ করি। ‘ঋষির নাম কি জানেন?’
‘একথা জানি যে তিনি সর্বজ্ঞ, এছাড়া তার ব্যাপারে আর কিছুই জানি না।’
হয়তো ইনিই সেই ঋষি, সম্ভবত সেই মহান গুরু, যার কথা আমি ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি। যার সাথে আমি দেখা করতে চেয়েছিলাম? মনস্থির করলাম যে হরিদ্বার গিয়ে সরাসরি তার নাম জিজ্ঞেস করব।
হরিদ্বার
হরিদ্বারের প্রবেশমুখে এক ব্যক্তিকে দেখলাম যিনি গাছের নিচে বসেছিলেন। তাকে লক্ষ করলাম ভালো করে এবং পার হয়ে এলাম। তিনি আমার কাছে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন কেমন করে আমি বৃন্দাবন থেকে হরিদ্বার এলাম।
‘পায়ে হেঁটে, আপনি কীভাবে এখানে এসেছেন বাবাজী?’
‘একইভাবে, বত্স্য?’ তিনি জোরে বললেন।
মনের ভেতরে উসখুস করছে, মনে হচ্ছে তার নাম জিজ্ঞেস করি।
‘চলো, আগে খাবারের জন্য একটা জায়গা খুঁজে বের করি, এরপর আলোচনা করা যাবে না হয়।’
আমি তার পথ অনুসরণ করে সেখানকার বিখ্যাত মুনিমণ্ডল বিদ্যালয়ে এসে উপস্থিত হলাম। একজন সন্ন্যাসী আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন, নাম কিশভানন্দজী, তিনি পাঞ্জাবের ‘উদাসী’ গোত্রের একজন বিখ্যাত সাধু। তিনি আমাদের খুশিমনে আপ্যায়ন করলেন। খাবার পরে ঋষি একটু দূরে গিয়ে সাধুর সাথে কথা বলতে লাগলেন, আর এদিকে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম থেকে জেগে দেখি একা পড়ে আছি। আমি আমার যাত্রাসঙ্গী ঋষির সন্ধান করতে লাগলাম। তার সম্পর্কে আমি কিছুই অবগত নই বলে তার সন্ধান কষ্টকর হয়ে পড়ল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আমি তাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করে অবশেষে মুনিমণ্ডলে ফিরে এসে সাধু কিশাভানন্দজীকে সব খুলে বললাম। তিনি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং আমাকে বললেন যে, আমি এই মহান বাবাজীকে এত সহজে খুঁজে পাব না।
‘সাধুবাবা, আপনি কি বলতে পারেন, এই বাবাজী কে?’
‘তিনি সকল ঋষিদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ঋষি, বাছা! কেউ কেউ বলেন যোগী, কেউ বলেন স্বামী কেউবা সন্ন্যাসী। তার মতো এত বড় সাধু কেউ হতে পারেনি।’
‘যদি তিনি এত বড় সাধু হন।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘তাহলে যে ঋষি রাজপুতের আবু পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় আসীন যিনি নাকি ঋষিশ্রেষ্ঠ, সেই ভগবান পুরিজীই কি ইনি?’
‘এ কথা তুমি কার কাছে থেকে শুনেছ বত্স্য?’
‘আমার চাচা সাধু উতামা সিংজী।’
‘তুমি তাহলে উতামা সিংজীর ভাগ্নে? তিনি এখন কোথায় অবস্থান করছেন?’
আমি বললাম যে তিনি দশ বছর আগে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
প্রায় এক সপ্তাহ সময় আমি মুনিমণ্ডলে ছিলাম। তখন আমি জেনে অবাক হলাম যে, সাধু কিশভানন্দজীর বয়স নব্বই বছর। তিনি এতটাই শক্তিমান ছিলেন যে, ছয়-ছয়জন যুবকও তাকে টলাতে পারত না। পরে আমি ওই ছয় যুবককে নব্বই বছর বয়সী একটা লোককে তুলতে না পারা নিয়ে বকছিলাম। ওরা জানালো যে, উনার বয়স যখন ষাট বছর ছিল তিনি এমন শক্তিশালী ছিলেন যে, আমাদের মতো বার জন যুবকও তাকে এক ইঞ্চি নড়াতে পারত না।
আমি সন্ন্যাসী কিশভানন্দজীকে অনুনয় করে বললাম যে, আমি কী করে ভগবান পুরিজীর সাথে সাক্ষাত্ করতে পারি। যখন তিনি বুঝলেন যে, আমি ভগবান পুরিজীর সাথে দেখা করতে উদ্গ্রীব। তখন বললেন যে, তার সাক্ষাতের জন্য আমাকে আবু পাহাড়ের চূড়ায় যেতে হবে।
তিনি আশ্বস্ত করে বললেন, ‘প্রভু এখন আবু পাহাড়ে অবস্থান করছেন।’
আমি কী করে এই জঙ্গলের পথ দিয়ে আবু পাহাড়ে পৌঁছাব! রাজপুতের বাঘ, হিংস্র প্রাণী আমাকে খেয়ে ফেলবে। আমাকে ওদের আহারে পরিণত করবে।
সন্ন্যাসী আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন যে, প্রভুর সাথে সাক্ষাত্ করার প্রবল ইচ্ছা নেই আমার।
‘যদি তুমি সত্যিই প্রভুর দেখা পেতে চাইতে, নিজের কথা মনে স্থান পেত না। বাঘের পেটে যাওয়ার ভয় করছ কেন? তুমি হলে আত্মা, যার জন্ম অথবা মৃত্যু নেই। যা হয় তা হয়, যা হবার হবে।’
সন্ন্যাসী নিজের সম্পর্কে আমাকে বক্তৃতা করতে লাগলেন যে, তিনি ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় এবং সারা পাঞ্জাব তাকে সম্মান করত। এরপর হরিদ্বারে মুনিমণ্ডলে তিনি তার বাসস্থান বানিয়েছেন, কারণ মুনিমণ্ডলের দূরত্ব রেলস্টেশন থেকে বড়জোর এক মাইল।
‘যাও বাছা, মহানের সন্ধানে বের হও। পথযাত্রা তোমার সার্থক হবে।’
তিনি একটা মানচিত্র দিলেন আমাকে, সেখানে স্পষ্ট করে আবু পাহাড়ে পৌঁছানোর সব পথের নির্দেশন দেয়া আছে। মানচিত্রটি আমার হাতে দিয়ে সন্ন্যাসী চলে গেলেন। এক এক করে তিনদিন কেটে গেল। চতুর্থ দিনে মুনিমণ্ডলে একজন ছয়ফুট লম্বা লোক এসে হাজির, দেখে মনে হয় গায়ে কসাইয়ের শক্তি, এখনই একটা পাঠার গলা নামাবে। লোকটি বলল যে সেও আবু পাহড়ে যাবে। এই তার প্রথম নয়, সে আগেও সেখানে গিয়েছে।
আমার মধ্যে কেমন যেন করতে লাগল, আমার কি এমন একটা লোকের সাথে যাওয়া উচিত? কিন্তু কেউ এমন সাহসী ছিল না যে, এই জঙ্গলের পথে যাত্রা করে। অধিকন্তু আমার মনে হলো রাজপুতের বাঘের চেয়ে এই ব্যক্তির সাহস কোনো অংশেই কম নয়। আমি তার সহযাত্রী হতে রাজি হলাম।
৪.
রওনা হলাম। কিন্তু পরদিন সকালে কসাই লোকটা নাকি আমাকে জঙ্গলে রেখে গায়েব হয়ে গেল! পরে আমি জঙ্গলের মাঝে নিরর্থক তার পায়ের চিহ্ন খুঁজতে লাগলাম ভগ্ন আশা নিয়ে, কিন্তু কিছুই পেলাম না। মানচিত্র আর পথের নকশা এখন আমার কাছে অন্ধের যষ্ঠি। আমি আমার গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছু কিছু সময় বিরক্ত হয়ে দৌড় লাগালাম, আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছাতেই হবে।
অবশেষে অনেক কষ্টেসৃষ্টে, যুদ্ধ করে আমি আবু পাহাড়ে সন্নিকটে এসে উপস্থিত হলাম। দেখতে পেলাম পাহাড়ে খুব কাছে একটি ছোট গুহার মুখে এক ব্যক্তি বসে আছেন। আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, প্রভুকে তিনি চিনেন কি না। তিনি উত্তর দিলেন, ‘তিনি তাকে চিনেন, কিন্তু আমি কি তাকে চিনি?’
বললাম, ‘আমি এখানে তার সাথে কথা বলতে এসেছি এবং যোগ শিখব তার কাছে।’
একটা দয়ার হাসি হেসে ওই ব্যক্তি জানালেন যে প্রভু আজ প্রভাতে এখান থেকে প্রস্থান করেছেন।
আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। হতাশা আর ক্লান্তি আমাকে ঘিরে ধরল। আদৌ তার সাথে সাক্ষাত্ হবে কি না কে জানে।
‘তোমার শরীর খারাপ করেছে বুঝি বাছা? কী হয়েছে?’
‘না না, ও কিছু নয়।’ আমি ক্লান্ত স্বরে জবাব দিলাম, ‘আমি বহুপথ পাড়ি দিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে আমার প্রিয় প্রভুর সাথে দেখা করতে এসেছি, কিন্তু তাকে পেলাম না।’ নিজের উপর করুণা হলো।
‘তিনি প্রস্থান করেছেন সত্য কিন্তু তা খুব দূরে নয়। নাসিক গুহায়। তুমি সেখানে তার সাক্ষাত্ পেতে পার।’ তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন। ‘আমি তো জানি না কোথায় সেই গুহা। মানচিত্রে দেখতে পাচ্ছি না, শুধু পুরাতন নাসিক নগরের নকশা আছে মানচিত্রে।’
‘আমি আগামীকাল ওই গুহায় যাব। যদি চাও আমার সাথে যেতে পার।’
কথাটা শুনে আমি শব্দ করে হেসে দিলাম। মনে পড়ল এখানে আসার আগে একটা কসাই লোক আমার সাথে এসেছিল, কিন্তু হঠাত্ গায়েব হয়ে গিয়েছিল। আমার হাসির শব্দে উনি জিজ্ঞেস করলেন আমি কেন হাসছি। আমি তাকে সব কিছু খুলে বললাম। তিনি বললেন যে, তিনি আমাকে একা ফেলে যাবেন না এবং তার কথা বিশ্বাস করে পরেরদিন নাসিক গুহার উদ্দেশে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলাম।
নাসিক গুহা
যে লোকটির সাথে কথা হয়েছিল কাল সন্ধায় বয়স তার বছর পঞ্চাশেক হবে। কিন্তু লোকটির দেহে যেমন শক্তি আর মনে তেমন দয়া। এর আগের সহযাত্রীকে আমি যেমন অবিশ্বাস করেছিলাম, ঠিক তেমনি এই লোকটাকে বিশ্বাস করে যাত্রা শুরু করলাম। যাত্রাপথে আমি তার নাম জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন যে তার কোনো নাম নেই।
‘লোকে আপনাকে কী নামে ডাকে?’ আমি জোরাজুরি করলাম।
‘অনেক নামে ডাকে।’ তিনি উত্তর দিলেন।
‘তাহলে আমি আপনাকে কি জনাব বলে সম্বোধন করব?’
তিনি অবজ্ঞাভরে বললেন, ‘সে তোমার ইচ্ছা।’
তার কাছে থেকে দীক্ষা নিব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, তাই তার বয়স জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমার বয়স নেই। জন্ম বা মৃত্যু কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না।’
‘গাছেরও শিকড় থাকে জনাব, আপনার শিকড় কতদূর জানতে পারি?’
‘সে জানা সম্ভবপর নয়।’ তিনি নরম স্বরে আমাকে ভর্ত্সনা করলেন।
‘তাহলে আমাকে বলুন, কী করে যৌবন ধরে আছেন এখনো?’
‘আচ্ছা, আচ্ছা।’ তিনি অবাক হলেন এবং আমাকে থামিয়ে দিলেন।
‘আসো, আসো। আসো আমার বুড়ো বন্ধু!’
যখন আমি তার বৃদ্ধা বন্ধুকে দেখলাম, নিশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হলো, দাঁতে দাঁত লেগে যেতে লাগল। তার বন্ধু ছিল বিশাল এক বাঘিনী! বাঘিনীটি আমার চোখের দিকে চোখ বস্ফািরিত করে তাকাল। আমার ভয় পাওয়া দেখে বলল, ‘ভয় পেও না।’
‘আপনি বলছেন, এই ভয়ঙ্কর জন্তু আপনার বন্ধু?’
‘কেন নয়।’ তিনি ধীরে জবাব দিলেন।
‘আপনি কে?’
‘আমি স্বয়ং আমি বা আমি আত্মা।’ তিনি খুব ঠাণ্ডা স্বরে বললেন।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে তিনি বাঘিনীটির কাছে গেলেন আর তার পশমে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আর বাঘিনীটি কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে বন্ধুর মতো আদর নিতে লাগল।
‘আয় আয়, দেখ, এই আমার নতুন বন্ধু।’ তিনি বাঘিনীটিকে ডাকলেন এবং আমার দিকে বাঘিনীটিকে আসতে ইশারা করলেন।
ঘসঘস করতে করতে বাঘিনী আমার দিকে এলো। আমার গলা শুকিয়ে গেল। কিন্তু কোনোমতে সামাল দিলাম।
‘সে অনেক ভালো না!’ সন্ন্যাসী বলতে থাকলেন, ‘খুব ভালো বাঘ মা সে। তার একটা বাচ্চা আছে, আর তার বোনের দুই বাচ্চা। বোনটি মারা গেছে। তোমার বাচ্চা দেখাও, দেখাবে?’
কথামতো বাঘিনীটি আমাদের সামনে হেঁটে যেতে লাগল, আমি চুপচাপ ওর পিছু পিছু হেঁটে যেতে লাগলাম। যেহেতু আমার সাহস ছিল না, আমি চুপ রইলাম কিন্তু আমার মনের মধ্যে হাজার চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। প্রায় আধা মাইল হেঁটে বাঘিনীটি আমাদেরকে একটা বনঘেরা পাহাড়ে নিয়ে এলো। পাহাড়টি ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে একটা বড় গর্তে একমাস বয়সের একটা এবং তার চেয়ে বড় দুইটা ব্যাঘ্রশাবক খেলা করছিল, জড়াজড়ি করে লুটোপুটি করছিল।
বাচ্চাগুলো দেখে ভয় পাইনি, ওদের গায়ের লোম দেখে খুব পছন্দ হলো আমার, আমি ওদের সাথে খেলার অনুমতি চাইলাম।
ছোট বাচ্চাটি আমাকে দেখে প্রথমে ভয় পেলেও পরে তিনজনের সাথেই বন্ধুত্ব করে ফেললাম। কিছুক্ষণ পরে সাধু আমাকে বাঘের ডেরা থেকে বের হয়ে আসতে বললেন এবং আমরা আবার গুহার পথে যাত্রা শুরু করলাম।
আমার জিহ্বা নিশপিশ করতে লাগল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি অবশ্যই একজন শ্রেষ্ঠ মুনি।’ এবং জোর দিয়ে বললাম, ‘এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’
‘কেন মনে হলো একথা?’ উদাসীনভাবে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘এই কারণেই তো বাঘিনী আমাদের কিছু বলল না।’
‘ও তেমন কিছু নয়। যারা নিজেরা মরতে চায়, বাঘ শুধু তাদের মারে। যদি তোমার মনে ভয় না থাকে, তুমি ওদেরকে ভালোবাসো,্র ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। সকল প্রাণীর জন্য তোমার ভালোবাসা থাকলে, তুমিও ভালোবাসা ফেরত পাবে।’
‘প্রভু, আপনি আমাকে বলবেন কি গোপন রহস্যের বলে আপনি বাঘিনীকে বশ করেছেন আপনাকে ভালোবাসার জন্য?’
‘আমাকে প্রভু বলো না।’ তিনি আমাকে নিষেধ করলেন।
‘মানুষ যদি জীব হত্যা না করত, তবে সকল প্রাণী মানুষকে ভালোবাসত।’
‘কতদিন লাগে এই গুণ অর্জন করতে?’
তিনি বললেন যে বার বছর ধরে যদি তুমি হাত, চোখ বা জিহ্বা সংযত রাখো তাহলে এই শক্তি অর্জন সম্ভব।’
‘যে মানবসন্তান হাত, চোখ অথবা জিহ্বা দিয়ে মারে না। মানুষ বা প্রাণী কেউই এই মমতাময় মানবসন্তানকে আক্রমণ করবে না। শুধু তাই নয়, সে যা বলবে, দেখবে বা করবে, তার বিরুদ্ধাচরণও করবে না।’
‘প্রভু, জীব হত্যা না করা ছাড়া আর কি উপায় আছে?’
‘হ্যাঁ বাছা, তার হূদয় সকলের জন্য ভালোবাসায় পূর্ণ থাকতে হবে। কিন্তু এই ভালোবাসা, মমতা শুধু কোনো একজনের জন্য হলেই হবে না, সকলের জন্য হতে হবে। স্থান বা কাল যাই হোক মৃত্যুভীতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। সে মৃত্যুর ঊর্ধ্বে, তাকে হূদয়াঙ্গম করতে হবে যে সে হাড়-মাংসের একটা প্রাণী নয় শুধু। সে আত্মা, সে প্রাণ, সকলের মধ্যে, সবকিছুর মধ্যে।’
হিংসা নয়, নয় ভয়,
আমি প্রিয়তম সবার।
কোনো প্রতিযোগী, কোনো শত্রু
কোনো ক্ষত, কোনো দুঃখ
ওম, ওম, ওম!
কিছুই আমার করবে না ক্ষতি।
কেউ আমায় করবে না সতর্ক।
সবারই আত্মা
মধুর ঝরনা।
ওম, ওম, ওম।
স্বর্গ ও তারা,
পৃথিবীর কছে ও দূরে,
ঝুলে আছে তারা,
করছে নৃত্য।
গাই তার গান।
ওম, ওম, ওম।
আমরা নাসিক গুহায় পৌঁছালাম। গুহাটি যেন একটি মিলনায়তন। শত শত মূর্তি দিয়ে ঠাসা। কিছু রাজাদের মূর্তিও স্থান পেয়েছে, তার মধ্যে রাজা যুধিষ্ঠিরের ভাস্কর্য রয়েছে। পঞ্চ পাণ্ডবের এক পাণ্ডব রাজা যুধিষ্ঠির, যিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
গুহার ভেতরে গিয়ে চোখ বুলালাম এবং এরপর অপেক্ষারত প্রভুর নিকট ফিরে এলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি যা দেখতে চেয়েছিলাম, তা দেখেছি কি না। ‘হ্যাঁ, কিন্তু এই গুহার ইতিহাস কি বলবেন আমাকে?’
‘বাঘ নগরে যেখানে আমি সর্বশ্রেষ্ঠ গুরুর দেখা পেয়েছিলাম, সেখানে আমরা আরও সহস্র গুরুর দেখা পাব, সেখানে যাব। তখন তোমাকে নাসিকের ইতিহাস বলব।’
আমরা যখন পাশাপাশি হাঁটছিলাম, তিনি আমাকে নাসিক গুহার চিত্তাকর্ষক সব তথ্য দিতে লাগলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ সালে কৌরব এবং পাণ্ডুর মধ্যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই নাসিক গুহা খননের কাজ শুরু হয়। অনেক মহান ব্যক্তি, রাজা, রানি সকলের শ্রমে এই গুহা তৈরি হয়েছে। শুধুমাত্র হাত ব্যবহার করে তিনশত বছর ধরে খনন করা হয়েছে এই গুহা। হাতুড়ি আর বাটালি ছাড়া আর কোনো যন্ত্র ব্যবহূত হয়নি।
আমি বলমাম, ‘হুম, ওখানে রাজা যুধিষ্ঠিরের বহুসংখ্যক ভাস্কর্যও ছিল।’
‘হ্যাঁ। তিনি ছিলেন অধীশ্বর, যিনি নিঁখুতভাবে ধর্ম পালন করতেন। অধিকার আর কর্তব্য পালনের উপায় হিসেবে তিনি ধর্মকে বেছে নিয়েছিলেন। এই কারণে এখানে তার বহু ভাস্কর্য রয়েছে। তিনিই একমাত্র রাজা যিনি সশরীরে স্বর্গে হাজির হয়েছিলেন।’
‘প্রভু, আমি এই কাহিনি শোনার জন্য উদ্গ্রীব।’
রাজা যুধিষ্ঠির পাণ্ডুর শাসনকর্তা ছিলেন। মহাভারতে কথিত আছে যে, তিনি কৌরব রাজ্যের রাজার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। কৌরব রাজা ছিল লুটেরা আর লোভী। সে কারণেই সে যুদ্ধে হেরেছিল। এই যুদ্ধ ছিল মূলত শুভ আর অশুভ শক্তির যুদ্ধ। রাজা যুধিষ্ঠির যুদ্ধ করে ধর্ম রক্ষা করেছিলেন, শয়তানকে বধ করেছিলেন।
যুদ্ধ বন্ধের কিছুদিন পরে শ্রীকৃষ্ণ যখন দৈবক্রমে একজন শিকারির হাতে মৃত্যুবরণ করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিল একশ ছাব্বিশ বছর। যুধিষ্ঠির আর তার চার সহোদর শ্রীকৃষ্ণকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, তার মৃত্যু এই পঞ্চপাণ্ডবের কাছে অসহনীয় ছিল। তাই তারা শ্রীকৃষ্ণকে স্বর্গে গিয়ে দেখার ইচ্ছা পোষণ করলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে স্বর্গে গিয়ে কৃষ্ণকে খুঁজে বের করবেনই। অবশেষে যুধিষ্ঠির, রাজমহিষী সতী দ্রৌপদী এবং তার চার ভাই কৃষ্ণের অনুসন্ধানে বের হলেন। যখন তারা হিমালয়ের চূড়ার কাছাকাছি, রানি দ্রৌপদী মুর্ছা যাচ্ছিলেন আর অবসাদগ্র্রস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তিনি চিত্কার করে বললেন, ‘প্রিয় স্বামী, আমি আর এক কদম এগোতে পারছি না। আমি পড়ে যাচ্ছি, আমাকে সাহায্য করুন।’ যুধিষ্ঠির উত্তর করলেন যে, ‘আমি যতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি তুমি যদি এভাবেই থাকতে পার, তবে আমি তোমাকে সাহায্য করব।’ কিন্তু তিনি দ্রৌপদীকে সাহায্য করতে পারলেন না। দ্রৌপদী একেবারে অবসন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
এর কিছু পরে যুধিষ্ঠিরের কনিষ্ঠ সহোদরেরও পা চলছিল না এবং তাকেও মৃত্যুমুখে ফেলে চলে এলেন যুধিষ্ঠির।
এক এক করে তার পরবর্তী দুই সহোদরও মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। শুধুমাত্র রাজা যুধিষ্ঠির আর তার একজন সহোদর সেই অবসন্ন পায়ে পাহাড়ে আরোহণ করে চললেন। ‘হে অধীশ্বর, ওহে আমার প্রাণপ্রিয় ভ্রাতা, আমাকে বলুন যে পতিব্রতা দ্রৌপদী আমাদের ভগবানের চেয়েও বেশি ভালোবাসত তাকে কেন উদ্ধার করলেন না।’
‘এই কারণেই।’ খুব সংক্ষেপে উত্তর দিলেন যুধিষ্ঠির।
‘আর আমাদের সহোদরেরা কেন মৃত্যুমুখে পতিত হলো?
‘ওহে ভীম, আমাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, যে নাকি বয়সে তরুণ ছিল, সে ছিল সুদর্শন আর অহংকারী। অহংকার পতনের মূল। সে ভাবত, এই পৃথিবীতে তার চেয়ে সুদর্শন আর কেউ নেই, এ নিয়ে তার অহঙ্কারের সীমা ছিল না।’
‘ওহে নৃপতি, তাহলে ধার্মিক অর্জুনের কেন মৃত্যু হলো ?’
‘হ্যাঁ ভীম, কারণ সে বিশ্বাস করত যে, সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা।’ রাজা বিষণ্নমুখে কথাটা বললেন।
‘অবশেষে ভীমও মৃত্যুমুখে পতিত হলো। শুধুমাত্র বেঁচে রইলেন যুধিষ্ঠির। তিনি হিমালয়ের চূড়ায় আরোহণ করলেন এবং সেখানে ভগবানের সাক্ষাত্ পেলেন।’
‘হে রাজা, আপনি সত্যের পথে জয়ী হয়েছেন এবং প্রতিদানে আপনি সশরীরে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারেন। আমার সাথে আসুন—এই আমার বাহন।’
যুধিষ্ঠিরের পেছনে পেছনে তার কুকুরটিও মাথানত করল। এই আরোহণে কুকুরটি তার বিশ্বস্ত সহযাত্রী। যুধিষ্ঠির ভগবানকে শুধালেন, ‘আমি কি আমার কুকুরটিকে সাথে করে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারি?’
‘না। আপনার কুকুর এতদিনে পৃথিবীতে হয়তো অনেক জীবন যাপন করেছে। এটা তার স্বর্গে প্রবেশের যথাযথ সময় নয়। যখন সে আপনার মতো মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে, তখনই সে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে।’
‘যুধিষ্ঠির আপত্তি জানিয়ে বলল, কুকুরটি বিপজ্জনক পথ পার হয়ে তাকে অনুসরণ করেছে ভগবানকে পাওয়ার জন্য। কষ্ট সহ্য করেছে। কুকুরটিও এই পুরস্কারের ভাগীদার। আমার স্ত্রী আর সহোদরেরা যা পারেনি, কুকুরটি পেরেছে।’
ভগবান কঠোর গলায় বললেন, ‘চলুন আমরা প্রবেশ করি।’
‘যুধিষ্ঠির কুকুরটির প্রবেশের জন্য অনুনয় করলেন, কিন্তু ভগবান অনমনীয় রইলেন। যুধিষ্ঠিরের চোখ ভিজে গেল, তিনি বললেন এ ঠিক নয়! আমি এখানে এসেছি আপনার জন্য ভগবান, আপনার স্বর্গের জন্য নয়। যে কুকুরটি আমার কষ্ট ভাগ করে নিয়েছে, সে যদি আমার সাথে পুরস্কারের ভাগীদার না হতে পারে, আমি স্বর্গে প্রবেশ করতে চাই না।’
‘এটা আপনার পরীক্ষা ছিল রাজা। আপনি জয়ী। পরীক্ষায় জয়ী হয়েছেন। এখন আপনি আমার সাথে স্বর্গে পদার্পন করুন।’
সাধু যুধিষ্ঠিরের গল্প শেষ করলেন। আমরা একটা গ্রামে এসে পৌঁছালাম এবং সেখানকার মন্দিরে এক রাত ঘুমিয়ে নিলাম। একদিন পর আমরা আবার শুরু করলাম। টানা তিন দিন পদব্রজে, রাতগুলো কেটে যেতে লাগল। তিনদিন পর আমরা সুপরিচিত বাঘ গুহায় এসে পৌঁছালাম।
বাঘ গুহা
বাঘ গুহাটি নব্বই ফুট দৈর্ঘ্য আর নব্বই ফুট প্রস্থের। মাণ্ডু থেক পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এবং ট্রেনে চেপে খুব সহজেই এখানে আসা যায়। স্থানটি জির্ন আর ভগীরথী নদীর মিলনস্থল এবং যা নাকি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে সুপরিচিত।
যারা পড়ছেন তারা বুঝতে পারছেন আমার ভেতরে কেমন করছিল যখন গুরুজী বললেন, ‘বাছা, তুমি প্রভুশ্রেষ্ঠ ভগবান পুরিজীর সাথে দেখা করতে চাও, তাই নয় কি?’
‘হ্যাঁ।’ আমি কম্পিত গলায় উত্তর দিলাম, ‘এর চেয়ে মহত্ ইচ্ছা আর হতে পারে না।’
‘তাহলে গুহার ভেতরে যাও। তুমি তার এবং আরও অনেকের সাক্ষাত্ পাবে।’
আমি খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেলাম এবং চূড়ায় গুহার খোলা মুখ দেখতে পেলাম। গুহাটি খাড়া নিচে নেমে গেছে। অবরোহণ করতে করতে বুঝতে পারলাম গুহাটি নিচে নামার সিঁড়ি অথবা তলায় বিভক্ত।
প্রথম তলায় গিয়ে আমি তিন ফুট প্রস্থের একটি রন্ধ্র দেখতে পেলাম। যা দ্বিতীয় স্তরে যাওয়ার পথ। আমি যখন নিচে নামলাম গুহার মুখ দিয়ে যে আলো ঢুকছিল তাও বন্ধ হয়ে গেল। হাত দিয়ে ডান বাম ঠিক করে করে আরও নিচে গিয়ে তিন তলায় প্রবেশপথ খুঁজে পেলাম। এমনি করে পঞ্চম তলায় পৌঁছালাম। মাথা ঘুরছিল, বাতাস ছিল না এবং অনেক আস্তে আস্তে নামছিলাম। প্রায় বার মিনিট ধরে এমন করে নামছি। আর পারছিলাম না যেন। মাথা ঘুরে দেয়ালে হোঁচট খেলাম। সেখানেই মাথাঘুরে মাটিতে পড়ে গেলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর একটু শক্তি পেলাম এবং গুরুর কাছে ফিরে এলাম। গুরু বললেন, আমি যা খুঁজছিলাম পেয়েছি কি না।
বললাম, ‘না পাইনি, আর আমি গুহার মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ’
‘বত্স্য, তুমি ভালো করেছ। অনেকের তুলনায় ভালো করেছ।’
‘কী করে! আমি তো ধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘শোনো বাছা, আমি অনেকবার অনেককে নিয়ে এখানে এসেছি এবং গুহার মুখে ছেড়ে দিয়েছি। কেউ কেউ মুখে গিয়েই ফিরে এসেছে। কেউ কেউ প্রথম এমনকি তৃতীয় ধাপে গিয়েছে কিন্তু কেউই পঞ্চম ধাপে যেতে পারেনি। এরপরেও কি তুমি বলবে তুমি ভালো করনি?’
‘হয়তো,’ আমি বললাম, ‘কিন্তু আপনার সাহায্য নিয়েছি অনেক। সবসময় নিরাপদবোধ করেছি এবং আমি জানতাম, যাই হোক আপনি আমার ক্ষতি হতে দিবেন না।’
‘কিন্তু তোমাকে রক্ষা করার আমি কে?’
‘আপনি প্রভু।’ আমি অন্তর থেকে বললাম, ‘আপনি নিশ্চিতভাবে আমাকে গুহার গভীর পর্যন্ত পথপ্রদর্শন করেছেন। তাহলে আপনিই কি প্রভু নন?’
তিনি আমাকে উত্তরে বললেন যে, তিনি আমাকে আলোর ব্যবস্থা করে দিতেন যদি আমি একা যেতাম।
আমি কৃতজ্ঞ হয়ে বললাম, ‘ঠিক তা নয়, আমিই তো আপনাকে আমার সাথে যেতে বলেছিলাম।’
‘খুব ভালো কথা। আমরা একসাথে গুহায় যাব। এখন তুমি হাত-মুখ ধৌত করো, আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।’
আমি অবিলম্বে হাত ধুয়ে প্রভুর কাছে এলাম এবং তিনি আমাকে ফলমূল আর মিসরি খেতে দিলেন। আজ পর্যন্ত আমি মনে করতে পারিনি তিনি কোথা থেকে সেই ফল এনেছিলেন। ফলগুলো খুব সুস্বাদু ছিল। এমন সুস্বাদু আর সুঘ্রাণযুক্ত ফল আমি কখনও খাইনি।
‘আপনি এই চমত্কার ফল কোথা থেকে এনেছেন?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘কেন, ফলটি তোমার পছন্দ হয়নি?’ তিনি বললেন।
‘এই রকম সুস্বাদু ফল আমি জীবনে খাইনি।’
‘কোথা থেকে এনেছি সেটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন মনে হচ্ছে?’ তিনি আপত্তি করলেন।
পরের দিন সকাল সাতটায় আমাদের গুহা অনুসন্ধান আবার শুরু হলো। আমার কাছে এই অনুসন্ধান খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রভুর কাছে তা ছিল খুব সাধারণ। তিনি প্রথমে আমার আগে আগে প্রথম তলা থেকে তৃতীয় তলায় নামলেন। তিনি আমাকে একটা জিনিস ধরিয়ে দিলেন, কাঠের লাঠি। বললেন, ‘আলোর দরকার হলে তুমি পাবে।’ ‘আমি ষষ্ঠ তলায় নেমেছি কিন্তু কোনো সন্তর দেখা পেলাম না। ’
‘নিচে আরও ধাপ আছে। সেখানে তুমি যা খুঁজছ পেয়ে যাবে।’
আমি চিত্কার করলাম, ‘প্রভু, প্রভু, আলো কোথায়?’
‘তোমার ভেতরে,’ আমি তার গলার স্বর শুনতে পেলাম। ‘তোমার হাতে যা আছে, তা দিয়েই আলো জ্বালাও।’
হঠাত্ আমার হাতের লাঠি জ্বলে উঠল। কিন্তু আমি আমার প্রভুকে আর দেখতে পেলাম না।
হেঁটে হেঁটে আমি একটা ছোট কক্ষে প্রবেশ করলাম, সেখানে আমি এক ব্যক্তিকে ধ্যানরত অবস্থায় দেখতে পেলাম। তিনি তার চোখ খুললেন। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঠিক সেইরকম চোখ, যা আমি আগে তিনবার দেখেছি। তাকে দেখতে পেয়ে এবং তাকে সব যোগীদের চেয়ে জ্ঞানী মনে করে বিহ্বল হলাম। আমি আমার সেই প্রভুকে ভুলে গেলাম, যিনি আমাকে এই বাঘ গুহায় নিয়ে এসেছিলেন এবং এই নতুন প্রভুর প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করে মাথা নোয়ালাম।
‘বসো।’ তিনি দয়াভরে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি তার পায়ের কাছে বসলাম। আমার একান্ত ইচ্ছাপূরণ হলো।
আমি আসন গ্রহণ করতেই গুহা আলোতে ভরে গেল। তিনি আমার হাত থেকে সেই লাঠিটা নিয়ে নিলেন এবং একটু দূরে ফেলে দিলেন। তার শান্তিময় উপস্থিতিতে আমি যেন নিজের কথা ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম আমি কেন এখানে এসেছি। তিনি আমাকে ডাকলেন, ‘তুমি কি আরও নিচে যেতে চাও এবং অনান্য যোগীদের সাথে সাক্ষাত্ করতে চাও? নাকি চলে যেতে চাও?’
আমি সম্মানভরে বললাম, ‘আমি আরও নিচে যেতে চাই, যদি আপনি আমায় সঙ্গ দেন।’ তিনি উঠে দাঁড়ালেন এনং আমাকে পরের ধাপে যেতে বললেন। ‘চলো বাছা, তবে অবরোহণ শুরু করি।’
আমরা যখন গুহার বাইরে পৌঁছালাম, মনে পড়ল আমার সেই গুরুকে যাকে হারিয়েছি এবং যিনি আমার এই কৌতূহলের প্রতি মায়া দেখিয়েছিলেন। আমি যোগী পুরিজীকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি জানেন কি না তার কী হয়েছে। প্রভু পুরিজী আমাকে সাবধানে উত্তর দিলেন যে, এটা খুব পরিতাপের বিষয় আমি আমার ভালো বন্ধুকে হারিয়েছি। ‘বাছা, তুমি কি কথা বলতে বিরক্ত বোধ করছ, তাই কি? কথা বলো, কথা বলো।’ সেই ধার্মিক সাধু আমাকে বললেন।
‘আচ্ছা, ওরা কি সবসময় এই গুহার ভেতরে থাকে নাকি বাইরে আসে?’
‘কেউ কেউ এক মাস গুহায় থাকে, তারপর বাইরে আসে। কেউ কেউ ছয় মাস বা এক বছর, কেউ কেউ বছরের পর বছর এই গুহার ভেতরে কাটিয়ে দেয়। তুমি হয়তো দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছ। হয়তো ওদের দেখেছ, ভবিষ্যতেও দেখবে।’
‘প্রভু’ আমি অনুনয় করে বললাম, ‘আপনি যদি আপনার আসল নামটা আমাকে বলতেন!’
‘আমার কোনো নাম নেই পুত্র।’
‘কিন্তু আপনি যখন শিশু ছিলেন, প্রিয় প্রভু, আপনার মা আপনাকে কী নামে ডাকতেন?’
‘সে অনেক অনেক বছর আগের কথা। অনেক মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন এবং সবাই আমাকে নাম দিয়েছেন। আমার সেগুলো মনে নেই।’
‘তাহলে আপনার আসল নাম ভগবান পুরিজী নয়, তাই তো?’
তিনি বললেন, ‘তারা আমাকে এই নাম দিয়েছিল একশ বছরেরও আগে।’
‘প্রভু, তা সত্য, আচ্ছা স্বামী দয়ানন্দ আপনাকে আবু পাহাড়ের চূড়ায় দেখেছিলেন?’
‘তুমি কোথায় এই কথা শুনেছ পুত্র?’
‘অনেক সাধুদের কাছে, তাদের মধ্যে আমার কাকা উতামা সিংজীও আছেন। তিনি আমাকে একসময় আপনার জীবনের গল্প শুনিয়েছিলেন।’
‘ও আচ্ছা, হ্যাঁ, অনেকেরই গুরু ছিলাম। ’
‘প্রভু, আমি কি আপনার বয়স জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘আমি আমার বয়স নিয়ে চিন্তা করি না, আমার কোনো বয়স নেই।’
‘আপনার বয়স কমপক্ষে দুইশ বছর?’ আমি আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করলাম।
‘পুত্র তুমি আমাকে যত ইচ্ছা বয়সী ভাবতে পার।’ প্রভু বিনোদিত হয়ে বললেন, ‘কিন্তু তোমার বয়স কত—একথা কখনও মনে স্থান দিও না। বয়স ভুলে যাবে, যতদিন তুমি যুবকের মতো চিন্তা করবে, ততদিন তুমি তোমার শরীর ধরে রাখতে পারবে। কখনই বলো না, আমার একান্ন বছর বয়স। ভাববে আমি যুবক এবং তুমি যুবকই থেকে যাবে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাঘ গুহার বয়স কত?
‘বলা হয়ে থাকে যে খ্রিষ্টের জন্মের ৫৯০ বছর আগে এই গুহার জন্ম। কিন্তু এটা ভুল। এটা তার থেকেও বেশি পুরাতন। যেমন লোকজন ভাবে এই গুহার মাত্র পাঁচ ধাপ। তুমি এবং আমিই সঠিকটা জানি।’
‘হ্যাঁ, আমি সপ্তম ধাপ পর্যন্ত গিয়েছি এবং এটা আরও গহীন।’
‘ঠিক বলেছ। আরও ধাপ আছে।’ কিছুক্ষণ পরে প্রভু বললেন, তাকে হরিদ্বার যেতে হবে। ‘তুমিও এসো ওখানে, আমি তোমার সাথে মুনিমণ্ডলে দেখা করব। কাউকে বলো না, তুমি কোথায় ছিলে, কী দেখেছ, অথবা আমি কে। আপাতত কাছের কোনো জায়গায় যাও এরপর ট্রেনে চেপে হরিদ্বার চলে এসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’
হরিদ্বারে আমার প্রভু পুরিজী আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং আমি তাকে দেখে খুব আনন্দিত হলাম। তার পাশে কিশভানন্দজী বসেছিলেন। তিনি মুচকি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আবু পাহাড়ের চূড়ায় আমার প্রভুকে পেয়েছি কি না।
‘হ্যাঁ, আমার মহান প্রভু ঠিক আপনার পাশে এখন বসে রয়েছেন।’
প্রভু ভগবানজী আমাকে নরম স্বরে ভর্ত্সনা করলেন, ‘আমাকে প্রভু ডেকো না। আমি তোমারই মতো একজন।’
‘প্রিয় প্রভু’ আমি উত্তর দিলাম, ‘আপনি যদি চান আমি আপনাকে মহান বলব না। কিন্তু তবুও আপনি আমার দেখা সব মানুষের চেয়ে মহান। আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই এবং যোগশাস্ত্র শিখতে চাই।’ তিনি বললেন যে, তিনি শিখাবেন কিন্তু একটু দেরি হবে, তাকে আগামীকাল আবশ্যিকভাবে হরিদ্বার ছেড়ে যেতে হবে।
আমি বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কি জানতে পারি আপনি কোথায় যাবেন?’ মনে হলো তাকে খুব কম কাছে পেলাম।
‘পুত্র, আমি বদ্রীনাথ আর কেদারনাথ মন্দিরে যাব, সেখান থেকে হিমালয়ের চূড়ায় যাব, তারপরে মুক্তিনাথ যাব।’
‘বদ্রীনাথ আর কেদারনাথের কথা আমি শুনেছি। কিন্তু মুক্তিনাথ কোথায়?’
‘হিমালয়ের অপর পাশে, তুষার ঘেরা হিমালয় পেরিয়ে। খুব লম্বা পথ। কিন্তু কেউ যদি ঠাণ্ডা আর উচ্চতা সহ্য করতে পারে, একটা সংক্ষিপ্ত সোজা পথও আছে, তা হলো হিমালয় অতিক্রম করা। খুব অল্প মানুষই এই পথ দিয়ে যেতে পারবে, অনেকে এই পথের কথা জানেই না। কারণ হিমালয়ের ভেতর দিয়ে যে আটটি রাস্তা গেছে, তার মধ্যে এই পথটি নেই।’
‘আমাকে বলেন প্রভু, আমি কি কেদারনাথ পর্যন্ত যেতে পারব?’
‘খুব সহজে।’ তিনি বললেন, ‘তুমি তিন-চার মাইল পর পর এক-একটা বসার জায়গা পেয়ে যাবে। কিন্তু তোমার গরম কাপড় দরকার। তুমি যদি পছন্দ করো আমি তোমাকে গরম কাপড় কোথায় পাওয়া যাবে সেটা বলে দিবো। রাস্তায় তুমি অনেক সাধুর দেখা পাবে যারা বদ্রীনাথ এবং কেদারনাথ যাওয়ার পথ চিনেন। তারা তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। যাত্রাপথে তুমি অনেক মন্দির দেখতে পাবে। হিমালয়ের বদ্রীনাথ মন্দির অতি মনোহর, রাজপুতের পাহাড় থেকে ভিন্ন তার রূপ। হিমালয় তোমাকে নীরবতা দিবে, শান্তি ও আনন্দ দিবে। হিমালয় পর্বতমালা হলো পৃথিবীর সকল পাহাড়ের রাজা।’
তখন রাত দশটা, আমরা ঘুমাতে চলে গেলাম। পরেরদিন সকালে প্রভু যোগী পুরিজী চলে গেছেন বদ্রীনাথ, এটা দেখে খুব মন খারাপ হলো।
হস্তিনাপুর
হস্তিনাপুর বা ইন্দ্রপ্রস্থ প্রাচীন ভারতের রাজধানী ছিল, রাজা যুধিষ্ঠির ছিলেন তার শাসনকর্তা। এদের নাম মহাভারতে অনেকবার বর্ণিত হয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের স্মৃতিতে এরা অম্লান। এটা যেহেতু প্রাচীন শহর, মানুষকে এই শহর চুম্বকের মতো টানে, এখন এই শহর বিলীন হয়ে গেছে কিন্তু ত্রিশ মাইলজুড়ে শহরের প্রাচীর এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
আমি হস্তিনাপুরের শহরতলীতে এসেছি গরম কাপড় নেয়ার জন্য। প্রভু চলে যাবার আগে এই স্থানটির কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন কাপড়গুলো আমি বিনামূল্যে পাব। যখন আমি সেই বাড়ির দরজায় এলাম, আমাকে একজন দয়ালু মা অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি আমাকে আহারের জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন যেন আমি আগে তার রান্না করা খাবার খাই। ‘তুমি প্রভুর সাথে দেখা করার আগে এইরকম ভালো খাবার আর পাবে না।’ তিনি দয়ালু হয়ে আমাকে বললেন। খাবার পরে তিনি আমার জন্য এমন কাপড় আনলেন, যা আমি কখনও দেখিনি।
‘মাতা’ আমি আপত্তি করলাম, ‘এত গরম কাপড় আমাকে পরতে হবে না মনে হয়।’ আমার ওই কাপড় পরতে ইচ্ছা করছে না।
‘পুত্র। তুমি এই কাপড় পরলে নিশ্চয়ই খুব আরাম পাবে।’ তিনি হেসে বললেন, ‘কিন্তু তোমকে এখনই এই কাপড় পড়তে হবে না।’
কাপড়গুলো উটের পশমের তৈরি ছিল, তিনি আমাকে এছাড়াও আরও কাপড় দিলেন। আমি সানন্দে গ্রহণ করলাম। আমার যাত্রা সম্পর্কে এই মা সব জানেন মনে হলো এবং তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করে বললেন, ‘পুত্র, তুমি কেদারনাথ থেকে ফিরে এসো না। যদি তুমি ফিরে আসো তাহলে তুমি সবচেয়ে সুন্দর মন্দির দর্শন থেকে বঞ্চিত হবে। সামনে দিকে যাত্রা করবে। কোনো কিছুর ভয় করবে না, তুমি একজন মহান রক্ষাকারী পেয়েছ। তুমি চিন্তাও করতে পারবে না তুমি কত ভাগ্যবান। আমি দশ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিলাম, তুমি যুবক এবং আমি জানি তুমি হিমালয় পার হতে পারবে। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করলাম, পুত্র, যাও যাত্রা শুরু করো।’
যাত্রাপথের সম্মুখে আমি অসংখ্য গুহা দেখতে পেলাম। গুহাগুলো শুধু সাধু, মুনিরাই দেখভাল করেন। একটা গুহায় আমি সৌভাগ্যক্রমে একজন বৃদ্ধ লোককে পেলাম। আমরা একসাথে যাত্রা করেছিলাম, তিনি দেখার জায়গাগুলো আমাকে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন—ওই যে ওখানে ওই ঝুলানো পাথরের মেঝেতে সাধু কিন্নর বসেন, নিচে গভীর গিরিসঙ্কট, তিনি এখানে বসে সমধুর সুরে বাঁশি বাজান... ওই ওইখানে মহান ঋষি ব্যাসদেব ফাল্গুনে বসে বসে মহাভারত রচনা করতেন।
এই এখানে শ্রী রামের ভাই লক্ষণ, রামায়ন যুদ্ধে রাবনের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার পর কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। লক্ষণ তার ভ্রাতাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন, এই কারণে তিনি রামের প্রিয় বলে সুপরিচিত। লক্ষণ ভারতের তের জন মহান প্রভুর একজন, যার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা ছিল।
ভারতের আনাচ-কানাচ থেকে আসা যত যোগী, স্বামী, ঋষি, সাধু ও সন্ন্যাসী এই পবিত্র জায়গায় এসেছেন তাদের সাথে দেখা হলো। এক ব্যক্তির সাথে দেখা হলো যে আমাকে এবং আমার পরিবারকে চিনেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তিনি আমার আত্মীয়স্বজনকে আমার চেয়ে বেশি জানেন। আমি তার সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম এবং আমি কিছুই জানতে পারলাম না। আমরা স্বর্গ নামক এক আশ্রমে এলাম।
লক্ষণঝোলা জ্ঞান আহরণ করার একটা উপযুক্ত জায়গা। এখানে একটা ঝুলন্ত সেতু আছে, যা একজন সম্পদশালী ব্যক্তি নির্মাণ করেছিলেন। আমি সাধুবাবা কাবুলিওয়ালার গল্প শুনেছি অনেকবার, যিনি এই ধর্মশালাগুলো বানিয়েছিলেন সেসব মানুষদের জন্য, যারা বদ্রীনাথ ও কেদারনাথে যায়। আমার সহযাত্রী বন্ধু বদ্রীনাথে আমি কোনো সঙ্গী না পাওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গ দিতে চাইলেন। কিন্তু আমি তাকে বললাম, ‘প্রভু পুরিজী আমার সাথে বদ্রীনাথে দেখা করবেন। আর আমি একবার তাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলাম, যা আমাকে পীড়া দেয়। আমি প্রভুর সাথে মুক্তিনাথে যাব। আমি শুনেছি মুক্তিনাথ এখান থেকে অনেক দূরে।’
‘আপনি যদি নিরাপদ রাস্তা দিয়ে যান, আপনাকে তিব্বতের ভেতর দিয়ে যেতে হবে এবং এই যাত্রা শেষ হতে কমপক্ষে নয় মাস সময় লাগবে।’
‘কিন্তু প্রভু পুরিজী আমার সাথে হিমালয় পার হয়ে যাবেন। আমি উঁচু স্বরে বললাম।
একজন বন্ধু বললেন, ‘তাহলে, আপনাকে যাত্রাপথে আড়াই মাসের বেশি সময় ব্যয় করতে হবে না।
পরের দিন সকালে আমি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তুষারঘেরা পাহাড় আমাকে যেন ডেকে নিয়ে গেল। পাহাড় চূড়ায় সূর্যের আলো ঠিকরে পড়েছে। আমি বদ্রীনাথের পথে যাত্রা করলাম। যাত্রাপথে অনেক সহযাত্রী পেলাম এবং একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির সাথে পরিচয় হলো। সেও বদ্রীনাথ যাচ্ছিল। আমার অচেনা বন্ধুটিকে মনে হলো সে এই অঞ্চলের ইতিহাস এবং দর্শনীয় জায়গাগুলো চিনে, তার সাথে ভ্রমণ করতে পেরে আমি খুব আনন্দিত হলাম।
বদ্রীনাথ
আমরা আনন্দের সহিত বদ্রীনাথের পথে যাত্রা আরম্ভ করলাম। যখন ভাবছি বদ্রীনাথে পৌঁছে যাব, আমর শরীরে শিহরণ হচ্ছিল। শীঘ্রই আমি বদ্রীনাথে পৌঁছে যাব যেখানে মানুষ ভাবে সবাই তার ভাই এবং সব মানব এক।
আমরা প্রথম উখিমঠে থামলাম। উখিমঠ নগর অনিরুদ্ধের স্ত্রীর ঊষা নামে নামকরণ করা হয়েছে। ঊষা মহাভারতের যুদ্ধে খ্যাতি অর্জন করেন। এই নগরটি এখন বান রাজার রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকেই আমরা একটা গভীর বন পার হয়ে অল্কানন্দা উপত্যকায় পৌঁছাব। দুপুরবেলা আমরা জশিমঠ পৌঁছালাম। জশিমঠ হলো সন্ন্যাসীদের একটা মঠ, যা কিনা শংকরাচার্য বানিয়েছিলেন। দিনের শেষে আমরা বিখ্যাত হনুমান চটিতে যাত্রা থামালাম। হনুমান হলো বানর গোত্রীয়, হনুমানই সর্বপ্রথম ভারত থেকে লঙ্কায় বায়ুপথে গিয়েছিলেন, সে প্রায় দশ হাজার বছর আগে। হনুমান রামের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। পুরাকালে হনুমানের চটি মন্দিরটি যজ্ঞ করে পবিত্র করা হয়েছিল। এখনও সেই ছাই সংরক্ষিত আছে। এ থেকে বুঝা যায়, সেই দশহাজার বছর আগে কত হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।
অবশেষে আমরা বদ্রীনাথ এলাম! সুন্দর আর পবিত্র বদ্রীনাথ। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, আত্মিক শক্তির সৌন্দর্য। এখানে লোকেরা সত্যিকারের ভাই ভাই। এখানে কোনো শ্রেণিভাগ নেই। মা লক্ষ্মী যা খাবার দেন হিন্দু সম্প্রদায়ের চার শ্রেণির সব লোকেরা একসাথে আহার করে। তারা সবাই এখানে মিত্র আর এক। এটা ভাবতেই পারবেন না জাতপাত ভুলে যাওয়া হিন্দুদের জন্য কত কঠিন। উচ্চ জাতের হিন্দুরা নিচুদের খাবার খায় না। কিন্তু এই বদ্রীনাথে শতবছরের প্রাচীন অহমবোধ বিলুপ্ত। মানুষ একজনের সাথে একজন সমানভাবে সৌহার্দ্য বিনিময় করে—সবাই ভাই ভাই। এ যেন আত্মার জয়।
মহান প্রভু ভগবানজীর সাথে দেখা হলো বদ্রীনাথে। অনান্য যোগীদের কাছে প্রভু পুরিজীর বদ্রিনাথে আসার সময় জিজ্ঞেস করে জানলাম যে তিনি যেদিন রাতে আমাকে ছেড়ে এসেছেন তার পরেরদিন সকালে এখানে এসেছেন। একজন যোগী বললেন যে, তিনি জানেন না প্রভু কোন পথে এসেছেন, কিন্তু ওইদিন সকালে তিনি এই মন্দিরে বসেছিলেন তা দেখেছেন। আমি যে পথ আধা মাসে এসেছি, সেখানে তিনি মাত্র একরাতে পৌঁছেছেন!
আমার যখন তার সাথে দেখা হলো, তখন প্রভু ভগবানজী বক্তৃতা দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, যারা বদ্রিনাথে এসেছেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তাদের উদ্দেশে।
প্রভু বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, ‘আমার প্রিয় ভাইয়েরা, আমি সত্যি খুশি হয়েছি আপনাদের দেখে, যারা স্বর্গীয় জীবন উপভোগ করতে ইচ্ছা পোষণ করেছেন। পৃথিবীর সব বস্তুগত আনন্দ হলো পৃথিবীর আনন্দ, কিন্তু সব ইচ্ছা পরিহার করা হলো আসল আনন্দ। পরিহার শুধু বস্তু বা নিজেকে নয়, এটা হলো আত্মাকে পার্থিব জগত্ থেকে মুক্ত করা—অহংকার থেকে মুক্তি, ব্যক্তিগত ইচ্ছা থেকে মুক্তি। অনুশীলন করুন, দেখবেন পৃথিবীর কিছুই আপনার আর দরকার হবে না। কোনো কিছুর বশবর্তী হওয়া বা কোনকিছুর কাছে বশ হতে হবে না। লোভ থেকে আপনার হূদয় মুক্ত হবে।’
‘ভগবানের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলে, আপনি সব কিছু উপভোগ করতে পারবেন। চাওয়াকে মনের স্বচ্ছতা ঘোলাটে করতে দিবেন না যখন মনে আসবে আপনি কী সব পাচ্ছেন বা সবকিছু উপভোগ করতে পারছেন?’ মহাবিশ্বের কাছে নিজেছে উন্মুক্ত করুন, ক্ষুদ্র আত্মপ্রকাশের চেয়ে তা মঙ্গলময়। সবের মধ্যে আপনি। আর এই ‘সব’ হলেন ভগবান! আপন থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে ভগবানের পথে নিমগ্ন থাকুন। একাত্ম-জীবন মুক্তি-মহাবিশ্বের সবকিছুর ভেতরে গমন করুন, যা কিনা মহাবিশ্বের থেকেও উপরে, ভগবানের কাছাকাছি।’
এরপর প্রভু পুরিজী আমার জন্য চিন্তা করলেন, আমাকে বললেন মানস সরোবরে যেতে। সেখানে তিনি আমার সাথে দেখা করবেন।
মানস সরোবর হ্রদ
পরদিন সকালে আমরা বিখ্যাত মানস সরোবরে পথে রওনা হলাম। যোগীরা আমাদের আশীর্বাদ করলেন এবং আমরা বললাম, ‘আবার দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত বিদায়।’
এখন আমরা হিমালয়ের এক বিশাল চূড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছি যা নাকি বাইশ হাজার থেকে ঊনত্রিশ হাজার ফুট উঁচু। বিন্দু বিন্দু তুষায় কণায় চূড়াগুলো আচ্ছন্ন।
সামনে কোনো পথ নেই, আছে শুধু মন্দাকিনী নদী, তাকে অনুসরণ করে হাঁটছি। শুধু পশ্চিম থেকে বয়ে আসা বাতাস ছাড়া আবহাওয়া চমত্কার ছিল। আমাদের মধ্যে একজন যোগী সন্ত শান্তি আগে এই পথ দিয়ে যাত্রা করেছেন, কিন্তু আমরা দুজনে আগে আসিনি। যোগী শান্তি একেবারেই মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন, তাই আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা রাত কোথায় কাটাব?’
তিনি বললেন, ‘এখনও দশ ঘণ্টা বাকি, রাতের কথা এখন চিন্তা করছ কেন? যখন রাত আসবে আমরা বিশ্রামের জায়গা নিয়ে চিন্তা করব। তোমরা কি একটা কুকুর বা পাখিকে খাবার নিয়ে যেতে দেখেছ যাত্রাপথে? তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। এখন আজ রাত নিয়ে চিন্তা করা ছাড়, দেখো কী সুন্দর মোহনীয় পাহাড়। দেখো নদীগুলো কীভাবে গঙ্গার দিকে ছুটছে, যেখানে তাদের নাম থাকবে না, তার সব কিছু গঙ্গায় বিলীন হবে। আর গঙ্গা সাগরের দিকে দ্রুত বয়ে যাচ্ছে তার নাম হারানোর জন্য। এইসব পাহাড় আর নদীর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো, এদের থেকে অন্তসারশূন্যতা অনুধাবন করতে শিখো। বর্তমান নিয়ে ভাবো, ভবিষ্যত্ এমনি ঠিক হয়ে যাবে।’
তখন থেকেই আমরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপোভোগ করতে শুরু করলাম। এই বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সম্ভাবনা কল্পনা করতে থাকলাম, এই বিশাল অপরিবর্তনীয় পাহাড়। এত সুখ আর মানসিক শান্তি আমি আগে এমন পাইনি, যতটা পেলাম আজ হিমালয়ের কাছ থেকে। চারপাশে সুন্দরের অনুরণন, জীবনের জয়গান আর শান্তি। এটা খুব অবাক বিষয় নয় যে, এখানকার সব জায়গায় কোনো না কোনো ঋষি থেকেছেনই। আমরা যেখানে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, এখানে ঋষি নারায়ণ তার সমস্ত জীবন ব্যয় করেছিলেন এই পথে ধ্যান করে করে। এখানেই তিনি বসবাস করতেন! সব জায়গায় যেন মহান গুরুদের একটা ছোঁয়া লেগে আছে।
আমি যোগী শান্তিকে জিজ্ঞেস করলাম যে, তিনি জানেন কিনা এই পথ দিয়ে পঞ্চপাণ্ডব গিয়েছিলেন। ‘একবার না বহুবার,’ তিনি বললেন। ‘একবার তারা নিজেরা, একবার তাদের মায়ের সাথে আর একবার পতিব্রতা দ্রৌপদীর সাথে, যিনি নাকি নারী জাতির অহংকার।’
আমরা যেহেতু অনেক আনন্দ উপভোগ করছিলাম, আমরা বুঝতেই পারিনি যে তখন বিকেল চারটা বাজে। যোগী বললেন, ‘আমাদের আরও দুই ঘণ্টা হাঁটতে হবে, তারপর বিশ্রাম নিতে হবে সারারাত।’ দুই ঘণ্টার মধ্যে আমরা একটি ছোট গুহায় এলাম। যোগী শান্তি আমাদের সাথে না থাকলে হয়তো গুহাটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যেত। এর প্রবেশপথ এত ছোট যে, মাত্র একজন মানুষ প্রবেশ করতে পারে। ভোর চারটায় আমরা ঘুম থেকে জাগলাম। ধ্যান শেষ হতে হতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। এরপর আমরা বসে বসে সুন্দর দৃশ্যের প্রশংসা করতে লাগলাম যাত্রা শুরুর আগে।
যাত্রা শুরু হলো এবং অবশেষে আমরা মহাপ্রস্থান, শৈলশহরে উপনীত হলাম। সেদিন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমি পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম, আকাশে ছিল একটা বড় চাঁদ। আমি হঠাত্ শুনলাম কে যেন একটা শব্দ টেনে ‘ওম’ বলছে, তারপরে একই ভাবে বলছে ‘জয় কারা’। একটার পর একটা করে বারবার এই শব্দ শুনলাম আমি। আমার সঙ্গী যে নাকি খুব একমনে শান্ত হয়ে বসেছিল এবং তাই শব্দগুলো শুনতে পায়নি।
সেই শব্দ ধীরে ধীরে কাছে আসতে থাকল। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম—কী হচ্ছে, কিন্তু দুই ঘণ্টা পর সেই শব্দের কারণ বুঝা গেল। তারা হলেন পাঞ্জাবের মহান যোগীগণ যাদের সাথে আমার আগে দেখা হয়েছে। লোকে তাদেরকে বলে ‘জাতি তাপি পবন হারী দুদাধারী’। তারা সবসময় অনুতাপ করে পরিতৃপ্তি পান, দুধ খেয়ে জীবন ধারণ করেন, কিন্তু সবসময় শরীর সুস্থ রাখেন। এই যোগীরা কেবলমাত্র মানস সরোবর হ্রদ এবং মুক্তিনাথ থেকে এসেছেন, এবং তারা দার্জিলিংয়ে যাত্রা করছেন।
আমরা আরও একটা রাত মহাপ্রস্থরে থাকলাম তাদের যাত্রা সম্পর্কে জানার জন্য। সারাদিন আমি তাদের অনেকের সাথে কথা বললাম এবং দেখলাম তাদের অনেকেরই পা খালি এবং বেশিরভাগই কোমরের নিচে অল্প কাপড় পরিধান করা, কিন্তু তাদের মুখে কোনো কষ্টের লেশমাত্র নেই।
হঠাত্ করেই প্রভু ভগবানজী কোথা থেকে উপনীত হলেন, যা আমাকে অভিভূত করল। এটা খুবই আশ্চর্য অনুভূতি, কিন্তু কেবলমাত্র আমিই অবাক হয়েছিলাম তার আগমনে। অন্যরা তাকে এবং তার ক্ষমতা সম্পর্কে আগেই জ্ঞাত ছিলেন।
‘প্রভু, প্রভু’ আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললাম, ‘আপনি এক অবাক বিস্ময়, আপনি শ্রেষ্ঠ প্রভু।’
‘কেন পুত্র?’ তিনি বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি শুনেছি এবং পড়েছিও যে শরীরকে বাতাসে উড়িয়ে বহন করা যায় কিন্তু আমি কখনও কোনো মানুষকে এমন অলৌকিক কাজ করেতে দেখিনি।’ আমি খুব উচ্ছ্বাসের সাথে বললাম।
‘অলৌকিক!’ তিনি আপত্তি জানালেন, ‘এ তেমন কিছু না। যে কেউ এই কাজ করতে পারে।’
‘কীভাবে?’ আমি অবাক হলাম।
‘চর্চা’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘বার বছর বা তার কম সময়ের চর্চা হলেই হয়ে যায়।’
‘বলুন প্রভু, আপনি ছাড়া অন্য কেউ কি বাতাসে উড়ে যাত্রা করতে পারে? আপনি এখন এখানে, কিন্তু চোখের পলকে আপনি পাঁচশ অথবা হাজার মাইল চলে যেতে পারেন।’
‘বাছা, এই যে এখানে যারা বসে আছেন, তারা সবাই জানেন কীভাবে বাতাসে ভ্রমণ করতে হয় এবং তারা বায়ুপথেই এখানে এসেছেন। কাল রাতে তারা শতশত মাইল অতিক্রম করেছেন। অন্য কিছু মানুষের মতো তুমিও এখানে এসেছ যাদের জন্য এই দর্শন খুব বিস্ময়ের আর গুরুত্বপূর্ণ। এই যোগীগণ মহাপ্রস্থান থেকে তিন মাইল দূরে বায়ুযোগে নেমেছেন এবং সেখান থেকে স্তব করতে করতে হেঁটে এসেছেন। তুমি চাইলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখো আমি ঠিক বলছি কি না।’
আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করিনি, কিন্তু আমি জানি জিজ্ঞেস করলেই জানা হয়ে যেত। কিন্তু তা না, উপরন্তু তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি তাদের পাখি ভেবেছি কি না। কিন্তু যখন আমি নিশ্চিত করলাম আমি এই বিষয়ে জ্ঞাত, তখন তারা বায়ুযোগে এসেছেন বলে স্বীকার করলেন। তারা উঠে গেলেন প্রভুত গাছ আর বৃক্ষ সম্পর্কে প্রভুর বক্তৃতা শোনার জন্য।
প্রভু তার বক্তৃতা শেষ করলে তিনি ‘জাতি তাপি পবন হারি দুদাধারী’দের কাছে গেলেন এবং আমাকে বুঝানোর জন্য তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তারা কোথা থেকে এসেছেন। তারা বললেন তারা মুক্তিনাথ থেকে মানস সরোবর তারপর মহাপ্রস্থ থেকে এসেছেন। এটা ঠিক যে তারা এক লাফে একদিনে শতশত মাইল এসেছেন। আমি খুব সকালে যাত্রার জন্য উদ্গ্রীব হলাম কিন্তু প্রভু বললেন তিনি দুপুরের আগে যেতে পারবেন না, কারণ একজন বালক আসবে এবং সেও আমাদের সাথে সমবেত হবে। এই বালক কে জানতে আমি যোগী শান্তিকে জিজ্ঞেস করলাম, বালকের সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
‘একজন অল্পবয়সী বালক, মাসুত ভাহরা।’ তার গলার স্বর নিচু ছিল।
‘বেচারা, আমি যেখানে যাই সেও সেখানে যায়। তুমি তাকে দেখলে খুশি হবে। সে সবসময় হাসে ও গান করে।’
আমার কৌতূহল পূরণ হলো সকাল দশটায় যখন সেই হাসিমুখ বালক এসে উপস্থিত হলো। এমন আনন্দে ভরপুর, সারাক্ষণ গান করে আর মুখের উপর একটা মনোরম হাসি ধরে রাখে। আমি তার গান জাদুমুগ্ধের মতো শুনি। এই হাসি দুঃখী মানুষের দুঃখ হালকা করে, রোগীর আরোগ্য লাভে সহায়তা করে। সে যেখানেই যায় সেখানেই শান্তি আর প্রশান্তি বয়ে আনে। মাসুত ভাহরার মতো আমি এখন পর্যন্ত কাউকে দেখিনি যে নাকি অবিরতভাবে স্বর্গীর আনন্দ প্রকাশ করে। সে এমন এক বালক যার হূদয় ভয়শূন্য, এমনকি মৃত্যুভয় তার নেই, সে অক্লান্ত। মহাপ্রস্থান আসার আগে সে এক রাত এবং একদিনেরও বেশি হেঁটেছে, কিন্তু সে তখনই যাত্রার জন্য প্রস্তুত ছিল। অবশ্য প্রভু বালককে দুই ঘণ্টা বিশ্রামের জন্য নির্দেশ দিলেন। দুপুরে আমরা যখন যাত্রা শুরু করলাম, হাস্যময় বালক চতুর্থ সদস্য হলো আমাদের দলের। সে এমন একজন স্বভাব গায়ক, তার গানে সৌন্দর্য আর মিষ্টতা আমার বুঝানোর ভাষা নেই।
এক মাইল গিয়েছি এমন সময়ে যোগী শান্তি বালককে জিজ্ঞেস করলেন যে কেন সে নগরে অবস্থান করল না। বালক হেসে জবাব দিলো, ‘ওহে প্রভু, আমি যখন শুনতে পারি আপনি হিমালয়ের চারদিকে ভ্রমণ করবেন, তখন আমি নিজেকে কিছুতেই দূরে রাখতে পারি না। যেদিন থেকে আমি শুনেছি আপনি যাত্রা করছেন, সেদিন থেকেই আমি প্রতিদিন ষোল ঘণ্টা হেঁটেছি যেন আমি আপনার নাগালে আসতে পারি। আমি সেই জায়গায় এসেছি প্রভু, আমি যে সুন্দর জায়গাগুলো দেখার জন্য উদ্গ্রীব ছিলাম, যার কথা আপনাকে আমি বলেছি।’
হয়তো এই হাস্যময় বালকের কিছু ইতিহাস আমার পাঠককে জানালে তা তারা সমাদর করবেন। দশ বছর বয়সে বালক যোগী শান্তিকে তার গ্রামের এক গাছের নিচে বসে থাকতে দেখেছিল। তখন ছিল শীতকাল কিন্তু যোগী শান্তির গায়ে কোনো কাপড় ছিল না যা তাকে শীত থেকে রক্ষা করবে। বালকের তখনই মনে হলো সেও শিখবে কী করে এটা করা যায়। তাই সে প্রতিদিন যোগীর ঘরে আসত। কিন্তু এর একমাস পরে গিয়ে সে দেখে যোগী সন্তোখ শান্তি পুরো হিন্দুস্থান ভ্রমণ করবেন এই কারণে প্রস্থান করেছেন। তার প্রিয় প্রভু চলে গেছেন এবং কেউ তাকে বলতে পারছে না কোথায়। ভগ্ন হূদয় নিয়ে সে বাড়ি ফিরল এবং রোগশয্যায় শায়িত হলো।
তার বাবা-মায়ের কোমল যত্ন এমনকি হেকিমও তার রোগ সারাতে পারল না। তার মা খুব ভেঙে পড়ল এবং প্রার্থনা করল যে তিনি তার পুত্রের আরোগ্য লাভের জন্য, তার সুখ আর আনন্দের জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। ‘মা, তুমি কি আমার জন্য সব করবে?’ ছেলেটি উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ পুত্র, তোমার আরোগ্যের জন্য আমি সব কিছু করতে পারব।’
‘কিন্তু মা, আমি ভীত যে তুমি আমার জন্য একটা জিনিস করতে পারবে না।’ ছেলেটি বিষণ্ন মুখে বলল।
‘হ্যাঁ পুত্র, আমি যেকেনো কিছু করব তোমার আরোগ্যের জন্য।’ মা জবাব দিলেন।
‘তাহলে মা, তোমার কি সেই যোগীর কথা মনে আছে, যিনি এক বছর আগে এই গাঁয়ে অবস্থান করছিলেন?’
‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি তুমি কার কথা বলছ। অনেকবার আমি তোমাকে বলতে শুনেছি তাকে তুমি তোমার মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসো।’
‘তুমি জানো, তা সত্য। আমি তাকে পৃথিবীর যে কারো থেকে বেশি ভালোবাসি।’ ছেলেটি মিনতি করে বলল, ‘আমাকে তার কাছে যেতে দাও মা। আমি তাকে দেখলে সুখী হবো এবং আরোগ্য লাভ করব।’
দুঃখী মাতা কিছুই বললেন না, তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তিনি তার স্বামীকে সব বললেন। তারা ভাবলেন সময় হলে বালক যোগীর কথা ভুলে যাবে। কিন্তু মাসের পর মাস গেল বালকের রোগের কোনো পরিবর্তন হলো না।
প্রতিবেশীরা বালকের একটানা অসুখের কারণ জানতে পেরে তার বাবা-মাকে বলল বালককে যোগীর কাছে নিয়ে যেতে। পিতা-মাতা বালককে নিয়ে এ নগর থেকে ও নগরে ঘুরে অবশেষে পনের দিন পর যোগীকে পেলেন যিনি নিজের অজান্তেই এই বালকের রোগের জন্য দায়ী। হাস্যময় বালক প্রভু শান্তিকে দেখে খুব উচ্ছ্বাসিত ও আনন্দিত হলো। এবং তার শরীরের অবস্থার দ্রুত উন্নতি দেখে বাবা-মা তাকে ঘরে নিয়ে এলেন। হূদয়ের ইচ্ছা পূরণ হয়নি, তাই বালক আবার রোগে শায়িত হলো।
মাসের পর মাস বালকের রোগের আরোগ্য হলো না দেখে তার মাতা-পিতা আবার হন্যে হয়ে যোগী শান্তিকে খুঁজে বের করলেন এবং অনুরোধ করলেন যেন তিনি তাদের গাঁয়ে স্বল্প সময়ের জন্য অবস্থান করেন। কারণ তিনি ওই গাঁয়ে চিরদিন থাকতে পারবেন না। এখানেই তিনি তার প্রিয় শিষ্যকে ফেলে এসেছিলেন। এবার যখন যোগী শান্তি চলে এলেন, বালক তার পিছু পিছু পালিয়ে এলো। যখন বালক তার সন্নিকটে এলো, যোগী ভাবলেন, তার সাথে কড়া ব্যবহার করবেন। কিন্তু এই কড়া জবাবে বালকটি হেসে দিল এবং তাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হলো। যোগী সন্তোখ আদর করে বালককে ‘হাস্যময় বালক’ নাম দিলেন।
আমরা চারজনে বালকের গান হূদয়াঙ্গম করতে লাগলাম, আমি আর একজন গরম কাপড় পরিহিত ছিলাম। কিন্তু যোগী শান্তি এবং তার আদরের শিষ্যের গায়ে একটা পাতলা চাদরের মতো কাপড় কোনোমতে জড়ানো। আমি অবাক হলাম বালকের হাস্যোজ্জ্বল মন দেখে, মনে হচ্ছে সে একটা মন্দিরে সুন্দর পরিবেশে অবস্থান করছে। কিন্তু এটা মন্দির নয়, অসহ্য ঠাণ্ডা, আঠার হাজার ফিট উঁচুতে নন্দা দেবীর চূড়ায়। এই চূড়াটি আলোকজ্জ্বল এবং অন্যরকম, প্রবাহিত তুষার বাতাস একে জীবন দান করেছে। নন্দা পাহাড়ে গান গাইতে গাইতে আমরা জীবন্ত অনুভব করলাম। নন্দা দেবী একজন প্রজ্ঞাশীল নারী ছিলেন, যিনি এই পাহাড়কে গৃহ মনে করতেন। ঋষিরা তাকে সম্মান করে এই চূড়ার নাম দিয়েছিলেন নন্দা। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে অন্য কোনো বা আরও বেশি উঁচু চূড়া আর দেখা যাচ্ছে না। আমাদের অনুভব হচ্ছে যে আমরা মহাবিশ্বের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি।
তুষারের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমরা এবং আমি দেখলাম যে বালকের জুতা যার সুখতলা মহাপ্রস্থান থেকে খুব খারাপ অবস্থা ছিল, ওর পায়ে নেই। পা খালি। আমি ওর পায়ের কথা চিন্তা না করে থাকতে পারিনি। আমি আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, ‘তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?’
হেসে সে জবাব দিল যে সে জুতা পরে না। তার পায়ে যেটা ছিল তা একটা শক্ত চামড়ার মতো মনে হচ্ছিলো। সে বলল, ‘আমার পা-কে মনে হচ্ছিল কোনো প্রাণীর পা। পায়ের কথা বাদ দাও। আমার ঠাণ্ডা লাগছে না এবং চলো আমরা পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করি।’
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমরা যোগী শান্তিকে ধরে ফেললাম, তিনি আমাদের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। তিনি যখন বালকের খালি পা দেখলেন, বসে পড়লেন, নিজের জুতা খুললেন এবং বালককে দিলেন। বালক নিতে চাইল না। বলল, সে এই ঠাণ্ডায় মরে যাবে কিন্তু প্রভুর জুতা পরিধান করবে না।
‘প্রভু।’ সে অনুনয় করল, ‘দয়া করে আপনার জুতা আপনার পায়ে রাখুন।’
যোগী শান্তি কর্ণপাত না করে হেঁটে গেলেন। বালক পাদুকা জোড়া তার ঘাড়ে বাঁধল। সে কিছুতেই তার প্রভুর জুতা পরবে না।
ওইদিন রাতে আমরা পাহাড় পার হয়ে এবং হিমালয়ের মাঝখানের রাস্তা ধরলাম সুন্দর মানস সরোবর হ্রদের দিকে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম আমাদের পথে কে এত গুহা বানিয়ে রাখল, প্রতি রাতে আমাদের গুহা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়নি। যোগী শান্তি সবসময় সঠিক জায়গা চিনতেন।
রাতে আমরা আরাম করে গুহার ভেতরে হেলান দিয়েছিলাম। যোগী শান্তি ধ্যানে বসলেন। যখন তার ধ্যান ভাঙল, তিনি বালককে এক জোড়া নতুন জুতা এগিয়ে দিলেন। আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। এখানে তো কোনো গ্রাম নেই, এই জুতা উনি কোথা থেকে পেলেন? এটা তার ক্ষমতা ছাড়া কিছু নয়! এভাবেই যোগী শান্তি তার প্রিয় শিষ্যের জন্য একজোড়া নতুন জুতা এনেছেন! তিনি কামবীরের মতো শক্তি দেখালেন। কামবীর একদিন তার শিষ্যদের সাথে বসেছিলেন, হঠাত্ তিনি পানির পাত্রটাকে উলটে দিলেন। বিস্মিত শিষ্য জিজ্ঞেসা করল কেন তিনি সুপেয় পানি ফেলে দিলেন। কামবীর উত্তর দিলেন মথুরা জ্বলছে, এবং তিনি আগুনের উপর পানি ঢেলে দিলেন মথুরাকে বাঁচানোর জন্য। শিষ্য তার কথা বিশ্বাস করল না ভেবে তিনি শিষ্যকে মথুরা পাঠালেন। শিষ্যটি মথুরায় গিয়ে দেখল মথুরার কিছু অংশ পুড়ে ছাই হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে বুনো আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল এবং কামবীর সঠিক সময়ে এসে মথুরাকে রক্ষা করেছেন। কামবীর তার আত্মাকে প্রবাহিত করে অগ্নি নির্বাপন করেছিলেন। আমি ভাবলাম যে যোগী শান্তি ঠিক একই উপায়ে তার প্রিয় শিষ্যের জন্য একজোড়া জুতা এনেছেন।
অনেকদিন হলো আমরা কোনো লোকজন দেখিনি। তিব্বত আমাদের সামনে খুলে পড়ল যেন। গরু-মহিষের পাল চরে বেড়াচ্ছে। তিব্বতীরা এই পশুগুলোকে গ্রীষ্মের চারণভূমিতে নিয়ে এসেছে। কিছুদিন পর আমরা মানস সরোবরে এলাম যেখানে আমরা একজন যোগী এবং একজন তিব্বতীর দেখা পেলাম। তিব্বতী লোকটি ভাঙা ভাঙা সংস্কৃত আর হিন্দুস্তানি ভাষায় কথা বলে। যখন যোগী শান্তি তাদের সাথে কথা বলছিলেন, আমরা মানস সরোবরের মনোহর সৌন্দর্য অনুধাবনে মশগুল ছিলাম।
আমরা প্রায় চার ঘণ্টা স্বচ্ছ পাহাড়ের পাদদেশে হ্রদের পাশে বিশ্রাম নিলাম। হূদ দেখে মনে হলো একটা রত্ন চারপাশের পাহাড়ের সবুজ আর তুষার ঘেরা চূড়ায় প্রতিফলিত হচ্ছে।
আরও একঘণ্টা হাঁটার পর আমাদেরকে ছোট একটা মন্দিরে অভ্যর্থনা জানানো হলো। যোগীদের একটা ছোট দল আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। তাদের মধ্যে মাত্র দুইজন রয়ে গেলেন সেখানে, যাদের সাথে মানস সরোবরে সাক্ষাত্ হয়েছিল। সূর্যের আলো আমাদের ঠাণ্ডা শরীরকে গরম করে তুলতে লাগল। দিনগুলো অনেক আরামদায়ক হলেও রাতে ঠাণ্ডা নেমে আসতে লাগল।
পরেরদিন সকালে একজন বৃদ্ধ লোক বলল যে, তিনি প্রভু ভগবানজীর সাথে কথা বলেছেন কাল সন্ধ্যায়, তিনি পনের দিনের আগে এখানে আসতে পারবেন না। তিনি আমাদের কাছে খবর পাঠিয়েছেন। যদি আমরা থাকতে চাই, এই কয়দিন মন্দিরে বিশ্রাম নিতে বলেছেন।
আমাদের সেই ছোট মন্দির দর্শন কাল ছিল তিন দিন। আমরা আমাদের লম্বা জটা আর কাপড় ধুয়ে সময়গুলো কাটালাম। হাস্যময় বালক তার চুল ভিজাতে চাইল না। সে বলল যে পানিতে ভিজালে চুল বড় হবে না, সে বড় জটা চায়। সে তার চুল ছাই দিয়ে পরিষ্কার করল। আমি কয়েকজন যোগীদের দেখেছি যাদের জটা দশ পনের ফুট লম্বা তারা ছাই দিয়ে চুল ধৌত করে। হয়তো ছাই চুল বড় করতে সাহায্য করে।
এই মনোরম মানস সরোবর, গান গাওয়া পাখি, এই মনোহর মন্দির আমাকে লোভান্বিত করছিল যেন এখানে থেকে যাই। কিন্তু যোগী শান্তি বললেন যাত্রা শুরু করতে হবে। আমি এই হ্রদের ইতিহাস জানতে চেয়েছিলাম, তিনি তা এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু তার চোখে দেখে মনে হচ্ছে তিনি রহস্য করছেন। অবশেষে তিনি স্বীকার করলেন যে প্রভু ভগবানজী আমাকে সব খুলে বলবেন।
‘কিন্তু কোথায়?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘মুক্তিনাথে।’ তিনি জবাব দিলেন।
‘আমাদের একদম সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।’ তিনি আরও বললেন, ‘মুক্তিনাথ এখনও অনেক দূর এবং যেতে যেতে আমরা এর থেকে সুন্দর মন্দির দেখতে পাব। তুমি পোড়া তাত সাঙ্গা মন্দিরে, যে মন্দির সব থেকে উঁচু মন্দির সেখানে কিছু কালক্ষেপণ করতে চাইবে। যাক গে।’ তিনি আমার দিকে প্রখর চোখে তাকালেন।
‘এখানে এমন কী আছে যার জন্য তুমি যাত্রা শুরু করতে চাচ্ছ না?
‘খাদ্য।’ আমি দ্রুত উত্তর দিলাম।
‘ঠিক আছে, প্রতিদিন তুমি একই রকম খাদ্য পাবে যদি তুমি আসলেই অনেক পছন্দ করো।’ তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন। তিব্বতের যোগীরা আমাদেরকে প্রবেশানুমতি নিতে বলছিল যাতে আমরা এই অজানা দেশে পথে কোনো বিপদে না পড়ি। ধার্মিক বৃদ্ধ লামা বসে আমাদের জন্য দুইটা অনুমতিপত্র দিলেন। আমি তাকে সংশোধন করে দিয়ে বললাম, ‘আমরা চারজন। বালক আর যোগী শান্তিরও অনুমতিপত্র দরকার।’
লামা বললেন, ‘তাদের প্রবেশানুমতিপত্রের দরকার নাই। তোমার এবং তোমার সহযাত্রীর দরকার, বিশেষত তোমরা যদি যোগী শান্তি আর বালক থেকে আলাদা হয়ে যাও। এটা দেখালে তোমরা তিব্বতের যেকোনো জায়গায় ঢুকতে পারবে।’
আমরা একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম এবং আলাদা হয়ে গেলাম।
মুক্তিনাথ
অনিচ্ছাকৃতভাবে আমি মানস সরোবর হ্রদ থেকে বিদায় নিলাম, যে সরোবরের ধারে ছোট ছোট বাড়ি আর লোকের সমাগম। আমার অনিচ্ছা দেখে যোগী সন্তোখ আমাকে ভর্ত্সনা করলেন। ‘আরে আসো, তুমি এই সরোবরকে না ভুলতে পারলে তুমি যা করতে এসেছিলে তা পারবে না। এখনও দেখার আছে অনেক কিছু।’ যোগীর স্বর নির্দয় শুনালো।
‘মন্দির ছাড়া কি আর কিছু আছে?’ আমি অনিচ্ছাভরে উত্তর দিলাম।
‘প্রভু ভগবানজী তোমাকে আরও আশ্চর্য জিনিস দেখাবেন।’ তার গলায় তিরস্কার।
প্রভু পুরিজীর কথা শুনে আমার মনে পড়লা যোগী শান্তিকে আমার জিজ্ঞেস করা উচিত, কেন প্রভু সরাসরি তার বার্তা যোগী শান্তিকে দিলেন না?
‘কারণ আমরা লামার অতিথি, একমাত্র প্রভুই পারেন তার সাথে কথা বলতে।’
এই কথাতে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। অনেকগুলো যাত্রাপথ থাকতেও যোগী এই সংক্ষিপ্ত পথ বেছে নিয়েছেন যদিও এই পথে জনবসতি কম। পথ থেকে হাস্যময় বালক আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘রাত নেমে এল বলে, আমার প্রভুকে তোমার জন্য ভালো খাদ্য দিতে ভুলো না যেন।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ বন্ধু আমাকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য কিন্তু আমি মানস সরোবরের এই খাবার আর পাব না!’
‘কেন নয়?’ বালকের মনোকষ্ট হলো এবং সে অবাকও হলো, ‘তোমার কি মনে হয় না আমার প্রভু তোমাকে এই খাবার এনে দিতে পারবেন?’
আমি নম্রভাবে দ্রুত বলে দিলাম, ‘আমি বিশ্বাস করি তিনি পারবেন, অবশ্যই।’
আমরা সেদিন পনের মাইল হাঁটলাম এবং রাতে আমরা খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখন রাত আটটা বাজে। যোগী তার শরীর কম্বল মুড়ে ধ্যানে বসেছেন, প্রায় আধা ঘণ্টা হবে। আমি চাচ্ছিলাম তার ধ্যান ভাঙুক তাহলে আমি তার কাছে খাবার চাইতে পারব। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে ডাকলেন, ‘ঋখী, ঋখী, এখানে আসো, তোমার খাবার তৈরি।’
আমি সেখানে গিয়ে তার হাত থেকে গরম সুস্বাদু খাবার নিলাম। অন্যরাও পেলো এবং যোগী শান্তিও আমাদের সাথে রাতের খাবার সম্পন্ন করলেন। তিনি খেলেন, এত কম যা নাকি ছয় বছরের শিশুর খাবারের সমান।
রাতে খাবারের পর হাস্যময় বালক আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কি তার প্রভুর খাবারে সন্তুষ্ট কি না। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললাম, ‘অবশ্যই।’
তখন থেকে আমরা মুক্তিনাথ যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যায় যোগী শান্তির কাছ থেকে গরম গরম সুস্বাদু খাবার পেলাম। তিনি এই খাবার রান্না করেননি এবং আমিও জিজ্ঞেস করলাম না এই খাবার উনি কোথা থেকে এনেছেন। এই খাবারগুলো সাধারণত ভারতের খাবার। কিন্তু আমি মনে রাখলাম এবং ভাবলাম ভগবান পুরিজীকে জিজ্ঞেস করব এই খাবার যোগী শান্তি কোথা থেকে এনেছেন।
প্রায় একমাস পরে আমরা মুক্তিনাথে পদার্পন করলাম। সাধারণত আমরা দিনে দশ থেকে পনের ঘণ্টা হাঁটি, এবং পথিমধ্যে কোনো মানুষ দেখতে পাই না। কিছু কিছু সময় কিছু পথিক দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু তারা দেখতে দেখতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়।
আমি মুক্তিনাথ মন্দির খুঁজলাম এবং কিছুই দেখতে পেলাম না। চীত্কার করে বললাম, ‘মুক্তিনাথ কোথায়?’
‘এখানে!’ এই বলে যোগী শান্তি একটা গুহার মুখে আমাকে নিয়ে গেলেন। এবং আমি যোগীদের অভ্যর্থনা জানানো দেখে মুগ্ধ হলাম। তাদের মধ্যে যোগী ভগবানজী ছিলেন দেখে আমি খুব আনন্দিত হলাম।
এটা একটা প্রাকৃতিক গুহা, কিন্তু গুহার গায়ে আঁকিবুঁকি করা। সকালবেলা আমি প্রভু পুরিজীকে যোগী শান্তির দেয়া খাদ্যভাণ্ডারের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে বললাম, ‘খাবারগুলো খুব চমত্কার রান্না করা ছিল, প্রভু!’
‘কেন পুত্র, তিনি কি তোমাকে কেদারনাথ থেকে মানস সরোবের আসার পথে ভালো খাদ্য দেননি?’
‘না,’ আমি উত্তরে বললাম, ‘আমরা কেদারনাথে এসে ছোলা খেয়েছি।’
‘শুনে খারাপ লাগল, তোমাদের শুধু ছোলা খেয়ে অনেক দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে,’ তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, ‘আমি সবকিছু ব্যাখ্যা করব কিন্তু এখন না। এখানে ভারত আর তিব্বত থেকে অনেক যোগী এসেছেন, তারা চান আমি ধ্যান নিয়ে তাদেরকে কিছু বয়ান করি।’
প্রভুর বয়ানের পর আমরা বসে ধ্যান করলাম। পাঁচ মিনিট পরে একটা অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলাম। এই ধ্যান আমাদের আত্মাকে শরীরের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেল। আমরা দশজন ছিলাম শিক্ষানবিস এবং আমরা এই চমত্কার শিহরণ অনুভব করে বিস্মিত হলাম।
সম্ভবত এক ঘণ্টা পরে প্রভু পুরিজী স্তব করা শুরু করলেন, তার সাথে একে একে সবাই শুরু করল। এগারটার দিকে যোগীরা আমাদের ছেড়ে গেলেন কিন্তু আমরা জানলাম না তারা কোথায় গেলেন। পরের দিন দুপুরের আগ পর্যন্ত আমরা তাদেরকে দেখলাম না।
আমি অনেক আশ্চর্য, অবিশ্বাস্য শক্তি দেখলাম যোগীদের। একটা ঘটনা—আমরা কথা বলার জন্য দাঁড়ালে একজন যোগী উধাও হলেন। পাঁচ মিনিট পরে আমরা একজন মাথাহীন লোককে আমাদের কাছ থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মস্তকহীন লোকটি একবার অদৃশ্য হলেন আবার যোগী হয়ে পুনরায় আমাদের মাঝখানে উপস্থিত হলেন। ছোট হতে হতে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অদৃশ্য হতে হতেই তিনি আবার মস্তকহীন এবং হস্তহীন হয়ে উপস্থিত হলেন। নিবিষ্ট মনে আমি প্রথমে এক হাত, তারপর আরেক হাত এবং অবশেষে মাথা দেখতে পেলাম। এবং সেই যোগী আবার আমাদের মাঝখানে হাজির হলেন। আরেকটি ঘটনা। আমি একজন যোগীর সাথে কথা বলছিলাম। সে হঠাত্ বলল, ‘দেখো এইদিকে। আমি ওইদিকে তাকালাম কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না এবং আমি তাকে পেছন ফিরে বলতে গেলাম না আমি তো কিছুই দেখছি না। কিন্তু দেখি যে যোগীর সাথে কথা বলছিলাম সে নেই! আমি তাকে খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। যেদিকে সে আমাকে তাকাতে বলেছিল আমি ওই দিকে তাকিয়ে একটা সিংহ দেখতে পেলাম। আমি চিত্কার করে বললাম, ‘সিংহ! একটা সিংহ!’ কেউ আমার কথা তোয়াক্কা করল না শিক্ষানবিসরা ছাড়া। আমি নিশ্চিত এটা একটা সিংহ ছিল, একটা স্বাস্থ্যবান সিংহ এবং আমি খুব বেশি ভয় পেয়ে গেলাম। সিংহটি আমার দিকে দ্রুত এগিয়ে এলো, পরেই পিছু হটে গেল। কিন্তু খুব কাছে এলো না। সিংহটি কিছুক্ষণ পরে হরিণ হয়ে গেল দেখে আমি খুব আনন্দ পেলাম। আমরা হরিণটির কাছে গিয়ে আদর করতে লাগলাম। একজন তার জন্য খাবার এবং একজন তার জন্য পানি আনতে গেল। হরিণটিও কৃতজ্ঞতাভরে খেলো এবং পান করল। আমরা ত্রিশজনে মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে দেখে চোখ জুড়ালাম। তার সুন্দর আর লাজুক ভঙ্গী আমাদের মন কেড়ে নিলো।
কিছুক্ষণ পরেই আমরা দেখলাম একজন শিকারি, হাতে বন্ধুক নিয়ে গুলি ছুঁড়ল। হায়! আমাদের সেই সুন্দর হরিণটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি, হরিণটি মরে গিয়েছে। আমাদের খুব রাগ হলো এবং শিকারির দিকে তেড়ে গেলাম, এই অসহায় প্রাণীটিকে কেন মারল সে। ‘তোমার কি কোনো হূদয় আছে, তোমার তো লজ্জা পাওয়া উচিত, তোমার মতো এই প্রাণীটিরও বাঁচার অধিকার আছে না?’ আমরা রেগে তাকে প্রশ্ন করলাম। সে চতুরভাবে উত্তর দিলো, ‘আমি অনুভব করছিলাম, এই প্রাণীটিকে মারার অধিকার আমার আছে।’
আমরা এরপর শিকারিকে ধরে নিয়ে প্রভুর কাছে গেলাম। আমরা তাকে সব ঘটনা খুলে বললাম যে, আমাদের খুবই কষ্ট লেগেছে যে, এই শিকারি হরিণটিকে মেরে সীমালঙ্ঘন করেছে।
প্রভু শান্ত স্বরে আমাদের উত্তর করলেন, ‘আমি দেখে কষ্ট পেয়েছি যে, তোমরা সবাই এই হরিণটির মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছো। তোমরা কি জানো না ভগবত গীতায় বলা হয়েছে, ‘আমি একজন মানুষ মেরেছি অথবা সে একজন মানুষ মেরেছে’ তারা উভয়েই কি ভুল? যে ব্যক্তি বলেছে, দেখো দেখো, আমি একজন মানুষ খুন করেছি! অথবা যে ব্যক্তি বলবে, দেখো আমি নিহত! তারা দুইজনে কিছুই জানে না। আত্মা কখনও জন্মায়নি, আত্মা কখনও বাধিত হয়নি, কোনো সময়েই না, আদি এবং অন্ত হলো অলীক। জন্মহীন আর মৃত্যুহীন, পরিবর্তনহীন থাকবে আত্মা সবসময়! মৃত্যু তাকে সপর্শ করবে না! যে জানে সে ক্লান্তিহীন, একাই বাঁচে, অমর, অবিনশ্বর, সেকি বলবে, ‘আমি একজন মানুষ হত্যা করেছি অথবা হত্যার কারণ হয়েছি?’
প্রভু যখন গীতার পুরো অধ্যায় পড়ছিলেন বারবার এবং আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন শিকারি অদৃশ্য হয়ে গেল। এবং তখন আমরা হরিণ হত্যার আসল বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে পারলাম। আমাদের কেউ কেউ জঙ্গলের ভেতরে গেল কিন্তু হরিণের আর সেখানে দেখা মিলিল না ! আমরা মন খুলে আনন্দ করলাম এই ভেবে যে গীতা বুঝার জন্য যোগী আমাদের কীভাবে বোকা বানিয়ে দিলেন। মন্দিরে আমি সেই অদৃশ্য যোগীকে দেখতে পেলাম। আমরা তাকে হরিণটির কথা জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু সে আমাদের কথা গায়ে মাখালো না। ‘আপনি কোথায় ছিলেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সে হেসে উত্তর দিলো, ‘আমি পায়চারী করছিলাম।’
পোড়া তাত সাঙ্গা মন্দির
ভারত এবং তিব্বতের মধ্যবর্তী সবচেয়ে বড় শহর শিগস্তে। এটা তিব্বতের দ্বিতীয় বড় শহর। এই শহর থেকে প্রায় এক মাইল পরের সন্ন্যাসী মঠটি এখানকার বিখ্যাত।
রাত গভীর, অথচ ঘুমানোর স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। আমাদের সামনে এক ব্যক্তি হেঁটে যাচ্ছিল, যোগী শান্তি তাকে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কোথাও ঘুমানোর জায়গা পাব কি না। লোকটি বলল, ‘আপনারা আমার দরিদ্রশালায় বিশ্রাম নিতে পারেন।’ যোগী শান্তি আমাদের হয়ে বললেন, ‘হিমালয়ের ঠাণ্ডা বাতাস আর হিমালয়ের শীতল বরফ থেকে যেকোনো আশ্রয় পেলে আমরা খুশি হবো।’
লোকটির বাড়ি কাছেই ছিল, উনুনে আগুন জ্বলছিল, মনে হচ্ছিল এই আগুন আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। আমরা উনুনের পাশে বসে নিজেদেরকে গরম করলাম। আমাদের আশ্রয় দেয়া লোকটি আমাদের জন্য গরম খাবার রান্না করল, এতে আমরা আনন্দিত হলাম। আমরা সবাই উনুনের পাশে গোল হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম এবং খুব ভোরে আমরা আশ্রয়দাতাকে উপরের ঘরে প্রার্থনা করতে শুনলাম। তারপর সে দুধ গুলাতে লাগল এবং আমাদের মাখন দুধ খেতে দিলো। সকালের নাস্তা শেষ হলো, আশ্রয়দাতা আমরা কোথায় যাব জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম, আমরা ভারতের সব চেয়ে উঁচু মন্দিরে যাব।
‘কিন্তু তোমাদের তাশি লানপো লামা মঠ না দেখে যাওয়াটা ভুল হবে।’ আশ্রয়দাতা মনে করিয়ে দিলো। যোগী শান্তি বললেন, ‘আমরা আসলেই মঠটি দেখতে চাই।’ সকাল নয়টায় আমরা তাশি লানপোর দিকে রওনা হলাম।
এটা একটা বিলাসবহুল এবং প্রসিদ্ধ মন্দির, ক্লান্ত মানুষের আশ্রয়ের একটা আদর্শ জায়গা। আমরা খুব শ্রান্ত অনুভব করলাম, শান্তি অনুভব করলাম যখন আমরা বারান্দা দিয়ে ঢুকছিলাম, মঠটি আমাদের সান্নিধ্য দিচ্ছিল। যেসব লামারা আগন্তুকদের খুব সাদরে গ্রহণ করছিলেন আমরা তাদের কাছে আমাদের পরিচয় দিলাম না। পাঠকদের বলে রাখা ভালো যে লামা আর যোগীরা একই মতাদর্শে বিশ্বাসী না। লামারা শুধু বুদ্ধকেই বিশ্বাস করে কিন্তু যোগীরা কোনো নির্দিষ্ট মানবের অনুসারী নয়। যোগীরা মনে করেন সব মানুষ সব জ্ঞান ধারণ করেন। কিছু কিছু সময় প্রত্যেক মানুষের ভেতরের এই ক্ষমতা উন্মোচিত হয় এবং বুঝতে পারে। বৌদ্ধরা গৌতম বুদ্ধের মতো দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে উঠে নির্বাণ অর্জনের চেষ্টা করেন। একজন খ্রিষ্টান যিশুর চিন্তাচেতনা অর্জন করতে চান, একজন মুসলিম মুহাম্মদকে অনুসরণ করতে চান, একজন হিন্দু কৃষ্ণের জয়গান করেন। হিন্দুরা নিশ্চিত যে কৃষ্ণ, বুদ্ধ আর যিশু সবাই এক। তারা তোমার ভেতরে থাকেন, তোমার স্রষ্টা তোমার ভেতরে।
লোকমুখে প্রচলিত যে স্রষ্টা মানুষকে তার নিজের আদলে সৃষ্টি করেছেন।
তিব্বতীদের স্রষ্টা আছে; চীন, জাপান, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা সকলের আলাদা আলাদা স্রষ্টা আছে। হিন্দুদের অনেক দেবদেবী আছেন। মৃত্যুদেবী, জ্ঞানের দেবী, অগ্নিদেবী। সবার জন্য (হিন্দুরাসহ) এসব দেবদেবী সম্পর্কে জানা খুবই কষ্টকর, যদি না তারা উপনিষদ জানেন। সব দেশেরই স্রষ্টা আছেন। আমি হতভম্ব হয়ে ভাবছি, তাহলে কি করে স্রষ্টা নিজের আদলে মানুষ সৃষ্টি করেছেন!
আলাদা নাম এবং আলাদা স্রষ্টা। সবাই দাবি করেন যে, ‘আমার স্রষ্টা তোমার স্রষ্টা থেকে মহান।’ এটা দেখে আমার মনে হয়, মানুষ নিজের মতো করে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছে!
শিগস্তের পরে, যোগী শান্তি আমাদের তাড়া দিলেন যে, আমরা যেন আমাদের প্রভু ভগবানজীর সাক্ষাত্ স্থলে অতিসত্ত্বর পৌঁছে যাই। তিনি বললেন, এক সপ্তাহের বেশি পথ হাঁটতে হবে সেখানে পৌঁছাতে। এবং সেখানে পৌঁছানোর পর আমরা সেখানে বেশ কিছুদিন থাকব।
‘কেন?’ আমি তত্ক্ষণাত্ জিজ্ঞেস করলাম।
‘সেখানে তুমি খাড়া পাহাড়ের উপরে একটা মন্দির দেখতে পাবে, যা নাকি সেই খাড়া চূড়া থেকে পঁচিশ শত ফুট উঁচু। এই মন্দিরে ওঠা খুব ভয়ানক ব্যাপার, একবাড় পা ফসকে গেলে তুমি হাজার ফুট নিচে পড়ে যাবে। কিছু মানুষ ওঠার চেষ্টা করেছিল, দড়ি বেঁধে উঠতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। এ বছর যোগীরা কোনো কিছু ছাড়াই উপরে উঠে তাদের শক্তি প্রদর্শন করবেন। তুমি এই প্রদর্শনীর সাক্ষী হবে।’
তার কথায় আমরা খুব উত্সাহ পেলাম এবং এই কল্পনা করে আমরা মনে মনে উত্ফুল্ল হয়ে উঠছিলাম।
আটটায় আমরা গিয়ান্সের দিকে রওনা হলাম। হয়তো আমরা ওখানে একটি রাত যাপন করব। সবুজ ঘাস আর মসের ঘনত্ব কমে এলো। আমরা এভারেস্টের প্রায় কাছে চলে এলাম। আমরা রুপালি চূড়া দেখে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে গাইলাম,
‘আমার হিমালয় পৃথিবীর চেয়ে উঁচু,
আমার লক্ষ্য তাকে জয় করা।’
গিয়ান্সে শহরে আমরা বৌদ্ধ মন্দির পরিদর্শন করলাম। বিশাল এক দালান বাড়ি। এর রং দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাচীরচিত্রের ভাণ্ডারগুলোর মতো। আমরা প্রায় একদিন ধরে এই মন্দির দেখলাম এবং লামাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করলাম।
পোড়া তাত সাঙ্গাতে আমাদের সাথে প্রভু ভগবানজী যোগ দিবেন। যাওয়ার পথে আমরা কাঙ লা এবং ফাড়ি পাহাড়ের চূড়া পার হলাম। আমরা সবাই উদ্দীপনায় ভরপুর ছিলাম এবং এই যাত্রা আমাদের কাছে কম কষ্টকর হলো। কারণ আমাদের মনের ভেতরে উদ্দীপনা ভরে ছিল।
চমলহারি (২৪০০০ ফুট) পাহাড়ে ওঠা অসম্ভব মনে হলো। ফাড়ি চূড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে থেকে ১৬০০০ ফুট উঁচুতে এবং এর চূড়ায় গিয়ে আমরা অভিভূত হলাম। চূড়ায় নয়নাভিরাম উপত্যকা, চিরসবুজ বনভূমি। অনেক দূরে গ্রাম দেখা যায়, আর তার ভেতরে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দির।
চূড়ার সম্মুখভাগ আমাদের অভিভূত করল কিন্তু যোগী শান্তি বললেন আমরা সে পথ মাড়াব না। তার বদলে টেমো লো আর টাচি চো ঝং পাহাড়ের পথে যাব। এরপরে দেখা মিলবে পোড়া তাত সাঙ্গার!
যাত্রাপথ সন্তোষজনক মনে হলো এবং আর খাড়া পথ মাড়াতে হবে না ভেবে মনে প্রশান্তি নামল। উপত্যকার দু পাশজুড়ে বৃক্ষের সারি, একটু দূরে যেতেই আমরা খুব সুন্দর একটা বনের দেখা পেলাম। এমন ঘন বন আর তার পত্রবহুল বৃক্ষের সারি দেখে মনে হলো এমন সমৃদ্ধ বন আমি আগে দেখিনি। এখানকার জলের প্রাচুর্য আমাদের আনন্দ দিলো, নিশ্চিন্ত করল; কারণ এই বন জল আর গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল, বুনো গন্ধ আর পাখির গানে মাতোয়ারা ছিল বনটি। খুব অবাক ব্যাপার এ যাত্রায় একটাও বন্য প্রাণীর দেখা পেলাম না।
আমাদের পরবর্তী আকর্ষণ একটা দুর্গে ঘেরা মন্দির, যা কিনা মহামুনিতে। তার অপরূপ রূপ আমাদের মন হরণ করে নিলো। আমরা ওখানে কটা রাত্রি যাপন করলাম। পরের দিনের প্রভাত ছিল শেষ যাত্রা দিবসের শুরু, এরপর আমাদের সাথে প্রভু পুরিজীর সাথে সাক্ষাত হবে। পোড়া তাত সাঙ্গা থেকে আমরা ত্বরা করে যাত্রা করলাম, কিন্তু পথের দুধারে প্রকৃতির সুধা থেকে আমরা বিস্মৃত ছিলাম না। মোচাকার পাহাড় চূড়া, যেন প্রকৃতির মন্দির ওরা, ওদের গায়ে মাঝে মাঝে খাঁজকাটা, কোথাও আবার মসৃণ। দেখে মনে হবে এখানে এই মেঝেতে ভগবান আহার করেন। এই বিস্তৃত মহান শৈলমালার বর্ণনা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। বুঝতে পেরেছি, পদ্যলেখকেরা হিমালয়ের বন্দনা করে কখনই ক্লান্ত হননি কেন।
মন্দিরটি আমাদের চোখের সামনে উন্মুক্ত, কেমন বিপদমণ্ডিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা লম্বা পাথরের ফাটলে। এখনও অনেক দূর, মনে হলো হয়তো অসম্ভব এ পথ পাড়ি দেয়া। পাথরের মাঝে কষ্টযাত্রা শুরু হলো। তাছাড়া মাঝে মাঝে পায়ের মাঝখানে বিশাল শূন্য গহ্বরে কাঠ দিয়ে আর রশির সাহায্য নিয়ে কিছু অকুতোভয় প্রাণ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মন্দিরে আরোহণ করেছেন। যেখানে একবার পা ফসকে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু।
‘কোথায়?’ আমি যোগী শান্তিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রভু ভগবানজী কি বলেছেন যে তিনি এখানে আমাদের সাক্ষাত দিবেন?’
‘ওই ওখানে।’ তিনি আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘ওই যে ওই মন্দিরে।’
আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। আমাদের আত্মা জমে গেল—আমরা কি করে ওখানে যাব! পূর্ববর্তী যাত্রার পরে আমরা একটু বিশ্রাম নিলাম। আমি আর হাসিমুখ বালক ভাবলাম, যাই হোক না আমরা অন্তত চেষ্টা করে দেখতে পারি।
আমরা পা এবং হাত দিয়ে সব রকম কৌশল করে দুই ঘণ্টা চেষ্টা করলাম, তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম আজকের জন্য এখানেই যাত্রাভঙ্গ। তাই আমরা নিচে নামার কথা ভাবলাম। সেদিনের মতো শুধু জানলাম উপরে ওঠা কতটা কষ্টকর আর নিচে নামতে চাওয়া আরও বিপজ্জনক। আমরা পাহাড়ের খাড়ায় ঝুলছিলাম, বানর যেমন করে গাছে ঝোলে। চেষ্টা করছিলাম আমাদের ভর সহ্য করতে, আর আমাদের পা প্রাণপণ চেষ্টা করছিল যদি এক চিলতে পাথর পাওয়া যায় পা রাখার।
‘কেন নিচে নেমে আসছ না, যখন উপরে যেতেই পারছ না?’ যোগী শান্তি আমাদের ডাকলেন।
‘আমরা চেষ্টা করছিলাম।’ আমি চিত্কার করে বললাম, ‘কিন্তু এই পাথর আমাদের আরোহণে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।’
যোগী শান্তি মজার ছলে বললেন, ‘তাহলে ওখানেই আজকের রাতটা কাটাও। এক রাতের বিশ্রামের পর হয়তো তোমরা মন্দিরে পৌঁছাতে পারবে।
যোগী শান্তির কথায় প্রত্যুত্তর করলাম না। অধিকন্তু, তিন ঘণ্টা বিপজ্জনক ভারসাম্য রক্ষা করার পরে দেখলাম যোগী শান্তি আমাদের পাশে আরোহণ করেছেন।
আমি খাড়া প্রস্তরের উচ্চতার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘যদি প্রভু ওখানে অবস্থান করছেন। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়, আমরা এই বিপজ্জনক আরোহণ করতে সমর্থ হবো না।’
‘আরোহণ নিয়ে ভাবনা করো না,’ যোগী শান্তি বললেন, ‘প্রভুর দৃষ্টি আমাদের ওপরে আছে। যদিও তুমি প্রভুকে উপরে আরোহণ করে অভিনন্দন জানাতে পারছ না। এখন যাও বিশ্রাম করো।’
খাদ্য আর বিশ্রামকে অভিনন্দন জানালাম। মানসিক আর শারীরিকভাবে আমরা এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে শৈলমালার ধারে অবস্থিত মন্দিরগুলো ওই রাতে আর কৌতূহল জাগালো না। সকালের আগমনে আমরা শুনতে পেলাম প্রভু পুরিজী মন্দিরে অবতরন করেছেন। যোগী শান্তিও উপরে গিয়েছিলেন, যখন আমরা ঘুমে নিমগ্ন ছিলাম। ‘প্রভু কখন নিচে নেমে আসবেন?’ আমি যোগী শান্তিকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘প্রভু কখন আসবেন তা জানা নেই, প্রভু আজকে অসংখ্য যোগীকে সাক্ষাত্ দিবেন।’ তিনি বললেন, ‘এখানে অবস্থান করো এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগে নিজেকে নিয়োজিত করো।’
ছবির মতো সুন্দর, কবি যদি হতেন বা হতেন যদি আঁকিয়ে এর বর্ণনা করতে পারতেন। আমি প্রশংসাভরা চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম এবং মহামান্য প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করলাম, আমাকে যদি কবি বানাতে, হয়তো আমি হিমালয়ের এই বিশাল বৈচিত্র বর্ণনা করতে সমর্থ হতাম!
আমি, হাসিমুখ বালক এবং আমাদের আরেক সহযাত্রী পায়চারী করছিলাম। যোগী শান্তি আমাদের সতর্ক করে বললেন উনি সেই সন্ধ্যায় আসবেন। উদ্দেশ্যহীনভাবে আমরা এদিক ওদিক করছিলাম। এমন সময় সত্তর কি পঁচাত্তর ফুট লম্বা একটি খুঁটি দেখতে পেলাম। দেখে মনে হলো এই খুঁটি বেয়ে সবাই উপরে আরোহণ করতে পারব এবং উপরে একটা গোলাকার পাথর রয়েছে। আমি উঠতে প্রস্তাব করলাম। বালক রাজি হলেও আমাদের তৃতীয় সহযাত্রী ওখানেই বসে থাকবে এবং আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে বলে মনস্থির করল।
কাঠবিড়ালীর মতো তড়তড় করে উপরে উঠে গেলাম খুব স্বল্প সময়ে। সেখানে পৌঁছে একটা পাথরের উপরে একটা মন্দির গোচরে এলো। পেছন ফিরে বালককে দেখলাম খুঁটির প্রায় শেষ মাথায় উঠে এসেছে। আমি আমাদের নিচের বন্ধুকে উপরে ওঠার জন্য অনুপ্রেরণা দিতে লাগলাম। কিন্তু সে কোনোমতেই উঠতে রাজি হলো না। বালক এবং আমি সেই মন্দির অবলোকন করতে লাগলাম এবং তার নিস্তব্ধতায় কিছুক্ষণ প্রার্থনা করে নিলাম। এরপরে আমরা দেখলাম আরও উপরে পাহাড় চূড়ায় আরও অনেক মন্দির আছে। দেখার পরে আমরা আমাদের নিচে অবস্থানরত বন্ধুর কাছে চলে এলাম।
সন্ধ্যা সাড়ে চারটা বাজে, যোগী শান্তি ধ্যানে বসেছেন। পাঁচটা পর্যন্ত তিনি অনড় রইলেন। যখন তিনি জাগলেন তখন আমাদেরকে বললেন, ‘প্রস্তুত হও, আমরা আজকে পোড়া তাত সাঙ্গা মন্দিরে যাব।’
‘কীভাবে সেখানে যাব?’ আমি উত্সাহের সহিত বললাম, ‘গতকাল দিনের আলোতে বালক আর আমি উপরে ওঠার কত চেষ্টা করেছি, রাতে কীভাবে আরোহণ সম্ভব?’
‘গতকাল তোমরা শরীরের সাহায্যে উপরে উঠার কসরত করেছ, কিন্তু আজ আত্মার শক্তি দিয়ে আরোহণ করব।’
যোগী শান্তি বললেন, ‘তোমরা কি প্রস্তুত?’
আমরা উদগ্রীব হয়ে উত্তর করলাম, ‘অবশ্যই, আমরা এখনি প্রস্তুত।’ আমরা চারজনে একটা বৃত্তাকার পাথরের উপরে বসলাম এবং ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে যেতে লাগলাম। গোলাকার বস্তুটি মন্দিরের ছাদের কোনায় এসে দাঁড়াল। ছাদের উপরে অনেকের সমাগম, তাদের মধ্যে আমি ভগবানজীকে দেখতে পেলাম। এখানে কিছু স্ত্রীলোকও আছেন। এভাবেই সন্ধ্যা সাতটা অতিবাহিত হলো। নীরবতা ভাঙল প্রভুর সোনালি স্বরে।
‘আমার ভ্রাতা এবং ভগ্নী, আমি আপনাদের সকলকে দেখে আনন্দে সিক্ত হয়েছি।’
তিনি থামলেন এবং তার দৃষ্টি আমার দিকে পড়ল। তিনি আবার শুরু করলেন, ‘আজ রাতে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যারা কখনও বায়ুযোগে শারীরিক আরোহণের বিস্ময়কর ব্যাপারটা অবলোকন করেননি। তাদের মনে এই নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। আমি বলব, এ আসলে কিছু নয়, প্রাচীন যোগের ব্যাপ্ত জ্ঞান ছাড়া আর কিছু নয়। পূর্বে ব্যবহূত হতো এই বিজ্ঞান। এবং তখন প্রভুরা এই বিজ্ঞানের চর্চা করতেন এবং নিজেকে অবতরণ করতেন যেখানে তিনি ইচ্ছা পোষণ করতেন। অনেক মহান ব্যক্তিরা এই জ্ঞান ব্যবহার করতেন। গৌতম বুদ্ধ এই জ্ঞানের দ্বারা দূরদূরান্তে ভ্রমণ করতেন। গোরক্ষ নাথ, গুরু নানক—এরকম হাজার নাম আমি আপনাদের উদাহরণ দিতে পারি। বিস্মিত হবেন না, যদি আপনি এই বিদ্যায় নিজেকে শিক্ষিত করতে চান, একদিন বা এক বছরে তা সম্ভব নয়। কঠোর নিষ্ঠা এবং চর্চার দ্বারাই আপনি এই জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। শুধু বায়ুযোগে ভ্রমণই নয়, এর চেয়েও মহান শক্তির সাক্ষাত্ আপনি পাবেন খুব শীঘ্রই।
তিনি আবার শুরু করলেন, ‘আপনাদের মধ্যে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কী করে শরীর উত্তোলন করা যায়। এর সব কিছু ‘রাজা যোগে’ বর্ণনা করা আছে। মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করুন, যদি মনে করেন এটা অপ্রতুল, তবে যোগীরা আপনাকে সাহায্য করবেন।’
‘নতুনের সময়, এখন সময় বিজ্ঞানের। সময় এখন বিজ্ঞানের পথে ধাবমান এবং সে পথ ধরেই নতুন নতুন বিস্ময় উন্মোচিত হচ্ছে প্রতিদিন। লোকে অনুধাবন করছে যে, বস্তুর চেয়ে জীবন অনেক মহিমান্বিত। সত্যের অনুসন্ধানীরা মানুষের নৈতিক এবং মানসিক অগ্রসরতায় এক মহান প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। ফলে কী হবে তা তাদের নিকট মুখ্য নয়, সত্যের সন্ধানে তাদের প্রচেষ্টা অকৃত্রিম। প্রকৃতির বিস্ময়ে নিমগ্নতা আমাদের আত্মার উত্কর্ষ সাধন করে। যোগের অধ্যয়ন মানুষের মানবিক গুণাবলির উন্নতি সাধন করে। যিনি ধ্যান করেন, অধ্যয়ন করেন জীবনের উেসর, উত্কর্ষের এবং উপযোগিতার, তিনিই সাক্ষাত পাবেন সেই অদমনীয় শক্তির, যা শরীর উত্তোলন করবে এবং এই শক্তি তার নিয়ন্ত্রাধীন হবে।’
‘আমি ব্যাকুল আশা পোষণ করি যে, আপনারা সবাই মুক্ত হতে চাইবেন। আমরা মুক্তি আর স্বাধীনতার প্রশংসা সংগীত গাইব, দাসত্ব থেকে মুক্ত হবো। কিন্তু দাসত্বের কথা আমাদের মস্তিষ্কে এতই প্রবল যে মুক্তির কথা ভুলে যাই। যোগ হলো মুক্তির বার্তা আপনার জন্য এবং সমগ্র পৃথিবীর জন্য। যদি কোথাও নিরাশ হন, তবে যোগ চর্চা করুন। যোগ বিজ্ঞান বলে, এর ফলাফল পাবেন। যারা যোগের অনুসারী তাদের কখনই মনে স্থান দেয়া ঠিক নয় যে, যোগ রহস্যময় এবং এ মাত্র স্বল্পসংখ্যক লোকের জন্য। যোগ সবার জন্য। প্রাকৃতিক এবং প্রতিদিনের প্রয়োজন। এ শুধু আত্মত্যাগের পথ নয়, বরং জীবনের প্রতিনিয়ত চর্চার বিষয়। আপনাকে পৃথিবীর নিয়ম ত্যাগ করতে হবে না, বরং যোগ আপনার জীবনকে পরিপূর্ণ করবে, ভালো এবং মুক্ত করবে।’
প্রভু পুরিজী তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ করে বললেন পরদিন দুপুরে দেখা করবেন নদীর ধারে, যেখানে মহান যোগীরা তাদের শক্তি প্রদর্শন করবেন। আমরা স্তব করলাম, ‘ওম শান্তি ওম!’
বক্তব্যের পরে আমরা চারপাশ পরিদর্শন করলাম। ঝকঝকে সূর্য আমাদেরকে এই সুন্দর জায়গাকে দেখার পথ সুগম করল। নয়টার সময় সন্ধ্যা ভোজের ডাক এলো। হাতে হাতে পানির পাত্র বিনিময় হচ্ছিল হাত ধৌত করার জন্য এবং আমরা ইচ্ছা মোতাবেক বসে পড়লাম। ভারতে টেবিল-চেয়ারের ব্যবহার হয় না। আমি আনমনে চাঁদের আলোয় ধৌত পাহাড়ের চূড়া দেখছিলাম। একজন লোক আমার মগ্নতা ভাঙ্গিয়ে বলল, ‘আর লাগবে?’ আমি সব আহার গ্রহণ করতে পারলাম না। তবে আমি তৃষ্ণার্ত ছিলাম এবং দুধ পান করব বলে জানালাম। ‘দুগ্ধ প্রভু।’ লোকটি ডাকল এবং তখন আমি বুঝতে পারলাম কে এই খাদ্য সরবরাহ করছেন। সেখানে বিনম্রভাবে আমার প্রাণপ্রিয় প্রভু বসেছিলেন। তার সামনে একটা ছোট পাত্র যাতে খুব স্বল্প খাদ্য দেখতে পেলাম। তিনি সেই ক্ষুদ্র ভোজনপাত্র থেকে পঁচাত্তর জন লোকের খাদ্য সরবরাহ করছেন!
আমি অবাক বিস্ময়ে আহারের কথা ভুলে গেলাম, চোখ বস্ফািরিত করে প্রভুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন এবং মনোরম হাসি মুখের উপর ছড়িয়ে বললেন, ‘আহার করো, বাছা, আমি অপেক্ষা করছি যদি তোমার আরও প্রয়োজন পড়ে, আমাকে বলো।’ তাড়াতাড়ি আমি খাওয়া শুরু করলাম। চিন্তা করলাম প্রভুর হাতের আহার আমি কিছুতেই বিনষ্ট করতে পারব না।
কেউ একজন বলল, ‘এই আহার কোথা থেকে এসেছে প্রভু?’
প্রভু উত্ফুল্ল হয়ে বললেন, ‘আহার যেখান থেকে আসে, সেখান থেকেই এসেছে।’
এরপর আমরা একই ভাবে অবতরণ করলাম। সেইভাবে একটা সমতল পাথরে চড়ে, ভেসে ভেসে নিচের মন্দিরে নেমে এলাম। আমি কান সজাগ রাখলাম যে অবতরণের সময় কোনো শব্দ কানে আসে যদি। না কিছু শুনতে পেলাম না। সবাই খুব সহজভাবে নিচে নেমে এলো এবং রাতে নিঃশব্দে প্রস্থান করল।
একটার সময় আমরা আবার মিলিত হলাম। আমরা বসলাম, একটা মাতোয়ারা নদীর পাশে যা খরস্রোতা, দ্রুত লয়ে বয়ে চলেছে, পাহাড়ি নদীর স্বভাব যেমন। নদী একটা পাহাড়ের গিরিখাতের ঢালু পথে নেমে যাচ্ছে। এর ভেতরে কিছু পড়লে বিলীন হবে। তাকিয়েই ছিলাম। দেখলাম গাছে গুড়ি ভেসে গেল যেন, কিন্তু না, এটা একটা মানুষের দেহ। কিছুক্ষণের মধ্যে তা দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। আমরা কথা বলতে যাব এমন সময় একটা স্বর আমাদের থামিয়ে দিলো, ‘দেহটি আবার ফিরে এসেছে ঢেউয়ের বিপরীতে।’ ঢেউ এবং দেহের শক্তির যুদ্ধ হচ্ছে এবং দেহটি জয়লাভ করেছে। সেটা ভাসতে ভাসতে আমাদের নিকটে এলে প্রভু চিত্কার করে বললেন, ‘বিজয়! প্রকৃতির বিপরীতে বিজয়। কারণ আত্মা বস্তুর থেকে মহান।’
ওই যোগীর দেহ এরপর পানির উপরে দাঁড়াল এবং স্রোত তাকে নিচে টেনে নিতে চাইল। কিন্তু সেই খরস্রোতা নদীর স্রোত তাকে নড়াতে পারল না। তিনি যেন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর তিনি জলের মাঝ থেকে হেঁটে চলে এলেন আমাদের মাঝে। প্রভু তাকে অভিনন্দন জানালেন।
‘বলো, কেমন হলো যোগী দেওর চর্চা?’ একজন যোগী বললেন, ‘তিনি জয়লাভ করেছেন।’
‘আমি চন্দ্র সূর্যের আলো নিয়ন্ত্রণ করতেও সমর্থ হবো।’ যোগী দেও বললেন, তিনি কী করবেন আমরা যেন খেয়াল করে দেখি। তিনি সূর্যের আলোতে বসলেন। কিছুক্ষণ পর তার পাশে হালকা অন্ধকার নেমে এলো, যেখানে সূর্যের আলো ক্ষুদ্র বিন্দুর আকার হয়ে আবছায়ার বাইরে চলে গেল। ত্রিশ মিনিট ধরে নিজ শক্তি দিয়ে তিনি ছায়াকে ধরে বসে রইলেন।
অন্য যোগীরাও ঠিক এমন সব বিস্ময়কর শক্তি প্রদর্শন করলেন। যোগী অন্তর্ধান বললেন যে, হূদস্পন্দন থামিয়ে দেয়া যেতে পারে এবং তিনি ঘোষণা দিলেন যে তিনি প্রমাণ পেয়েছেন যে দেহের পচন রোধ করা যাবে বছরের পর বছর।
প্রভু ভগবানজী বক্তব্য রাখলেন এবং বললেন আমরা কাল পোড়া তাত সাঙ্গাতে মিলিত হবো।
সন্ধ্যায় প্রভু আমাদের নিকট এলেন। তার আগমনে আমার আত্মার শান্তি হলো। তিনি আমাদের যাত্রার ব্যাপারে খোঁজখবর নিলেন এবং আমাকে এবং সন্ন্যাসীকে আমাদের মন্দিরে ওঠার প্রচেষ্টা নিয়ে ঠাট্টা করলেন।
‘পরবর্তী সময়ে তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে।’ প্রভু বললেন। কিন্তু যোগী শান্তি সজোরে হেসে দিয়ে বললেন, ‘যদি অবতরণ সহজতর হতো, তারা হয়তো সামলাতে সমর্থ হতো কিন্তু তাদের অবতরণ করতে তিন ঘণ্টার মতো লেগে যেত, আর আরোহণের সময় ক্ষেপণ হতো মাত্র দু ঘণ্টা। কিন্তু তারা পতিত হতো।’
‘এ কারণেই তারা পরের বার আবার আরোহণ করবে।’ প্রভু নম্রভাবে জোর করলেন।
‘প্রিয় প্রভু, পরবর্তী বলতে আপনি কোন সময়কে বুঝাতে চাইছেন?’
‘কাল দুপুর একটায়।’ প্রভু জবাব দিলেন এবং মন্দির থেকে নিচে অবতরণ করলেন।
প্রভাতে একজন লোক আমার কাছে এলো এবং আমাকে আঠার মতো লেগে থাকে এমন একটা বস্তু হাতে গুঁজে দিলো। ‘আপনার দরকার হবে যখন আপনি মন্দিরে উঠবেন। যখন আপনার পা আর হাত ঘেমে যাবে, এটা ব্যবহার করবেন। তাহলে ফসকে পড়ে যাবেন না।’
‘আর আমার পাদুকা?’
‘খুলে ফেলুন।’
আমরা তার দেখানো নিয়ম মেনে চললাম এবং একটার সময় আমাদের আরোহণ শুরু হলো। উপরে মন্দিরের ছাদে বসে প্রভু আমাদের দেখতে লাগলেন। প্রভুকে দেখে আমি যেন শক্তি পেলাম এবং মনে হলো আমি নিরাপদ, ভয় নেই। এছাড়াও আমাদের নিশ্চুপ যোগীরা ছিলেন, যারা আমাদের এই আরোহণের দৃশ্য আগ্রহের সাথে অবলোকন করছিলেন। জীবন্ত পাহাড় কেটে যে সিঁড়ি তার ধাপে ধাপে উঠে এবং ফাটলের ভেতরে রশি আটকে, বিপজ্জনক ফাটল এবং মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে মাত্র তিনবার বিশ্রাম নিয়ে পৌনে চারটার সময় আমরা মন্দিরে আরোহণ করলাম। প্রভু আমাদের হূদয় থেকে অভিনন্দন জানালেন। মন্দিরের ভেতরের সৌন্দর্য তিনি আমাদের দেখালেন এবং তার ইতিহাস বর্ণনা করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রভু, এই মন্দিরের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য কি মানুষের নির্মিত নাকি অন্য শক্তির?’
‘মানুষের শক্তির চেয়ে আর কোন শক্তির কথা বলছ তুমি বত্স্য?’
আমি বললাম, ‘আমি একরাতে একটা মন্দির নির্মিত হতে দেখেছি, যা নাকি এই মন্দির থেকে প্রায় দুইশ মাইল দূরবর্তী। মন্দিরের দেয়াল এমন পাথর দিয়ে গড়া যে কোনো মানুষ তো দূরের কথা কোনো ভারউত্তোলক যন্ত্রও উত্তোলন করতে পারবে না। এ মন্দির অবশ্যই কোনো অদৃশ্য শক্তি নির্মাণ করেছে। এই যে পোড়া তাত সাঙ্গা, পাহাড়ের এক দুর্গম স্থানে নির্মিত, আমার মনে হয় এই মন্দির কোনো অদৃশ্য শক্তির কাজ।’
প্রভু বলললেন, ‘বত্স্য, তুমি সঠিক বলছ, কিন্তু এই শক্তি যা সব মানবের ভেতরে অবস্থান করে কিন্তু তারা জানে না কীভাবে ব্যবহার করতে হবে বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তুমি তো দেখেছ, যোগী একটা পাথরের পটে বসে মন্দিরে উঠে এলেন, দেখেছ তো?’
‘দেখেছি। কিন্তু প্রভু তারপরও আমি বুঝতে পারি না, কী করে মানুষ এমন মন্দির বানাতে পারে, শৈলের গায়ে এমন কারুকার্য! ওহে প্রভু, মানুষ কী পারে এমন নির্মাণ উপহার দিতে?’
‘হ্যাঁ বত্স্য, পারে। যারা কর্মে নিমগ্ন থাকেন এবং অর্থের কথা ভাবেন না তারা। তাদের ভেতরে যখন অনুপ্রেরণা থাকে যা নাকি স্রষ্টা প্রদত্ত, তারা পারেন। একজন সাধারণ মানুষের যা চক্ষু গোচরে আসে না, সেই অতিসূক্ষ্ম বস্তু মানুষকে শিখতে হয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সে শিখতে পারবে না কী করে ‘প্রাণ’ নিয়ন্ত্রণ করবে, সে শিখতে পারবে না। পারলে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিস তার চোখের পটে ধরা দিবে, যেমন—সে দেখবে জলবায়ু কী করে জলে বন্দী রয়েছে।’
‘এই মন্দির যারা তৈরি করেছেন, তারা ছিলেন স্বয়ং তাদের এবং প্রকৃতির প্রভু। কিছু মহোত্তম মানুষও ছিলেন এই মন্দির নির্মাণে, তারা ছিলেন ইউরোপের কিন্তু সে শত শত বছর আগের কথা।’
সেদিন সন্ধ্যাকালে অনেক যোগীরা মন্দিরের উপরে এলেন বায়ুযোগে এবং মহান প্রভু তার জ্ঞানলোকপ্রাপ্ত যোগীদের অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি ‘প্রাণ’ যোগের আরোগ্য লাভ করার ক্ষমতার কথা জানালেন এবং আমি বিস্মিত হলাম যখন তিনি আমার বাঘ গুহা যাত্রার কথাও তুলে ধরলেন। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে এই মহান প্রভুই ওই জঙ্গলে আমার সহযাত্রী ছিলেন, যাকে আমি কসাই নাম দিয়েছিলাম এনং তখন আরও বুঝলাম তিনিই ছিলেন সেই প্রভু যে আমাকে বাঘ গুহায় অবরোহণ করতে বলেছিলেন। প্রভুর বর্ণনা খুব প্রাণবন্ত এবং আনন্দপূর্ণ ছিল, যখন তিনি অভিনয় করে দেখাচ্ছিলেন যে তিনি কীভাবে ওই কর্কশ সহযাত্রী হয়েছিলেন যে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল। ছাদের পরিবেশে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। আমি শুধু এটাই ভাবছিলাম আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল যে, আমি আমার প্রভুকে অনেকবার আমার কাছে পেয়েছি। সত্যি বলতে কি, আমি অত্যন্ত সম্মানবোধ করছিলাম।
পরেরদিন প্রভু পুরিজী আমাদেরকে নিয়ে একটি গুহায় এসে হাজির হলেন যেখানে অনেক যোগীরা প্রকৃতির জয় করার ধ্যান করছেন। তাদের বয়স ছিল পঁচিশ থেকে আশি বছরের মধ্যে।
তিনি আমাদের ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো গুহার দিকে নিয়ে গেলেন, যাদের ভেতরে মন্দির ছিল। আমরা সেই গুহার দু সপ্তাহ কাটালাম। আমি প্রভুকে দার্জিলিংয়ের দূরত্ব জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমরা যেখানে অবস্থান করছি, সেখান থেকে দার্জিলিং অনেক দূর। কিন্তু কুচবিহার আর গুয়াহাটি হয়ে গেলে আমাদের যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত হবে। তিনি আমাদের একটা সংক্ষিপ্ত পথ দিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। যোগী শান্তিকেও সাথে নিলেন তিনি। তাই অবশেষে আমরা তিনজন গুয়াহাটির পথে যাত্রা আরম্ভ করলাম।
গুয়াহাটিতে আমরা প্রভুর সাক্ষাত্ পেলাম যিনি অনেক সাধু আর যোগী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন, শহরের নিকটেই একটা বিশাল বৃক্ষের নিচে। তার সহচরেরা বুঝতেই পারেননি তিনি কে, কিন্তু সবাই মিলে তাকে সম্মানের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন কারণ তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি।
পরিসমাপ্তি
সন্ধ্যায় প্রভু আমাকে বললেন, ‘আমি কাউকে না বলে চলে যাচ্ছি। এই শিশুপুত্রের পুনর্জন্ম নিয়ে তাদের মনে অনেক প্রশ্ন। তুমি কাউকে আমার কথা বলো না। আর বলো তুমি এখান থেকে কোথায় যেতে চাও?’
‘কিছুদিনের জন্য পাঞ্জাব যাব, এরপর কোথায় যাব মনস্থির করিনি।’
তিনি আমাকে মৃদু ভর্ত্সনা করে বললেন, ‘পুত্র, সবসময় জানতে চাইবে তুমি কোথায় যেতে চাও, কী চাও। পাঞ্জাব যাও, যদি ফিরে আসো, আমাকে হরিদ্বারে পাবে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’
তার আশীর্বাদ নিয়ে আমি পাঞ্জাব এলাম। সেখানে সপ্তাহখানেক থেকে হরিদ্বারে চলে এলাম।
পাঞ্জাবে আমি আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সাথে সাক্ষাত্ করলাম। তারপর আবার হরিদ্বারে ফিরে এলাম যেখানে প্রভু পুরিজী আমাকে সাক্ষাত্ দিতে চেয়েছিলেন। আমি যখন সন্ন্যাসী কিশভানন্দজীর মুনিমণ্ডলে এসে প্রভুর অন্বেষণ করলাম, প্রভু সেখানেই অবস্থান করছিলেন!
আমি আর প্রভু মিলে গঙ্গার ধারে পায়চারী করছিলাম। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হরিদ্বার থেকে আমি কোথায় যেতে চাই।
আমার আত্মা যেন কথা বলছে, ‘হে প্রভু, আপনি যেখানে যাবেন আমি সেখানে যেতে চাই। শুধু বলুন কোথায় যাব।’
‘তোমার মাতা, ভগিনী আর তোমার ভাইয়েরা কী বলবে? তারা চেয়েছিল তুমি তাদের সাথে থাকো, কিন্তু তুমি ইউরোপ যেতে চেয়েছিলে। তুমি কেন এখন ইউরোপ যেতে চাইছ না?’
‘প্রভু, আপনি যে বিস্ময়কর কাজ করেছেন, আমি দেখেছি, এবং আমি আপনাকে জেনেছি। আমি আপনার কাছ থেকে শিখতে চাই।’
তিনি হেসে বললেন, ‘তুমি আরও শিখতে চাও? তাহলে আমি তোমাকে কিছু জিনিস শেখাব যা তোমার বর্তমান আর ভবিষ্যতের কাজে দিবে।’
আমি কৃতজ্ঞতা জানালাম তার এই মমতার জন্য। এরপর সপ্তাহখানেকেরও বেশি সময় আমরা দুজনে গঙ্গার ধারে হাঁটতাম। প্রভু যে যে বিষয়গুলো বর্ণনা করতেন আমি তা নিয়ে প্রশ্ন করতাম না, মনোযোগ দিয়ে শুনতাম এবং কৃতজ্ঞতা জানাতাম।
এরপর একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তিনি বললেন, ‘পুত্র, আমি তোমাকে সব পদ্ধতি শিখিয়ে দিলাম, তুমি চর্চা করো। আর যেখানেই যাও, সত্যের বাণী বহন করে চলো।’
এরপর আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। কিন্তু মহান প্রভু, দয়ালু আর চিন্তাশীল প্রভু সবশেষে আমাকে বললেন, ‘চিন্তা করো না, তুমি পারমিট পেয়ে যাবে, এক সপ্তাহের মধ্যেই পেয়ে যাবে।’ এবং তাই পেয়ে গেলাম।
প্রভুর সেই স্নিগ্ধ আশীর্বাদ নিয়ে আমি ১৯২৩ সনে ইউরোপের পথে পা বাড়ালাম।
নাঈমা আফরোজ সম্পা
Find Nobin Kontho on Facebook