শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৭

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি কারা? | ফাহিম আহমেদ

চলতি বছরের ২৫শে আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (ARSA) নামক এক রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠী ছুরি ও ঘরে তৈরি বোমার দ্বারা আরাকানের ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে সশস্র হামলা চালিয়ে ১২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করে। এতে নিহত হয় ৫৯ জন আরসা মিলিশিয়া ও আহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় শতাধিক সদস্য। আর এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আরাকানে নতুন করে অত্যাচার ও নিপীড়ন নেমে আসে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গার জীবনে। আরসা বিদ্রোহীদের দাবি তারা মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের পক্ষে লড়াই করছে। কিন্তু তারা আসলে কারা? আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) মায়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২৫শে আগস্টের আরসার হামলার সময় মিয়ানমার সফর করছিলেন সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান। ২৬শে আগস্ট হংকংভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা এশিয়া টাইমসকে আরসা প্রধান আতাউল্লাহর মুখপাত্র আবদুল্লাহ এক সাক্ষাতকার দেন যাতে তিনি সেদিনের হামলার পেছনের কারণগুলো বলেন। 
আবদুল্লার মতে আরাকানের মংডু ও রাথেডুং এলাকায় সেদিন সেনাবাহিনী ২৫ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিলে আরসা তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ওই হামলাটি চালায়। আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা পূর্বে "ফেইথ মুভমেন্ট" নামে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। স্থানীয়ভাবে তারা “হারাকাহ আল-ইয়াকিন” নামে পরিচিত। মিয়ানমারের সরকারি ভাষ্যমতে আরসা একটি জিহাদী-জঙ্গি সংগঠন এবং এর প্রধান আতাউল্লাহ বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন জঙ্গি। বেলজিয়ামভিত্তিক সংগঠন International Crisis Group (ICG) এর তথ্যমতে, আরসার প্রধান নেতা আতাউল্লাহর বাবা রাখাইন থেকে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান এবং সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন আতাউল্লাহ। তিনি "আবু আমর জুনুনি" নামেও পরিচিত। আতাউল্লাহর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে সৌদি আরবের মক্কায় এবং সেখানে একটি মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। ২০১২ সাল থেকে সৌদি আরবে আতাউল্লাহর আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। আরাকানে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর তার নাম শোনা যায়। ইউটিউবে প্রকাশিত একটি ভিডিও থেকে জানা যায় যে তিনি রাখাইনদের ভাষা ও আরবীতে কথা বলায় দক্ষ। 
ICG এর তথ্যমতে, আরসা বিদ্রোহীরা বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তাদের পরিচালনা করছে সৌদি আরবের মক্কায় বসবাসরত নেতৃস্থানীয় ২০ জন রোহিঙ্গা যারা এ সংগঠনটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাথে তারা যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। আরাকানে স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মাঝে আরসার প্রতি ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। এশিয়া টাইমসকে দেয়া সাক্ষাতকারে আবদুল্লাহ জানায় তাদের সাথে জিহাদীদের কোন সম্পর্ক নেই এবং তাদের মূল লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মায়ানমারে স্বীকৃতি প্রদান, নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। লন্ডন ভিত্তিক একটি রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান ন্যাশনাল রোহিঙ্গা অর্গেনাইজেশনের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, “যারা এই সংগঠনে যুক্ত হয়েছে, তারা মরিয়া হয়ে এরকম একটা পথ বেছে নিয়েছে। এরা জঙ্গিও নয়, কোন আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গেও এদের সম্পর্ক নেই। এরা আরাকানে বেড়ে উঠা একটি গোষ্ঠী যারা রোহিঙ্গাদের অধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য লড়ছে বলে দাবি করে।"
১০ সেপ্টেম্বর মানবিকতার কথা চিন্তা করে আরসা অস্রবিরতি ঘোষণা করলেও তাদের সাথে কোন সংলাপে যেতে রাজি হয়নি মিয়ানমার সরকার। ২৫শে আগস্টে আরসার হামলার পর সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে মায়ানমার সেনাবাহিনী। সব রোহিঙ্গা পুরুষকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয়ার জন্য তাদের আর কোন অজুহাতের প্রয়োজন নেই। জঙ্গি দমনের নামে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত অমানবিক অভিযানকেও তারা এর মাধ্যমে বৈধতা দিতে সচেষ্ট হয়েছে। আরসার এ হামলার ফলে নতুন করে শরনার্থী হয়েছে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংগঠিত এ সশস্র গোষ্ঠীর উত্থান পুরো আরাকানের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। মায়ানমারের সরকার যদি রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে নির্বিচারে সামরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে এদের দমন করতে যায়, তাতে বরং সেখানে সহিংসতার মাত্রা বাড়তেই থাকবে এবং অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত হবে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীর জীবন।

ফাহিম আহমেদ, শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়






Find Nobin Kontho on Facebook