সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৭

ভারতবর্ষের ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য বনাম বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় | মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম

কয়েকদিন আগেই আমার এক স্নেহপ্রতিম ছাত্র ও বর্তমান সহকর্মী আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর আয়োজনে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রমবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে গিয়েছেন। ওখানে গিয়ে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর শিক্ষা, মনীষীদের ছবি, সংস্কৃতি, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে কয়েকটি ছবিসহ একটি
পোষ্ট দিয়েছেন। সেই স্ট্যাটাসে সংক্ষেপে সে লিখেছে স্বাধীনতা ও একটিভিজমের প্রতিচ্ছবি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়।

তাকে ধন্যবাদ এমন কয়েকটি ছবি দিয়ে অন্তত অনেকদিন থেকে নেতিয়ে পড়া চিন্তার উপর ঝলকানি দেয়ার জন্য। ছবিগুলো দেখে সত্যিকার অর্থে আমার কাছে মনে হয়েছে এখনও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অধিকার ও চেতনার বাতিঘর হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত।

এটা শুধু ছবির মধ্যেই যে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে তা নয়। বরং জওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় সাম্প্রতিককালে কিংবা বলতে পারি গত কয়েক বছরে কোন না কোন কারনে একটু আলোচিতই বটে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান উৎপাদন গবেষণায় জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় অনেক আগে থেকেই জ্ঞানী, পন্ডিত ব্যক্তিদের কাছে সমাদৃত। এবং হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ ভারতবর্ষের যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত তাদের মধ্যে মৌলিক জ্ঞান উৎপাদন, গবেষণা ও সৃষ্টিশীলতায় একেবারে সেরা না হলেও অন্যতম। কিন্তু আমি যে কারনে গত কয়েকবছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটির বিপুল প্রচারণা দেখি তা হলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ।

ভারতে পাবলিক পরিবহনে দামিনী নামের এক ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদ, কানাইয়া নামের এক ছাত্রনেতার কাশ্মীর নিয়ে মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশদ্রোহিতার মামলা পরবর্তী আন্দোলন, ‘হোক কলরব’ আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জওহরলাল নেহেরুর ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন অনেক আলোচিত হয়েছে। একটা সময়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি ছাত্র আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলাম বলে তাদের ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপকতা, কর্মস্পৃহা ও ঐতিহ্য দেখে আমি এখনো বিমোহিত হই। যদিও ভারতবর্ষের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও তাদের তাঁবেদার বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিওটিও এর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ কিংবা বিরাজনীতিকরণের জোর প্রচারণা চলছে তবুও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও ছাত্র আন্দোলন আছে।

প্রেসিডেন্সি, কলকাতা, আলীগড় কিংবা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন সংগ্রামের খবরাখবর এখনও পাই। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা আছেই। উপনিবেশিক শাসণ-শোষণ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের একই ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি অন্যদিকে তুলনা করি? পাঠকমাত্রই হয়তো বলবেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে আরো বেশি এগিয়ে থাকবেন।

কেউ কেউ হয়তো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা তার প্রেক্ষাপট হিসেবে ১৯৭০, ১৯৬৬, ১৯৫৪ ১৯৫২, ১৯৪৭ সালগুলির কথা বলবেন। যেসব সালগুলো শুধু নম্বর ছিলোনা বরং ছিল একেকটা ইতিহাস। আমি মানি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংস্কৃতির একটা আধারক্ষেত্র ছিল। কিন্তু ১৯৯০ এ স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরে এখানে কি কার্যকর অর্থে এই ক বছরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, নয়া উপনিবেশবিরোধী, গণমানুষের পক্ষে, শোষণ কিংবা অনৈতিক অত্যাচার, কালো আইনবিরোধী কোন কার্যকর, মানবিক, ছাত্র গণআন্দোলন কি হয়েছে?

আমি মনে করি এটা হয়নি। অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে কিন্তু আমি মনে করি গণতন্ত্রায়নের যে সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চর্চা হয় তার থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি কিংবা বলতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে। বেসরকারিকরণ, বানিজ্যিকীকরণ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধীতার যে আতুঁড় ঘর ছিলো একসময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেই সোনালী অতীত পিছনে ফেলে এসেছেন।

প্রত্যেকটা দেশেই একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় ভূমিকা পালন করে আন্দোলন, মতামত কিংবা ডিসকোর্স তৈরী করতে। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্রাংকফূর্ট বিশ্ববিদ্যালয়, মিলান বিশ্ববিদ্যালয়, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে কিংবা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল কিংবা বলতে পারি এখনো আছে সেই ভরকেন্দ্র কি এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে?

জ্ঞানচর্চা, সৃষ্টিশীলতা, গণতন্ত্রায়ণের চর্চা মানদন্ড বিচার করলে কি আলোচনায় থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে যে বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, মানবতাবাদী দার্শনিক তৈরি হয়েছিল তার প্রবহমান ধারা কি এখনও আছে? জাতির মুক্তিদাতা ও ত্রানকর্তা হিসেবে যেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা রেখেছিল সেই ভূমিকা কি আজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাখতে পারবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে অনেকসময়ই নেতিবাচক উত্তর আসে। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানতাপস অধ্যাপকগণ নেতিবাচক মন্তব্য করেন। বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিন্মগতি নিয়ে প্রতিকীভাবে একজন শিক্ষক লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি শুধু উল্টোপথেই চলবে?’

অনেক ডাকসাইটে অধ্যাপক কিংবা তরুণ শিক্ষক গবেষণা, নিয়োগ, রাজনীতি, পড়াশুনার মান, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল আন্দোলন, বানিজ্যিকীকরণ, রক্ষনশীলতা, ডাকসু নির্বাচন, ভিসির ক্ষমতা, প্ল্যাজিয়ারিজম নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ আলোচনা করেন। তাদের ক্ষোভ কিংবা এসব আলোচনার অনেকটাই সত্য। আমি মনে করি তা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় বরং বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।

কিন্তু এ প্রবন্ধে আমি মূলত ছাত্ররাজনীতি, রাজনীতি বিমুখতা, বানিজ্যিকীকরণ, গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়া ও ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ফোকাস করার চেষ্টা করবো। আমি যখন ছাত্র জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম তখন পর্যন্ত আমার কাছে সবচেয়ে ব্যস্ততম, জনাকীর্ণ স্থান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন, কলা ভবনের আশপাশ কিংবা ডাকসু। প্রচন্ডরকম উন্মাদনা ও মুষ্টিবদ্ধ হাতের সমাহার দেখা যেত ওই স্থানগুলোতে।

প্রতিদিন মিছিলের শব্দ শোনা যেত। আন্দোলন সংগ্রামের আতুঁড়ঘর ছিল এই কয়েকবছর আগেও। কোন না কোন জায়গায় বামপন্থী, উদারনৈতিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মানুষজনের সমারোহ ছিল ওই স্থানগুলোতে। রাস্তায়, দেয়ালে, বিল্ডিংয়ের জায়গায় জায়গায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, মানবতা-নৈতিকতাবোধ নিয়ে দেয়াল লিখন, গ্রাফিত্তি, ব্যানার ফেষ্টুন দেখা যেত। কিন্তু যত সময় গেছে এসবের আয়োজন, উদ্যোগ কিংবা প্রদর্শন আস্তে আস্তে কমতে দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন যত একাডেমিক ভবন, হল, ইনস্টিটিউট কিংবা সেন্টার হয়েছে সেখানে এই ধরনের কার্যক্রম রীতিমত বিজ্ঞাপন দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধ করা হয়েছে। প্রায় সব জায়গায় এমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে ‘বিল্ডিংয়ের দেয়ালে কোন প্রকার দেয়াললিখন, পোষ্টার, ব্যানার, ফেষ্টুন লাগানো নিষেধ- আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের আন্দোলন থেকে তৈরি হয়েছে সেখানে কি এমন বিজ্ঞাপন মানায়? আমার এক বন্ধু এই ধরনের বিজ্ঞাপন দেখে মন্তব্য করেছিলেন ‘আহ কি গণতান্ত্রিক ও সৌন্দর্যমন্ডিত অশ্লীল বিজ্ঞাপন’। আমি অবশ্য ওর মত এত অসহনশীল ভাষায় সমালোচনার পক্ষে নই। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। সৃজনশীল ও মননশীল গ্রাফিত্তি, দেয়ালচিত্র, ব্যানার, ফেষ্টুন কমে গেছে। স্থান নিয়েছে সাইফুরস, কনফিডেন্স, হারবাল, সর্বরোগের মহাঔষধের বিজ্ঞাপন কিংবা ‘অমুক ভাইয়ের সালাম নিন, তমুক ভাইয়ের গোলাপ নিন’ স্লোগানজাতীয় কিছু একটা। আতঙ্ক বিপ্লবী ছাত্রনেতাদের অদ্ভূতুড়ে ব্যানারে ভরে গেছে স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

সত্যিই আশ্চর্য লাগার মতো বিষয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনও মাঝে মাঝেই বন্ধ থাকে। অনেকে বলেন, অনেকদিন ১১ কি ১২টার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন খুলতে দেখা যায়। অবশ্য আমি শুধু ক্যান্টিন নিয়ে কথা বলছি কেন আইবিএ নামের একটা বিল্ডিংয়ের ফটক পর্যন্ত বন্ধ ছিল কয়েকবছর! ফল যা হবার তাই হয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার, ঐতিহ্যলালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই মধুর ক্যান্টিন, ডাকসু ভবন, ডাস, মধু দা, রাজু ভাস্কর্য চিনেনা।

আমি যখন এসব শুনি তখন প্রচন্ড হতাশ হই। ওইসময়টায় শুধু সাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, অনেকেই বলেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালগুলো এখন মুমূর্ষু আমি বরং বলব অনেক আগেই তার সৎকার সম্পন্ন হয়েছে’। কেউ কেউ বলতে দুয়েকজন হয়তো এমন ব্যতিক্রম হবেন। আমি মনে করি এর হার হয়তো একেবারে কম হবেনা!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় সভা-সেমিনার-আলোচনা-পাঠচক্রের কেন্দ্রস্থল ছিল। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, সামরিকতন্ত্র, সাম্র্জ্যাবাদ, অন্যায় যুদ্ধ, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন হলে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি এসব নিয়ে আলাপ আলোচনার ডিসকোর্স ছিল। এইসব ডিসকোর্স যতদিন জীবন্ত থাকে একটা প্রতিষ্ঠান তত সজীব, ক্রিয়াশীল থাকে। সৃষ্টিশীলদের পদচারণায় মুখর হতে দেখা যায়। পাশ্চাত্যে ‘পাবলিক স্পেয়ার’ বলে একটা প্রত্যয় আছে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান, ক্যাফে, রেষ্টুরেন্ট, রাস্তাঘাট এসব ছিল জনগণের মতামত তৈরীর কেন্দ্রস্থল বা পাবলিক স্পেয়ার। জার্মান বংশদ্ভেুাত আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী যুর্গেন হেবারমাস মানুষের মুক্তি, গণতন্ত্রায়ন, ডিসকোর্স উৎপত্তি বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পাবলিক স্পেয়ার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

তিনি দেখিয়েছিলেন ১৯৬৮ সালের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধীতা নিয়ে ছাত্র আন্দোলন বিশেষ করে প্যারিস ও আমেরিকায় জনমত তৈরিতে এই ধরণের পাবলিক স্পেয়ারের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। একইরকমভাবে ওই সময়ে ফ্রাংকফূর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে হেবারমাসের বন্ধু তাত্ত্বিক থিওডর এডর্নো, ম্যাক্স হরকহেইমারও এসব নিয়ে কথা বলেছেন। লিখেছেনও অনেককিছু। যদিও তাদের মতে পাশ্চাত্যেও এসব পাবলিক স্পেয়ারে জনমত গঠনের জায়গাগুলো ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। একইরকমভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-ছাত্র-গবেষকদের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদ, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনার যে অবারিত ক্ষেত্র ছিল তা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। চিন্তার মধ্যে একধরণের কর্মার্টমেন্টালাইজেশান হয়েছে। এখানে বেশিরভাগ মানুষ জনমতের গঠনের জায়গা থেকে সরে গিয়ে সাঈদ কথিত ‘দলগত বুদ্ধিজীবী’ তে রুপান্তরিত হয়েছে।

সান্ধ্যকালীন বানিজ্যিক কোর্স চালু, বেসরকারিকরণ, বানিজ্যিকীকরণ, হল দখল, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ, ছাত্র নির্যাতনের মতো গুরুতর যাই কিছু ঘটুক না কেন এখানে কোন প্রতিরোধ নেই। প্রতিরোধের সংস্কৃতি নেই। প্রতিরোধের যে উজ্জল জমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে প্রোথিত ছিল তার পায়ের আওয়াজ যেন আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ব্যক্তিবাদী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে সবাই নিজেকে প্রতিরোধের সংস্কৃতি থেকে বিরত রাখেন। সবাই মনে হয় ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ এই সংস্কৃতি ধারক ও বাহক হয়ে উঠছেন।

মার্কসবাদী কিংবা নিন্মবর্গের তাত্ত্বিকদের ব্য্যাখা বিশ্লেষণ অনুযায়ী সামগ্রিক শ্রেণি আন্দোলনতো নয়ই বিরাজনীতিকরণের ঘেরাটোপে পরে প্রতিদিনকার যে ক্ষুদ্র আন্দোলন সংগ্রামের সংস্কৃতি আছে তাও চলে গেছে। মিছিল মিটিং সমাবেশ ধর্মঘটের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গিয়ে আলাপ আলোচনা, ডিসকোর্স তৈরীর সংস্কৃতিও অনুপুস্থিত। সমাজবিজ্ঞানী জেমশ কট কথিত প্রতিদিনকার প্রতিরোধ সংস্কৃতি বলতেও আজ আর কিছু নেই। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হলদখল, সেশনজট, খুন জখমের অভিযোগ এনে এমন একটা রাজনীতিবিমুখ ছাত্রসমাজ কিংবা বিরাজনীতিকরণের আধিপত্যেবাদী মতাদর্শ তৈরী করা হয়েছে ভাবতে অবাক লাগে।
তবে এ আধিপত্যেবাদী রাজনীতিবিমুখ সংস্কৃতির চর্চা যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে তা নয়। বরং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুল-কলেজে এই ধরণের সংস্কৃতি আরও এক কাঠি সরেস হয়েছে। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠন নির্বাচন নেই, ছাত্ররাজনীতি পর্যন্ত নেই। এমনকি নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জায়গায় লেখা থাকে ‘ধূমপান ও রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস’।
বড় স্যাটায়ার মনে হয় এই কথাকে। ধূমপানের সমান্তরালে ভাবা হয় রাজনীতির মতো উচ্চতর হৃদয়বৃত্তির আদর্শকে। এই ব্যাপারটিকে আমি মাথা ব্যাথার কারণে মাথা কেটে নেওয়ার অপপ্রয়াস বলেই মনে করি। আসলে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংস্কৃতি চর্চা কিংবা আয়োজনের সাথে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তুলনা করলে আমার কেবলই মনে হয় ওদের চিত্ত এখনও আন্দোলন-সংগ্রাম-মননশীলতার চর্চায় ক্রিয়াশীল।

আমাদেরটায় এখন ঘুন ধরেছে। গবেষণা-জ্ঞান উৎপাদন তো নেইই এখানে আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহ্যও আমরা হারাতে বসেছি। এসব নিয়ে চিন্তা করলে আরেকটা কথা মনে পড়ে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ দাস উৎপাদন নয়, বরং এর প্রধান কাজ হচ্ছে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার চর্চা’। কথাটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের ভিসি অধ্যাপক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। তাই হয়তো আমি বারংবার বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নতিকল্পে মনে মনে একজন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কেই স্মরণ করি।

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম

সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়





Find Nobin Kontho on Facebook