ব্যতিক্রম হয় কখনো কখনো, সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজনীতির খেলায় কখনো কখনো কম আসন পাওয়া দল থেকেও সরকারপ্রধান নিযুক্ত হয়ে যেতে পারেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতে এ রকম কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী পাওয়া গিয়েছিল—ভিপি সিং, চন্দ্র শেখর, দেব গৌড়া ও আই কে গুজরাল। তবে সংসদীয় ব্যবস্থায় সাধারণত জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতাই সরকারপ্রধানের পদে বসেন, প্রধানমন্ত্রী হন। এটা হচ্ছে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক সংসদীয় অনুশীলন। ব্যতিক্রম বাদ দিলে এভাবেই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে মূলধারার
রাজনৈতিক স্রোতগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন দ্বন্দ্ব, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই সংসদীয় অনুশীলনটির ব্যাপারে ভাবিয়ে তুলেছে সুশীল সমাজের একটি অংশকে। দলপ্রধান ও সরকারপ্রধানের পদ দুটিকে দুই ব্যক্তির হাতে দেওয়া হলে মূলধারার রাজনীতির অরাজকতা কমবে বলে মনে করতে শুরু করেছেন কেউ কেউ। আসলে কি তাই?
দলপ্রধান ও সরকারপ্রধান পদ দুই ব্যক্তির হাতে থাকার ক্ষেত্রেও উদাহরণ হতে পারে ভারত। দেশটিতে ২০০৪ সাল থেকে কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের (ইউপিএ) কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায়। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ও তার মিত্রদের সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী-উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতির চোটে কোয়ালিশনের প্রধান শরিক দল কংগ্রেসের প্রধান সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদটি নেওয়া থেকে বিরত থাকেন বলে অনেকে মনে করেন। পেছনের কারণ যা-ই হোক, সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের প্রধান হিসেবেই থেকে যান আর প্রধানমন্ত্রী পদে বসান মনমোহন সিংকে। মোটকথা ভারতে সরকারপ্রধান ও দলপ্রধান পদে আলাদা ব্যক্তি আছেন। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? এতে করে ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে কি উল্লেখ করার মতো ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে? ছোট্ট একটি তালিকাও কি করা সম্ভব? ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উন্নতি দূরে থাকুক; কংগ্রেসের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে কি?
একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কতটুকু সফল হয় বা না হয় তা অনেকাংশে নির্ভর করে রাজনৈতিক তৎপরতায় স্থান পাওয়া ইস্যুগুলোর ওপর। চলতি বছরে প্রকাশিত ভারতবিষয়ক অ্যান আনসার্টেইন গ্লোরি গ্রন্থে এই মত দিয়েছেন জাঁ দ্রিজ ও অমর্ত্য সেন। বছর দশেক ধরে দুই পদে দুই ব্যক্তি থাকা ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিংবা আরও ছোট করে বললে কংগ্রেস পার্টির মধ্যে তেমন কোনো উদ্যোগের খোঁজখবর পাওয়া যায় না, যা গণতন্ত্রের নামে গালভরা অতিকথনের জায়গায়, ধরা যাক, বাজার অর্থনীতির আঘাতজনিত গণদারিদ্র্য, বৈষম্য বৃদ্ধি, সংকটে জর্জরিত হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যা কিংবা হিন্দু মৌলবাদের ব্যাপকতা বৃদ্ধির মতো গণতন্ত্রবিনাশী সমস্যাগুলোকে আলাপ-আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। কিংবা দল করে টাকা বানানো, সন্ত্রাস-দুর্নীতি প্রসঙ্গ? দুই পদে দুই ব্যক্তির জমানায় কংগ্রেস দল গান্ধী পরিবারের বলয় থেকে মুক্ত হওয়ার এতটুকু ধারা তৈরি করতে পেরেছে কি? বিশ্লেষকেরা এখন পর্যন্ত তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। এই দাবি কি করা সম্ভব যে সোনিয়া গান্ধীর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে মনমোহন সিং একটি সিদ্ধান্তও নিয়েছেন, নিতে পেরেছেন কিংবা নেওয়ার ইচ্ছা দেখিয়েছেন? বুঝতে কি অসুবিধা হয় যে ক্ষমতার চাবিটি অবশ্যই সোনিয়া গান্ধীর হাতে? দুই পদে দুই ব্যক্তি—প্রায় এক দশক হয়ে গেল, কম সময় তো নয়।
এবার তাকানো যাক সংসদীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান ব্রিটেনের দিকে। কী দেখা যাচ্ছে? দেখা যাচ্ছে যে ডেভিড ক্যামেরন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন থাকার সূত্রে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ হাউস অব কমন্সের নেতা এবং তিনিই প্রধানমন্ত্রী। মোটকথা একই ব্যক্তি তিনটি পদে। সমস্যা কোথায় দেখা যাচ্ছে? অন্তত ভারতের সঙ্গে তুলনায়? এ দুই দেশের মধ্যে সংসদীয় ব্যবস্থা তথা উদারনৈতিক গণতন্ত্র কোথায় ভালোভাবে কাজ করছে? বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মান কোথায় উন্নত? ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানের দিক থেকে কোন দেশটি এগিয়ে? এসব প্রশ্নের উত্তরে সবাই ব্রিটেনকেই দেখিয়ে দেবেন।
ভারত বা ব্রিটেনের উদাহরণ থেকে এটুকু স্পষ্ট যে রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুই পদে এক ব্যক্তি বা দুই পদে দুই ব্যক্তি থাকাটা প্রধান সমস্যা বা প্রধান সম্ভাবনার কোনোটিই নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ধরা যাক, বাংলাদেশে দুই পদে দুই ব্যক্তি ব্যবস্থা চালু হলো, তাতে কী হবে? ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব যাঁর হাতে থাকবে প্রধানমন্ত্রী চাইলেও তাঁর ইচ্ছার বাইরে যেতে পারবেন? হঠাৎ করে, নিজের রাজনৈতিক পরিণতি না ভেবে আচমকা কিছু একটা করে বসতে পারেন হয়তো। কিন্তু সেটি হবে নেহাতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আর একটি ব্যাপার হচ্ছে, সংসদীয় ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে রাজনৈতিক দল। মনে রাখতে হবে, প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল আপামর জনসাধারণের মনোবাঞ্ছার ঘনীভূত প্রকাশস্বরূপ।
চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলকে যাঁরা হালকা করে দিতে চান কিংবা বিতর্কিত করে দিতে চান তাঁরা হয় অজ্ঞ অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বুদ্ধিমান। আসল কথা এই যে সংসদীয় ব্যবস্থায় দলপ্রধানের হাতেই ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি থাকে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। এখন দলপ্রধান যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন বা করতে চান, দুই পদে দুই ব্যক্তি বসিয়ে তা বন্ধ করা যাবে কি? যাবে না। এসব বিবেচনা মাথায় রাখলে এটা বলা যায় যে, দুই পদে একই ব্যক্তিকে না রাখার ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। এতে মূল কার্যসিদ্ধি হবে না। কারণ, উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পুষ্ট হওয়ার ব্যাপারটি এ ধরনের যন্ত্রবৎ উদ্যোগ গ্রহণ বা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে না। বরং এটা নির্ভর করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান বিকাশের ওপর। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান বাড়ানো গেলে কোন পদে কয় ব্যক্তি তা কোনোভাবেই গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠবে না, উদাহরণ ব্রিটেন। এমনকি এটা কোনো বড় সম্ভাবনাও তৈরি করে না, উদাহরণ ভারত।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান বিকাশের ব্যাপারটা কীভাবে বোঝা যাবে? এ ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রশ্নের দিকে মনোযোগ দেওয়া যায়। জনগণ নাগরিক হয়ে উঠেছে কি? পাওয়ার এলিটরা (সরকার ও বিরোধী দল) জনগণকে সমঝে চলে? নাকি জনগণের নাম ব্যবহার করে যা ইচ্ছা তা-ই করে? সুশীল সমাজ প্রয়োজন পড়লে সরকার ও বিরোধী দলের ঘাড়ে হাত না হলেও চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে কি? নাকি সুশীল সমাজ কেবল দুই পক্ষের বিবাদ বন্ধকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ? এমনকি রাষ্ট্রের মূলনীতি, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সঙ্গে আপস করে হলেও? একে বকে দিতে হলে ওকেও বকে দিতে হবে মার্কা সুশীল সমাজ? কেবল রাজনীতিকদের গালমন্দ করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান বাড়ে না। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পালনীয় দায়িত্ব-পালন সম্পর্কে জনগণের মুখের ওপর কথা বলার মতো নির্ভীক বুদ্ধিজীবীর অস্তিত্ব আছে কি? নাকি বুদ্ধিজীবীরাও কাজে-অকাজে জনগণের দোহাই পাড়েন এবং ভুলে থাকেন যে জনগণ ভুল করতে পারে? তেমন পরিস্থিতি হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেই হবে। অ্যান্থনি গিডেন্স (১৯৯৮) তাঁর দ্য থার্ড ওয়ে: দ্য রিনিউয়াল অব সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বইতে নাগরিকদের ‘অধিকার’-এর পাশাপাশি ‘দায়িত্ব’ পালনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সত্য বটে, গিডেন্সের এ ব্যাখ্যা গণমানুষের পাওনাগুলো তাত্ত্বিকভাবে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে টনি ব্লেয়ারের মতো রাজনীতিকদের ভীষণ সাহায্য করেছে। তার পরও বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান উন্নয়নের প্রয়োজনের দিক থেকে দেখলে ‘রাইটস’ নিয়ে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি ‘রেসপনসিবিলিটি’ নিয়ে কথা বলার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। এসবের সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো (উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচন কমিশন) সরকারদলীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে কাজ করতে পারে কি না, তা দেখাটাও রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান যাচাইয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর মেলে না। এ জায়গাটায় কাজ করা দরকার। তা না করে আজ এক টোটকা কাল আরেক টোটকায় কোনো কাজ হবে না।
ড. শান্তনু মজুমদার: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়