সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৭

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন এবং ‘ফাঁপর সংস্কৃতি’ | ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা হচ্ছে ইদানীং। নানা ধরনের বিধি প্রণয়নের কথাও শুনছি। এর অর্থ মানের অবনতি হচ্ছে। তাই চিন্তিত সচেতন সুধীজন। চিন্তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলাম নিয়ে। ভাবনার অন্ত নেই রাজনৈতিক দৃষ্টিতে ও অর্থ বাণিজ্যের বিচারে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে। শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির নষ্ট সময় নিয়েও আমাদের আতঙ্ক কম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট প্রদানের যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। এখানে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির আয়োজন দৈবাত্ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে কঠিন রাজনীতিতন্ত্রের হাত ধরে। বিদগ্ধ পণ্ডিতজন কালো ছায়া থেকে দূরে থাকেন, তাই তারা ক্ষমতাবানদের কাছে পরিত্যাজ্য। এ কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। রাজনীতির টিকিট ও তৈলবাজদের দৌরাত্ম্যে এখন জ্ঞানচর্চার সুস্থ ধারা নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতা বজায় রেখে কোন আরক সেবন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন সম্ভব তা আমার প্রায় সাড়ে তিন দশকের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি না।

আমরা কি জানি এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে ছেলেদের হলগুলোতে ‘ফাঁপর সংস্কৃতি’ চালু হয়েছে! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া যে তরুণদের নিয়ে আমরা আশায় বুক বাঁধি—দেশকে এগিয়ে নেবে বলে ভরসা করি তাদের ব্যক্তিত্ব আর সাহস ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই অবক্ষয়টির শুরু হয়েছে সকল শাসন পর্বে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতাদের প্রতাপ দেখানোর অভ্যাস থেকে। বিশেষ করে ছাত্র হলের কিছু কিছু কক্ষের নামই হয়ে গেছে ‘পলিটিক্যাল কক্ষ’। সেখানে ভবিষ্যতের গুণধর রাজনীতিকরা বসবাস করেন। এসব ‘ব্রাহ্মণ’ কক্ষের ধারে-কাছে ‘শূদ্র’ সাধারণ ছাত্রদের বিচরণ মানা। তবে কোনো ‘অন্যায়’ আচরণ করলে শাস্তি পাওয়ার বিধান রয়েছে। সে শাস্তি অনেকটা প্রাচীন ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবির বিধানের মতো। সামান্য অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান ছিল ব্যাবিলনে। এখানেও তাই। জুনিয়র কোনো ছাত্র দৈবাত্ কোনো নেতাকে দেখে সালাম দেয়নি কিংবা সিনিয়র বড় ভাইকে না জানিয়ে বাইরের দোকানে ভাত খেতে গেছে— এসবের জন্যও শাস্তির বিধান আছে। বেশ কয়েক বত্সর আগে হলগুলোতে মাঝে মাঝে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে ছাত্রদের আটকে রাখা হতো মিছিলে যাওয়ার জন্য। শান্তিপ্রিয় বলে হল প্রশাসনও এসব দেখে সাধারণত নীরব থাকেন। ফলে কায়েম থাকে ষাণ্ডতন্ত্র। সেদিন হয়তো কোনো ক্লাসের টিউটোরিয়াল পরীক্ষা ছিল। ছাত্রদের করুণ টেলিফোন আসতো; স্যার, (আগের পর্ব হলে) ছাত্র দলের, (বর্তমান পর্বে) ছাত্রলীগের মিছিল আছে। তাই আমরা আটকে গেছি। আগে জানতাম ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র কল্যাণে দায়িত্ব পালন করে। এখন পেশিশক্তি দেখাতে তত্পর থাকে। এমন অবস্থায় কখনো কোনো ছাত্র বিজয়ীর বেশে ক্লাসে বা পরীক্ষা হলে আসতো। এক গাল হেসে বলতো স্যার পেছনের দেয়াল টপকে চলে এসেছি। এখন বোধ হয় সংস্কৃতি একটু পাল্টেছে। কারণ এখন আর গেট বন্ধ রাখতে হয় না। কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়ে আছে। দলীয় নির্দেশই যথেষ্ট। ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাক বা না থাক আদেশ না মানলে ‘গেস্টরুম ব্যবস্থা’ তো আছেই! এ বিষয়ে যাদের জ্ঞান স্পষ্ট না তাদের কাছে কিছুক্ষণ পর ফিরে আসবো।

সেদিন এক ছাত্র এলো ওর উপস্থিতি সংকট রয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতির জন্য ১০ নম্বর আছে। ছেলেটি কয়েকটি ক্লাস করতে পারেনি। দিন তারিখ সব কাগজে লিখে এনেছে। বললো এই না আসতে পারায় ওর দায় নেই। ওকে মিছিলে আর মিটিংয়ে যেতে হয়েছে। আমি জানলাম ও সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত নয়। আমি বললাম এখন নাকি হলের গেট বন্ধ করে না, তা হলে তুমি আসলে না কেন? জানালো, এখন জানিয়ে দিলেই মিছিলে থাকতে হয়। অনুপস্থিত থাকলে ফোন করে। তখন ক্লাসে থাকলেও উঠে যেতে হয়। আমি বুঝলাম এ এক বিশাল বন্দিশালায় বসে আমাদের ভবিষ্যত্রা বিদ্যার্জন করছে।

এসব প্রসঙ্গে আলাপ করতে গিয়েই আমি ‘ফাঁপর সংস্কৃতি’ সম্পর্কে অবহিত হলাম। অনেক নতুন নতুন শব্দ ব্যবহার করে এ সময়ের তরুণরা। ‘ফাঁপর’ তেমন একটি শব্দ। তবে শব্দটা একেবারে আনকোড়া শব্দ না। প্রচলিত বাংলা শব্দে এর ব্যবহার আছে। সাধারণত দমবন্ধকর কোনো অবস্থা বোঝাতে ফাঁপর শব্দের ব্যবহার আছে। আমি জানতে পারলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এক ধরনের মাত্স্যন্যায় চলছে। ইতিহাস থেকে জানি, সাত শতকের মাঝ পর্ব থেকে আট শতকের মাঝ পর্ব পর্যন্ত বাংলায় মাত্স্যন্যায়ের যুগ চলছিল। এর সরল অর্থ অরাজকতার যুগ। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার। ক্যাম্পাসেও এখন নাকি ফাঁপরের মাত্স্যন্যায় চলছে। সিনিয়র ছাত্র জুনিয়র ছাত্রকে ফাঁপর দেয়, সবল ছাত্র নেতা দুর্বল ছাত্রকে ফাঁপর দেয়, শিক্ষক ছাত্রকে ফাঁপর দেন। ক্ষমতাবান শিক্ষক ফাঁপর দেন নতুন জয়েন করা জুনিয়র সহকর্মীকে। তারা ঠিক করে দেন কার সঙ্গে চলবে, কার ধারে কাছে মাড়াবে না। কী করলে প্রমোশন সহজ হবে। কী ভুল করলে আটকে যাবে। বলাই বাহুল্য, এসব হিসাব-নিকাশের সাথে একাডেমিক যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি সাধারণত গুরুত্ব পায় না।

জানলাম হলে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়া নবাগত ছাত্ররা নাকি সিনিয়র ছাত্রের ফাঁপরের শিকার হয় বেশি। ছোটখাট বিষয়েও নাকি বড় ফাঁপর ভোগ করতে হয়। এসবকে এক ধরনের র্যাগিংও বলা যেতে পারে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং হল প্রশাসন সব সময় বলে বেড়ায় তারা র্যাগিং বন্ধে তত্পর। প্রক্টরিয়াল বডি বলে একটি প্রশাসনিক সংগঠন থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এর সদস্যরা অভিভাবকের মতো সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তাহলে কীভাবে প্রকাশ্যে ফাঁপর দেওয়া চলছে? যেসব তথাকথিত সিনিয়র ছাত্রের যাদের নিজেদের সংস্কৃতি বোধ নিয়ে সন্দেহ আছে, তারা নাকি সহবত শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে জুনিয়রদের। অমুক ছাত্র সিনিয়রকে দেখে সালাম দেয়নি। অমুকের চাল চলন দেখে বেয়াদবি বলে মনে হয়েছে। সিনিয়র পছন্দ করে না তেমন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলেছে। ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের বন্ধুর সঙ্গে এক টেবিলে বসে নাস্তা করেছে। খবর দেওয়ার সাথে সাথে আসেনি। আধঘন্টা দেরি করেছে। এসব অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান আছে। চড়-থাপ্পর থেকে শুরু করে ব্যাঙ বানানো অর্থাত্ ফ্লোরে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হবে। জুনিয়রদের ওপর এসব খড়্গ আরোপ করে এক পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে এসব সিনিয়ররা। আর অপেক্ষা করে কবে সিনিয়র হবে। এসব ওরা আবার প্রয়োগ করবে জুনিয়রদের ওপর।

বেয়াদবি যদি একটু বেশি হয়ে যায়—যেমন নেতা খবর পাঠিয়েছেন কিন্তু সাড়া দিতে দেরি হয়েছে। অথবা কোনো আচরণের প্রতিবাদ করেছে বা তর্ক করেছে এসব অপরাধের দণ্ড কঠিন। এসব ক্ষেত্রে ‘গেস্টরুম ব্যবস্থায়’ যেতে হয়। হলগুলোতে একটি করে গেস্টরুম থাকে। রাতের বেলা এই গেস্টরুমগুলো ছাত্র নেতাদের নিয়ন্ত্রিত নির্যাতন কক্ষ হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে অনেক কাল ধরে। হল প্রশাসনে যুক্ত শিক্ষকরা গেস্টরুমটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে হাল ছেড়ে রেখেছেন বরাবর। ধরি, অপরাধী কোনো ছাত্রকে তলব করা হয়েছে রাত সাড়ে দশটায় গেস্টরুমে আসতে হবে। তাকে কাটায় কাটায় পৌঁছতে হবে। না হলে শাস্তির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। নানা রকম শাস্তি আছে। হয়তো ভোর পাঁচটা পর্যন্ত ঠায় বসে থাকতে হবে। পালাক্রমে পাহারা দেওয়ার লোকও থাকছে। হয়তো গ্রিলের সাথে হাত বেঁধে রাখা হবে কিছুক্ষণ। আরো সব কুিসত শাস্তিও নাকি আছে। এই সব অধোগতির খবর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনও অবহিত থাকে। তবে তাদের করার কিছু থাকে না।

আমার খোঁজে থাকা তথ্যের খুব সামান্যই এখানে উপস্থাপন করলাম। সার্বিক অবস্থা দেখে আমি ভীত অন্য এক জায়গায়। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন বিশেষ ব্যক্তিত্বের খোঁজ পেতাম নিজেদের মধ্যে। নিজেদের স্বাধীন ও দায়িত্ববান মনে হতো। সুন্দরের স্বপ্ন দেখতাম। সূর্যের সাথী হতে ইচ্ছে হতো। বিশ্ববিদ্যালয় অন্যরকম উচ্চতার জায়গায় পৌঁছে দিত যেন। এ কারণে পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেশ ও সমাজের জন্য ভাবতে পারতো। প্রতিবাদী আন্দোলনের ঐতিহ্য গড়েছিল। এখনতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিতে দিতেই তাদের ব্যক্তিসত্তাকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। মেরুদণ্ড ভেঙে নতজানু করে দেওয়া হচ্ছে। জুনিয়র থাকতে মার খেতে শিখেছে আর সিনিয়র হয়ে শিখেছে মার দিতে। মাঝে মাঝে ভাবি এসব তরুণেরও তো একটি পারিবারিক জীবন আছে। ওদের পরিবার জানে তাদের আদরের ছেলেটি বা ভাইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, এখন দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল করবে। অথচ সবার অগোচরে নষ্ট রাজনীতির ঘেরাটোপে পড়ে নিজের মনুষ্যত্বকেই হারাতে বসেছে।

একবার কি ওরা ভাবে এই যে এখন এত বাহাদুরি করছে কর্মজীবনে গিয়ে এই ছাত্র বন্ধুর দিকে তাকাতে পারবে তো! কৃতকর্মের জন্য নিজের মধ্যে কি ধিক্কার আসবে না? জীবনের লম্বা পরিধিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বছর অনেক ক্ষুদ্র। আমি এখনো বলে বেড়াই, স্মৃতিতে সুখানুভূতি ছুঁয়ে যায়। মনে পড়ে ১৯৭৮-এ যখন ভর্তি হয়ে বাবা মা ছেড়ে হলে উঠেছিলাম তখন অভিভাবকের মতো এগিয়ে এসেছিলেন পাশের রুমের বড়ভাই। নিজে নিয়ে গিয়েছিলেন নিচে। এক এক করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন খাবারের কুপন কোথায় কাটতে হয়। ক্যান্টিন কোথায়। পরদিন নিয়ে গিয়েছিলেন লাইব্রেরিতে। শিখিয়ে দিয়েছিলেন বিভাবে ক্যাটালগে বই খুঁজতে হয়। এখনো এই ভাইদের দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।

এমন পরিবেশ বজায় রেখে উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের সুযোগ কোথায়! হাজারটা মেধাবী নীতি আরোপিত হতে পারে। নানা রকম কৌশলপত্র নিয়ে বড় বড় সেমিনার সিম্পোজিয়াম হতে পারে। কিন্তু নষ্ট শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি বজায় রেখে এবং ফাঁপর সংস্কৃতিতে শিক্ষার্থীকে অভ্যস্ত করে তুলে আর যাই হোক জ্ঞানচর্চার আলোকিত ভূবনে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তাই আমি অনুরোধ করবো যারা আজ উচ্চশিক্ষার জন্য দায়িত্ববান ও ক্ষমতাবান হয়ে কর্মযজ্ঞে নামতে চান তারা আগে পরিশুদ্ধ করুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন। পাত্র প্রস্তুত না করে সতেজ ফলাহার কি পরিবেশন করা সম্ভব!

n লেখক :অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়





Find Nobin Kontho on Facebook