অনেক বছর আগের কথা। আমাদের মফস্বলে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন সামনে। পরিষ্কার মনে পড়ে দিনটি ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল ও সুখপ্রদ। কিন্তু ‘ঠিক দুপ্পুর বেলা ভূতে মারে ঢেলা’। বসন্তে বাতাসে ভরপুর দিনটির মধ্যভাগে মৌলবাদী ভূতের ঢেলা পড়ে মাথায়, বুকেও। দেশের প্রধান মৌলবাদী দলের
ছাত্র সংগঠনের হয়ে নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থীটি তার উদ্ধত সিনা ঘষটাতে-ঘষটাতে ‘ঢেলা’ মারে ‘ভাই, আপনারা আমাদের অতিথি’। বুঝতে পারা যায়নি প্রথমে—কার অতিথি? কিসের অনুষ্ঠান? পরে খুব সাড়ম্বরে ‘ওরা’ কয়েকজন মিলে ভালো করে ব্যাখ্যা করার পর বোঝা গেল সংখ্যালঘু তথা অমুসলিমরা বাংলাদেশে ‘অতিথি’ এবং ‘তাদের’ যত্ন নেয়াটা সংখ্যাগুরু তথা একজন ভালো মুসলমানের দায়িত্ব। এ দায়িত্বটা কলেজ পর্যায়ে ভালোভাবে পালনের সুযোগ করে দেয়ার জন্য ভোট চায় ধৃষ্টতাপূর্ণ মৌলবাদী তরুণ। তারপর কেটে গেছে অনেক বছর। মৌলবাদী ভূতের মারা ঢেলার ব্যথা যায়না, সংখ্যালঘুরা নিজের দেশে অতিথি! মৌলবাদ আক্রান্ত উপমহাদেশে এমন একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু (ধর্মপালনকারী এমনকি ধর্মবর্জনকারী) বোধহয় পাওয়া যাবে না যার অভিজ্ঞতাতে নেই অপমানের এমন একটি কিংবা একাধিক কিংবা অনেকগুলো কাঁটা। কাঁটাগুলো সত্যি বলতে কি শুধু মৌলবাদীরা ফেলে না কিছু কিছু সভ্য-ভদ্রলোকও কখনো বুঝে কখনো না বুঝে এমনকি কখনো কখনো অবসর বিনোদন হিসোবও মনের গভীরে সঙ্গোপনে লালিত সাম্প্রদায়িকতা চর্চা করে নেয়।
উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ আক্রান্তদের মধ্যে আছেন বর্তমানকালে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা শাহরুখ খান। তার অভিনয় ভালো না মন্দ, শিল্পসম্মত নাকি শুধু বাণিজ্য এসব প্রশ্ন অবান্তর। শুধু জেনে রাখতে হবে যে শাহরুখের অনুরাগীর সংখ্যা মিলিয়নে নয় বিলিয়নে গুণতে হয়। তিনি শাহরুখ এবং তিনি একজন খান এবং তিনি বাস করেন ভারতে—মৌলবাদী হিন্দুরা এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারে না আবার ফেলেও দিতে পারে না। তাই তারা বলা যায় নিয়মিতভাবেই শাহরুখকে অপদস্থ করার কৌশল অবলম্বন করেছে। শাহরুখের কিছু করা না গেলেও সম্ভবত হিন্দু মৌলবাদী নেতাদের ধারণা এরকম করলে তারা সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে হিন্দু মৌলবাদের ‘ঈমান’ ও ‘নিশান’ শক্তপোক্ত করতে সমর্থ হবেন। কিছুদিন আগে প্রয়াত মারাঠি মৌলবাদী ব্যাল থ্যাকারে দস্তুরমত নিয়মিত বিরতিতে শাহরুখের বিরুদ্ধে কটু বাক্য বলতেন, শাহরুখকে ‘নিজ দেশ’ অর্থাত্ পাকিস্তানে চলে যেতে বলতেন।
কিন্তু এবার খানিকটা ব্যতিক্রমী একটা ব্যাপার ঘটেছে। এবার শাহরুখকে খুব ঘটা করে পুঁজি করতে চেয়েছে পাকিস্তানের মুসলিম মৌলবাদীরা। এমনকি সুযোগ বুঝে খানিকটা প্রচারের ‘ঘি’ খেয়ে নেয়ার লোভ সামলাতে পারেনি পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন সরকার। জানুয়ারির শেষদিকে আউটলুক ম্যাগাজিনে ‘বিয়ং অ্যা খান’ শিরোনামের এক প্রবন্ধ লেখেন শাহরুখ। এতে নামের সাথে থাকা খান শব্দটি নিজের মধ্যে কত রকমের অনুভূতি জন্ম দেয় তা বলেছেন। আরো একবার মনে করে দিয়েছেন নামের সাথে খান শব্দ থাকার কারণে আমেরিকার বিমানবন্দরে হেনস্থা হবার ঘটনা। লেখার একপর্যায়ে শাহরুখ কথা বলেছেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সবকিছুর মধ্যেই দোষ ও দুর্গন্ধ খুঁজতে থাকা মৌলবাদী বদভ্যাস প্রসঙ্গে। শাহরুখ খান উল্লেখ করেন যে, ‘অসাবধানতাবশত’ ‘রাজনৈতিক নেতারা’ যা কিছুকে ভারতীয় মুসলিমদের খুঁত এবং দেশপ্রেমহীনতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে সেগুলোর প্রতীক হিসেবে তাকে চিহ্নিত করে; নিজ দেশের পরিবর্তে প্রতিবেশী দেশের জন্য আনুগত্য পোষণের অভিযোগ তোলে। বোধগম্য কারণেই মৌলবাদী না লিখে রাজনৈতিক নেতারা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে না লিখে অসাবধানতাবশত, পাকিস্তান না লিখে প্রতিবেশী দেশ লিখেছেন খান। কিন্তু যে কেউই স্পষ্ট করে বুঝতে পারেন তিনি কাকে বলেছেন এবং কী বলতে চাইছেন। একজন হিন্দু নারীর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ খান লেখাতে আরও জানান তিনি তার সন্তানদের ধর্মপরিচয় সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে একথা বলেন যে, ‘তোমরা প্রথমে একজন ভারতীয় এবং তোমাদের ধর্ম হচ্ছে মানবতা’।
লেখার মধ্যে কোথাও এতটুকু উল্লেখ না থাকলেও ভারতে শাহরুখ খানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বসেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিক; তিনি খানকে ‘নিরাপত্তা’ দেয়ার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। অতঃপর পাল্টা জবাব আসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দিক থেকে। শাহরুখের কোন নিরাপত্তা সমস্যা নেই জানানোর সাথে সাথে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন যে, শাহরুখের নিরাপত্তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে পাক নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারেই পাক কর্তৃপক্ষের মনোযোগী থাকা উচিত। পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন পিপিপি সাধারণত ধর্ম নিয়ে বাজিমাতের কর্মকাণ্ডে খুব একটা লিপ্ত হয় না। কিন্তু নির্বাচনের বছরে জনগণের দৃষ্টি অন্যদের দিকে চলে যাবার ভয়েই হয়তো মালিক ভারতীয় খানের ব্যাপারে কথা বলে বসেন। কারণ মালিকের আগেই পাক মিডিয়ার কলম ও ক্যামেরা টানতে শুরু করেছিলেন হাফিজ সাঈদ, যিনি হচ্ছেন মুম্বাইতে বোমা হামলার দায়ে অভিযুক্ত ধর্মবাদী জঙ্গি গ্রুপ লস্কর-ই-তৈয়বার প্রতিষ্ঠান। লেখা প্রকাশের পরপরই শাহরুখকে পাকিস্তানে চলে এসে যতদিন খুশি বাস করার আহ্বান জানান সাঈদ সাহেব। সাঈদ ও মালিকের বক্তব্য নিয়ে ব্যাপাক আলোড়ন, নয়াদিল্লির প্রতিক্রিয়ার পর শাহরুখ স্বয়ং জানিয়ে দেন যে, তিনি ভারতে সুখে আছেন; তার কোন নিরাপত্তা সমস্যাও নেই।
নিরাপত্তা সমস্যা নেই এটা মেনে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু শাহরুখ সুখে আছেন? একজন বাবা, একজন স্বামী, একজন পেশাদার সর্বোপরি একজন নাগরিক হিসেবে? সম্ভব কি? মনে রাখতে হবে গত বেশ কয়েক বছর ধরেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি কোন যৌক্তিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই ভারতের প্রতি শাহরুখের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ, হিংসা ও বিদ্বেষের বীজ ছড়াচ্ছে। শাহরুখ ক্ষমতাবান মানুষ; শাহরুখ লড়িয়ে মানুষ। ম্রিয়মাণ না হয়ে প্রতিবারই তিনি লড়াই করেন। কিন্তু তারপরেও তো কথা থেকে যায়। শাহরুখকে প্রতিবার জোর গলায় বলতে হয় যে তিনি ভারতে ভালো আছেন, তাকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হয় যে, তার বাবা তাজ মোহাম্মদ খান ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। এই যে বারবার নিজের ভালো থাকার কথা আওড়ানো, বারবার স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রয়াত পিতার উল্লেখ করতে বাধ্য হওয়া এটা কি স্বাভাবিকতা? সংখ্যালঘু না হয়ে সংখ্যাগুরু হলে শাহরুখকে কখনোই রুটিন মাফিক এসব কথাবার্তা বলতে হোত না। দক্ষিণ এশিয়ার একজন সুপার এলিট ধর্মীয় সংখ্যালঘুকেও কি পরিমাণ চাপের মধ্যে থাকতে হয় তা শাহরুখ খানের এবারের লেখাতেও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘যখনই ইসলামের নাম করে কোন সহিংসা সংঘটিত হয়, সে ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করাটা আমার কর্তব্য ধরে নেয়া হয়’। কেন এরকম হবে? কোন জঙ্গি কোন মৌলবাদী কি করেছে না করেছে তারজন্য বলতে গেলে বাধ্যতামূলকভাবে শাহরুখ খানকে কেন কথা বলতে হবে? এবং কথা বলাই শুধু নয় নিরন্তরভাবে তাকে দেশের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষা দিতে হবে কেন?
দক্ষিণ এশিয়ার সংখ্যালঘু এরকম অজস্র ফর্মে প্রতিনিয়ত অপমানিত হন। শাহরুখের মত যারা পাল্টা জবাব দেয়ার ক্ষমতা রাখেন তারা জবাব দেন; তবু অসুখীই থেকে যান। সাধারণ সংখ্যালঘুরা অপমান সয়ে যায়, বয়ে বেড়ায় কিংবা পালিয়ে যায়। ছোট্ট একটি অংশ সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতা ও সংখ্যালঘুর মৌলবাদে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং কাউন্টার-ঘৃণার মধ্যে সুখ খোঁজেন যা সমাজ ও রাষ্ট্রে অসুস্থতা ও সমস্যা বাড়ায় বৈ কমায় না।
শান্তনু মজুমদার, শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়