শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

আমরা কেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চাই? | শান্তনু মজুমদার

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে আমি আসলে কেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চাই তা নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। এই প্রতিষ্ঠানটাকেই আমি যা হোক খানিকটা চিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার সম্পর্ক পঁচিশ বছর হলো এবার; ছাত্র ও শিক্ষক হিসাবে। ভাবতে আশ্চর্য লাগছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কতগুলো সমস্যা আছে যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একার পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়। এগুলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ফয়সালার বিষয়। এগুলো সহসাই সমাধান হবে বলে
মনে হয় না। যাতে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে তাই আমি আরেকবার বলছি যে ম্যাক্রো লেভেলের সমস্যাগুলোর সমাধান আসতে হবে রাষ্ট্রের দিক থেকে। এটা লম্বা সময়ের সংগ্রামের বিষয়। এই সংগ্রাম জারি থাকবে, নাকি এই সংগ্রাম আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে তা জানিনা। এসব ব্যাপারে রাষ্ট্রকে শেষ পর্যন্ত কোন দিকে রাখা যাবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। উদাহরণ হিসাবে শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়িয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা-পয়সা সমাধানের সবকের কথা বলতে পারি। আমরা দেখতে পাই যে এ ধরণের বড়-বড় সমস্যাগুলোর ব্যাপারে উপাচার্যবৃন্দ ও ইউজিসি চেয়ারম্যানেরা বিশ্বব্যাংকের মত করে কথা বলেন। তফাৎ শুধু এই যে বিশ্বব্যাংক ইংরেজিতে বলে; এঁরা বাংলায় বলেন! এটা বিশেষ কোন ভিসি বা ইউজিসি চেয়ারম্যানের ব্যাপার নয়। গোটা প্রক্রিয়াটাই এমনভাবে সেট হয়ে আছে যে এমন একটি পদে বসলে এমন করেই যেন কথা বলাটা নিয়ম।

কিন্তু আমি বলতে চাইছি যে এরপরেও যে কিছু কিছু বিষয় কিন্তু আমাদের হাতের নাগালের মধ্যে আছে যেগুলোর ব্যাপারে একটা চেষ্টা দেয়া যেতে পারে।

এক্ষেত্রে আমি প্রথমে আনবো শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের কথা। সম্পর্কের বর্তমান গড়-ধরণটি আমার কাছে সমস্যাপূর্ণ মনে হয়। কারণ এখানে এই দুই পক্ষের ক্ষমতা ভীষণ রকমের ভারসাম্যহীন। আমি বিভিন্ন বিভাগের একাধিক সাবেক ছাত্র-ছাত্রীর কাছে শুনেছি যে প্রথম বর্ষে ভর্তির প্রথম বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা পরবর্তী চার-পাঁচ বছর ধরে পড়ালেখা করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। কারণ হিসাবে তারা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে এক ধরণের জমিদার-রায়ত সম্পর্কের কথা বলেছে। সব শিক্ষকের ক্ষেত্রে তারা ঢালাওভাবে এমন পর্যবেক্ষণ দেয় নি। বহু শিক্ষক আছেন পেশাগত দায়িত্ব পালনেই দায়িত্ব শেষ করেন না; বহু শিক্ষক আছেন যাঁরা তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোর জন্য ভীষণ রকমে সচেষ্ট। তারা বলেছে কোন কোন বা অনেকে শিক্ষকের কথা। আর বলেছে সামগ্রিক আবহের কথা; যে আবহের মধ্যে জমিদার-প্রজার সম্পর্কের কথা মনে পড়ে। আক্ষেপকারী শিক্ষার্থীদের এই পর্যবেক্ষণ মধ্যে খুব একটা ভুল আছে বলে মনে হয় না।

ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের এই গলতি শিক্ষার্থীর মানস গঠনের উপরে প্রভাব ফেলে। ভূক্তভোগী হলেও, এদের অনেকের মধ্যেই মুরুব্বী-মক্কেল সম্পর্কের ব্যাপারে ভক্তি তৈরি হয়ে যায়। লোকাল গভর্ন্যান্সের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে একটি গবেষণায় আমি লম্বা দিন যুক্ত ছিলাম। এই কাজটার জন্য দেশের নানান জায়গাতে আমাকে সরকারী আমলাদের সাথে কথাবার্তা বলতে হয়েছে। এদের বলতে গেলে ৯৯ ভাগই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোডাক্ট। এবং দুঃখের সাথে বলছি, সাধারণ মানুষ সম্পর্কে, জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে এদের অনেকের ধ্যান-ধারণা দেখে আমার মনে বারবার একটি প্রশ্নের জন্ম হয়েছে – পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে-বসে আমরা কাদেরকে তৈরি করছি? সামান্য কিছু বেতনের বিনিময়ে আমরা কি তৈরি করছি কিনা? সাংঘাতিকভাবে আমার মনে এই প্রশ্নটি এসেছে। উত্তরাঞ্চলের এক উপজেলাতে নিতান্ত নবীন এক আমলার সাথে আমার কথাবার্তার কথা বলি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের প্রসঙ্গে কথা বলার শুরুতেই এই আমলা বলেন,”কি আলোচনা করবো? ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা সব কয়টা চোর”। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ব্যাপারে এই হচ্ছে তার মাইন্ড-সেট। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ব্যাপারে তার মধ্যে এই ধারণাটা প্রোথিত হয়ে আছে।

আমার মনে হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে মুরুব্বী-মক্কেল সম্পর্ক দেখতে-দেখতে অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে এ ধরণের একটা মনোভঙ্গী তৈরি হয়। যে কায়দাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা ছাত্র-ছাত্রী নির্ধারিত হয় সে ব্যাপারেও অনেকের মত আমার মনে কিছু প্রশ্ন আছে। এরপরে, মানে, চাকুরী হয়ে যাবার পরে কলোনিয়ান আমলাতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে পড়ে তার মধ্যে মুরুব্বী-মক্কেলের চিন্তাটা আরো পোক্ত হয়। এসব কারণে আমার খুব করে মনে হয় যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা নিয়ে জোরালো কথাবার্তা শুরু হওয়া দরকার। কেউ কেউ বলতে চান যে বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ-বিচ্ছিন্ন কোন কিছু নয়। সুতরাং আমাদের সমাজে যা জারি আছে তার চেয়ে ভিন্ন কিছু আশা করা যাবে না। আমি এই যুক্তির বিরুদ্ধে। জনগনের টাকায় চলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জনগন অগ্রসর চিন্তা, অগ্রসর অবস্থান আশা করে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেতো একথা অনেক বেশি করে সত্য। এছাড়া ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বে থাকাটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলেও আমি মনে করি। কেবলমাত্র চাকুরে তৈরি করাটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নয়। এসব বিবেচনা থেকে বলছি যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বর্তমান ধরণটা পালটানো খুব জরুরী।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে আমার আরেকটা চাওয়া আছে – আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখতে চাই। অনেকে বলতে পারেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়তো প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ। তাদের কথাটা আরেকবার ভেবে দেখতে বলবো। এখানে এখনো ছেলেদের হলগুলো ধর্মনিরপেক্ষ নয়। অর্থ্যাৎ সব হল সব ধর্মের ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত নয়। এমনকি শিক্ষকদের জন্যও নয়। একজন মুসলিম শিক্ষক ইচ্ছা থাকলেও জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর হতে পারেন না। আবার একজন অমুসলিম শিক্ষক জগন্নাথ ভিন্ন অন্য কোন হলের হাউস টিউটর হতে পারেন না। আওয়ালীলীগের আমলে আওয়ামীলীগ, বিএনপির আমলে বিএনপি – কেউ এ ব্যাপারে কথা বলে না। দুইপক্ষেরই নিজস্ব সমীকরণ আছে। এই অগণতান্ত্রিক ব্যাপারটা ঠিক করে নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকেই সম্ভব। আমরা যদি বলি যে এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয় তাহলে এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই হওয়া উচিৎ।
তৃতীয় যে ব্যাপারটা আমি বলতে চাই তা হলো – সিরিয়াস পড়ালেখা করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আরো অনেক অনেক বেশি হওয়া উচিৎ বলে মনে করি। বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতি যারা করে তাদের পড়ালেখার পর্যায়টা অনেক বেশি এগিয়ে নেয়া দরকার। নলেজের ফাইটটা এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে এখন আর বড়-বড় জার্গন ব্যবহার করে পার পাওয়া যাবে না। আমার মনে হয় যে এক্সটেনসিভ রিডিং অ্যাবেলিটি আছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমি পাস দেয়া বা চাকুরীর পড়ার কথা বলছি না। বিসিএস পড়ুয়াদের হাতে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি বেদখল হয়ে যাওয়াটা দুঃখজনক। এটা নিয়ে কথা বলাটা নাকি বিপজ্জনক। প্রশাসন কথা বলে না, ছাত্র সংগঠনগুলোকে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কোন দিন দেখা যায় না। কেন? প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত যারা তাদের মধ্যে অগ্রসর পড়ালেখার ব্যাপারে আমি একটা আলস্য লক্ষ্য করি। আমার কথাটা কারু-কারু ভালো না লাগতে পারে। কিন্তু এটাই আমার পর্যবেক্ষণ।

বেতন বাড়ানো প্রসঙ্গে একটু আগে কথা বলছিলাম। আরেকটু বলে বক্তব্য শেষ করি। আমার মনে হয় বেতন বাড়ানোর কথা বলাটাই শেষ কথা নয়; এর পেছনে আরো অনেক-অনেক কথা লুকিয়ে আছে। সময়-সুযোগ মত ছাড়া হবে। আরেকটা ব্যাপারটা হলো বেতনাদিসহ নানা অছিলাতে শিক্ষার্থীদের ব্যয় কিন্তু বাড়ছেই ক্রমাগত। বেতন বাড়ানোর পক্ষের লোকদের বেশির ভাগই কিন্তু বিদ্যমান অবস্থার সুফল ভোগ করেছেন নিজেদের সময়ে। এখন নিজেরা একটা পর্যায়ে চলে এসে, কিংবা নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিরাপদ হয়ে যাবার পরে, এখন বেতন বাড়িয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ ওঠানোর কথা বলছেন! সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের ব্যাপারটা যখন আসছে তখন তারা একধরণের ছদ্ম-নৈর্ব্যক্তিক জায়গা থেকে বেতন, ফি ইত্যাদি বাড়ানোর কথা বলে চলছেন। রাষ্ট্রের দায়িত্বটা তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের খরচ কেন নিজেকে যোগাড় করতে হবে? বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কি বলে? আর কোন পাবলিক প্রতিষ্ঠানকেতো, এমনকি যেগুলোর পেছনে কেবল খরচই হয়, তার খরচ যোগাড়ের কথা বলা হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যা উৎপাদন করে তার বেনিফিশিয়ারি কে হয়?

আমি মনে করি, সত্যিই মনে করি যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন থাকারই কোন দরকার নেই। হাততালি পাবার জন্য কথাগুলো বলছি না। আমি মনে করে ছাত্র বেতন বর্তমানের ১০ গুন বাড়িয়ে দিলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানসম্মতভাবে চলার জন্য যে খরচ দরকার তার আশেপাশে যাওয়া যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্র যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চালাবার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নেয় তাহলে সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেবে এবং ছাত্র বেতন বাড়ানোর কথা বলে-বলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের উপরে মনস্তাত্ত্বিক চাপ জারী রাখা থেকে বিরত থাকবে। এই বাস্তবতা প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে শক্তিশালী চাপ দেখতে চাই।

শান্তনু মজুমদার। শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের তিনদিন ব্যাপী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশনের শেষ দিন, পহেলা জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে, দেয়া বৃক্ততা। ঈষৎ পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত।]