বুধবার, ২৯ জুন, ২০১৬

আনোয়ার সাদত হত্যা

১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবরের সকাল। স্থান মিশরের রাজধানী কায়রো। প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত বার্ষিক ভিক্টোরি প্যারেড পরিদর্শন করছিলেন। ১৯৭৩ সালে সংঘটিত বদর যুদ্ধে সুয়েজ খাল অতিক্রম করে মিশরীয় বাহিনী ইসরাইল-অধিকৃত সিনাই
উপত্যকার কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল। সে উপলক্ষে
প্রতি বছর এ ভিক্টোরি প্যারেডের আয়োজন হত। আকাশে বিমান বাহিনীর অনেকগুলো মিরেজ জেট উড়ছে। আনোয়ার সাদত ও মঞ্চে উপস্থিত দেশি-বিদেশি অতিথিরা তখন উপভোগ করছিলেন জেটগুলির নান্দনিক ওড়াওড়ি।

ওদিকে মঞ্চের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে সৈন্যবাহী ট্রাকগুলি। প্রেসিডেন্টকে অভিবাদন জানিয়ে। হঠাৎ থেমে গেল একটি ট্রাক। ট্রাকটির নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট খালিদ ইস্তাম্বুলি। আসলে ওই ট্রাকের আরোহী সেনারা ট্রাকচালকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে ট্রাক থামাতে বাধ্য করেন। তারপর মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান ইস্তাম্বুলি। প্রেসিডেন্ট সাদত ভেবেছিলেন, সেনারা তাঁকে স্যালুট দিতে আসছে, এটিও বুঝি প্যারডের অংশ। তাই স্যালুট নিতে উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন।

ঠিক সে সময় মাথার হেলমেটে লুকিয়ে রাখা তিনটি গ্রেনেড সাদতের দিকে নিক্ষেপ করলেন ইস্তাম্বুলি। সর্বশেষ গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হল।

ওদিকে, গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার পরপরই ট্রাকে থাকা ডেথ স্কোয়াডের চার সদস্য নেমে আসেন। এই চার জনের মধ্যে তিন জনই প্যারেড কর্মসূচিতে তালিকাভুক্ত ছিলেন না। তাদের বদলে যারা মূলত তালিকাভুক্ত ছিলেন তারা অসুস্থ বলে এদের যুক্ত করেন তিনি। বাকি একজন আবার জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য।

পরিকল্পনামতো সবই হল। ডেথ স্কোয়াডের সদস্যরা একে ৪৭ রাইফেল দিয়ে ভাণ্ডার ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আনায়ার সাদতের দিকে গোলাগুলি চালিয়ে যায়।

ততক্ষণে মঞ্চে লুটিয়ে পড়েন আনোয়ার সাদত। তখনই হেলিকপ্টারে তাঁকে মিলিটারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। এগার জন ডাক্তার তাঁর অপারেশন করেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ঘণ্টা দুয়েক পর মারা যান তিনি।
সেদিন কিন্তু সাদত যে মঞ্চে বসেছিলেন তার চারদিকে তাঁর জন্য চার স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। আটজন বডিগার্ড ছিল একদম পাশেই। তাঁর নিজস্ব নিরাপত্তা ছাড়াও শত শত নিরাপত্তাকর্মী সেদিন তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। নিরাপত্তার অংশ হিসেবে প্যারেডে তালিকাভুক্ত কোনো সদস্যের গোলাবারুদ বহনও ছিল নিষিদ্ধ।
এতসব নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে সফল ইস্তাম্বুলিরা সেদিন বাধাহীনভাবে প্রায় দু মিনিট গুলি চালাতে সমর্থ হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা হন্তারকদের দিকে গুলি চালালে ডেথ স্কোয়াডের এক সদস্য নিহত ও তিন জন আহত হয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করে যে, ইস্তাবুলিসহ তিন হন্তারক ‘মিশরীয় ইসলামিক জিহাদ’ নামের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আনোয়ার সাদত তাঁর শাসন ক্ষমতার প্রথমদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার একটি ছিল, আবদেল নাসের হুসাইনের সময় গ্রেফতারকৃত ধর্মীয় উগ্রবাদীদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া। এতে তাঁর সঙ্গে দেশটির ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সম্পর্ক ভালো হলেও এর স্থায়িত্ব বেশি হয়নি।
১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইসরাইলের সঙ্গে ‘ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ড’ নামে ইতিহাসখ্যাত একটি চুক্তি সাক্ষর করে মিশর। মূলত তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মার্কিন প্রেসিডেন্টদের গ্রামীণ নিবাস ক্যাম্প ডেভিডে বার দিনের গোপন আলোচনা চলে ইসরাইলের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের সঙ্গে মিশরীয প্রেসিডেন্টের। এরপর হোয়াইট হাউসে মিশর-ইসরাইলের মধ্যে দুটি ফ্রেমওয়ার্কের এই এগ্রিমেন্টের প্রথমটি স্বাক্ষর হয়। পরেরটি হয় বছর খানেক পর, ১৯৭৯ সালে, যেটি ‘মিশর-ইসরাইল শান্তি চুক্তি’ নামে পরিচিত।
ইসরাইলের সঙ্গে সমঝোতায় আসার জন্য সাদত ১৯৭৮ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পান, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেগিনের সঙ্গে যৌথভাবে। কিন্তু এ ঘটনার পর আরব বিশ্বের বহু দেশ সাদতের বিপক্ষে চলে যায়। মিশরের ওআইসি সদস্যপদ বাতিল করা হয়।
একই সময়ে দেশের ভিতরে কিছু রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচীও নেন সাদত। এসব কিছুই উগ্র গোষ্ঠীগুলোকে খেপিয়ে তুলে। তারা সরকারের একটি অংশের সঙ্গে আঁতাত করে নিজেদের লোকদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ব্যবস্থা করে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, আনোয়ার সাদতসহ সরকারের উপরের স্তরের সকল নেতাকে হত্যা করা।
আনোয়ার সাদতের কাছে বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্ট এমনই ছিল যে, তাঁকে হত্যার চক্রান্ত চলছে। তিনি সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের ভিতরের ও বাইরের চক্রান্ত নস্যাৎ করার জন্য বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেন। তবে ইস্তাবুলিরা এক অজ্ঞাত কারণে সে অভিযান জালের বাইরে থেকে যায়।
মূলত আনোয়ার সাদতদের মতো ব্যক্তি বিশেষের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশাসন দিয়ে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যদি সামাজিক স্তরে নিরাপত্তা-ঝুঁকি বিনির্মাণ-বান্ধব উপাদান থাকে, তাহলে কেবল প্রশাসন দিয়ে মোকাবেলা অসম্ভব। পশ্চিমা বহু দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য তেমন প্রশাসনিক নিরাপত্তার আয়োজন থাকে না। সামাজিক ব্যবস্থাই তাদের নিরাপত্তার প্রধান হাতিয়ার।
বিজন সরকার
সিউলের মেইল বক্স
ভাষা গবেষক; রাজনৈতিক বিশ্লেষক।