রবিবার, ১৭ জুলাই, ২০১৬

বিশ্বায়ন, সন্ত্রাসবাদ ও নারীদের অবস্থান


নিওলিবারেল গ্লোবালাইজেশনের এই মহাকালে, আন্তর্জাতিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তরাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক সন্ত্রাসের ব্যাপক বিস্তৃতির এই যুগে, ইসলামী মৌলবাদজাত সন্ত্রাস আজ এক ত্রাসরূপে আবির্ভূত হয়েছে গ্লোবালাইজ বিশ্ব পরিবারে। আমি এই বাক্যটিকে আমার
থিসিস ধরে লেখাটা এগিয়ে নিতে চাই। বাক্যটিতে বেশ চটকদার শব্দমালা, যেমন, ‘নিওলিবারেল গ্লোবালাইজেশন’, ‘ইসলামী মৌলবাদজাত সন্ত্রাস’  আর ‘গ্লোবালাইজ বিশ্ব পরিবার’  ইত্যাদি আমি ব্যবহার করেছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই শব্দগুলো বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কি আদৌও গুরুত্ব বহন করে? উত্তর হলো করে।

শুরুতেই অল্প ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে নিচ্ছি। বাংলাদেশের গুলশানে হামলা হবার পরিপ্রেক্ষিতে বহু মানুষ বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে। আইসিস আছে, কি নেই, তাই নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন তোলপাড়। জঙ্গিদের সাথে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের একটা যোগসূত্র আবিষ্কার করা হয়েছে। বলতে পারি, গুলশানের ঘটনাটি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের বিশ্বায়ন তথা গ্লোবালাইজেশন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে যেই বিষয়টা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে তা হলো, বর্তমানের জটিল বিশ্ব পরিস্থিতে, যখন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বশক্তি ও মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রি-কমপ্লেক্সের যোগাযোগে মধ্যপ্রাচ্যে চলছে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, তখনই আইসিসের আবির্ভাব ঘটে, যা আবার কিনা বিশ্বব্যাপী কৌতূহল ও পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামভীতির এক ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি করে- আরো বলা যেতে পারে, যার ফলে ট্র্যাম্পের আবির্ভাব বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চে।

মুক্তবাজার অর্থনীতির আর বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা নিওলিবারেল গ্লোবালাইজেশনের অবশ্যম্ভাবী টার্গেট কারণ বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিওলিবারেল বণিকগোষ্ঠীর কাছে সবচাইতে আকর্ষণীয়। খুব কম মূল্যে শ্রমিক পাওয়া যায় বাংলাদেশে। আর খুব সহজেই পশ্চিমা বিশ্বে হঠাৎ অচল হয়ে পড়া, অথবা আউটসোর্স যোগ্য পণ্যের বিশাল বাজার হলো বাংলাদেশসহ বহু দেশ। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প পশ্চিমের পোশাকের বাজারে ক্রমাগত পণ্যের সরবরাহ করছে এবং পুরনো বাজারগুলো বন্ধের কারণে বাংলাদেশের বাজারগুলো ক্রমাগত খুলে যাচ্ছে দেশি-বিদেশি বেনিয়াদের কাছে। বাজার অর্থনীতির চাহিদা মেটাতে মালিকপক্ষ বাংলাদেশের বেশির ভাগ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিকে পরিণত করেছে নরকে- শ্রমিক নিগ্রহ, ওভার টাইম, অনিয়মিত বেতন এইগুলো নৈমিত্তিক ঘটনা। রানা প্লাজার ঘটনার পর মিডিয়ার কল্যাণে এই নিওলিবারেল নরককুণ্ডের ( পোশাক শিল্প) খবর বাংলাদেশের ধীরে ধীরে ফুলেফেপে উঠা মধ্যবিত্তের ঘরে পৌঁছে গেছে।

আবার ভাবধারা বা আদর্শেরও বিশ্বায়ন ঘটছে। আমেরিকার সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ম্যাকডোনালাইজেশন নামে বহু আগে থেকেই সংজ্ঞায়িত যেমন ডালাস ও ম্যাকগাইভারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংস্কৃতির ম্যাকডোনালাইজেশন শুরু হয়েছে বহু আগে থেকেই। বলিউড কালচার, টিভি সিরিয়াল ও সানি লিওনির (দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যমান প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিকতার অবদমিত নিওলিবারেল স্বাধীনচেতা নারীর সাইন হয়ে উঠেছেন তিনি) ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে বাংলাদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির ‘গ্লোবালাইজেশন’ পুরোদমে চলছে। অন্যান্য ‘গ্লোবালাইজেশন’ কালচারও বসে নেই কিন্তু, আকাশ সংস্কৃতি আর ইন্টারনেটের কল্যাণে ওয়াহাবি, সালাফি, ও অন্যান্য র‍্যাডিক্যাল ইসলামী চিন্তাধারা বহু আগে থেকে বাংলাদেশে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। কিন্তু উচ্চ মধ্যবিত্তে এর প্রভাব বেশি বলে ব্যাপকভাবে বিষয়টি অনালোচিত থেকে গেছে। সাত একের (মনে হচ্ছে, গুলশানের ঘটনা ভবিষ্যতে সাত এক হিসেবে আলোচিত হতে থাকবে) পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্তের মধ্যে বিভিন্ন ইসলামী ভাবধারা নিয়ে আলোচনা চায়ের কাপে ঝড় তুলছে। অবশ্য, ইসলামী মৌলবাদ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয় – যারা ইসলামী মৌলবাদ নিয়ে জানতে আগ্রহী তারা সৌদি ওয়াহাবি রাজতন্ত্র, ইরানের শিয়া ইসলামী গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে একটু ইন্টারনেট ঘাটতে পারেন, অথবা এরই মধ্যে ঘেঁটেও নিয়েছেন আর নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী ব্যাখ্যাও তৈরি করে ফেলেছেন। যাঁরা ইসলামী মৌলবাদের ক্ষতিকর দিক নিয়ে জানতে আগ্রহী অবশ্য ঈষৎ বস্তুনিষ্ঠ লেখা পেতে হলে জিয়াউদ্দিন সরদারের দ্বারস্থ হতে পারেন।


এখন, ‘গ্লোবালাইজেশন’ অথবা বিশ্বায়ন কি ক্ষতিকারক অথবা এর কি কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার আদৌ সম্ভব? উত্তর হলো, না। আমরা কি গ্লোবালাইজ বিশ্ব পরিবারের অন্তর্গত? অবশ্যই।

বিশ্বায়নের এই যুগে গ্লোবালাইজেশন জন্ম দিয়ে চলেছে ভয়াবহ অসাম্যের আবার কারো কারো জীবনের দুয়ার খুলে যাচ্ছে মুহূর্তে –কিন্তু এই আন-ইভেন (অসম) বিশ্বায়ন কিন্তু কোনোভাবেই থেমে নেই। অসাম্যের সীমারেখা তৈরি করে সে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট, ছোট সংস্কৃতির বিশ্বায়নে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একাংশ মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু দেশে যাচ্ছে কাজ করতে আর সেখানকার সংস্কৃতিগুলোর সাথে বোঝাপড়ায় লিপ্ত আছে, মধ্যবিত্তের অথবা উচ্চ মধ্যবিত্তের গ্লোবালাইজেশন হচ্ছে তাদের থাইল্যান্ড অথবা মালয়েশিয়ায় অবকাশ যাপনের খোয়াবে আর খায়েশ পূরণে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অথবা, অস্ট্রেলিয়া অথবা, ইউরোপে ছাত্রবৃত্তি অথবা অভিবাসন নিয়ে প্রবাসী হওয়ার কল্যাণে। গ্লোবালাইজেশনের সবচাইতে অগ্রগণ্য বেনিফিশিয়ারি দেশের উচ্চবিত্ত  শ্রেণি। নিওলিবারেল অথবা উদার অর্থনীতির সাইনগুলো পড়তে তারা সবচাইতে বেশি পারঙ্গম।

এই নিওলিবারেল উচ্চবিত্ত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্রেণিটি তাই ক্রমশ হয়ে উঠেছে অর্থনীতির, রাজনীতির, সমাজনীতির অথবা পররাষ্ট্রনীতির নিয়ন্তাগোষ্ঠী। তারা বাজারকে বিশ্বের অথবা প্রতিবেশী দেশের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে চায়– অবাধ ও মুক্ত বাণিজ্যের ভূয়সী প্রশংসা করে তারা দেশের মিডিয়াগুলোতে। তাই বিশ্বায়নের তেজি ঘোড়া যখন আজকে ছুটে চলেছে মাঠে-প্রান্তরে, এই শ্রেণিটি (যারা গ্লোবালাইজ এলিট বলে পরিচিত) তখন সর্বত্র ঘোষণা করে আজ যেন সব মুক্ত-অবারিত।

এই  শ্রেণিটি আবার নারী অধিকার আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী। আরও উল্লেখ্য, নিওলিবারেল গ্লোবালাইজেশনের সফট টার্গেট অপশ্চিমা বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের নারী। ধরে নেওয়া হয়ে থাকে অপশ্চিমা নারীদের আজও পুরো মুক্তি ঘটেনি –পশ্চিমের নারীরা অবারিত, মুক্ত – দে হ্যাভ লটস অব চয়েজ, আদারস ডোন্ট। কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অথবা সত্যিও নয়, অথবা যে এই বাইনারিতে ‘নারী’ কে ক্যাটেগোরাইজ করা হচ্ছে, সেটি নিওলিবারেল গ্লোবালাইজেশনের পুরুষতান্ত্রিক ও ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনার সমর্থক– এই বিশেষ প্রণোদনাটি বাংলাদেশের সমাজে বিশেষ আলোড়ন তৈরি করেছে। প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থা আর আরো ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজ চেতনার মধ্যে এক ধরনের স্পষ্ট দ্বন্দ্ব আজ সামনে চলে আসছে।

এইখানে অবশ্যই বলে রাখি, আমি সনাতন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জয়গান গাইতে এই লেখা লিখছি না। সনাতন সমাজ ব্যবস্থা আর মানুষের তথা নারী-পুরুষ-অন্যান্য লিঙ্গের দ্বন্দ্ব বহুকাল ধরে চলে আসছে। সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে, বিবর্তনের এই আমোঘ ধারা অলঙ্ঘনীয়। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে যেভাবে বিশ্বায়ন অভিঘাত সৃষ্টি করছে তাতে একটি ভ্রান্ত ধারণা বাংলাদেশসহ মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে বেশি করে সামনে চলে আসছে – আর তা হলো ইসলাম আর পশ্চিমের মধ্যে লড়াই চলছে। এই মনোলিথিক ধারণাটি হান্টিংটন প্রচার করেন, রক্ষণশীল-দক্ষিণপন্থী পশ্চিমা মিডিয়া তা ফলাও করে প্রচারও করে ঠাণ্ডাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। এডওয়ার্ড সাইদ ‘ক্ল্যাশ অব ইগনোরেন্স’ (২০০১) বলে এর একটি জুতসই জবাবও লেখেন। এই ধারণাটি বিশ্বের রক্ষণশীল রাজনৈতিক ক্যাম্পগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। হাল আমলের জাকির নাকেয়ের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব এই ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন মিথের চুইয়ে পরা ধ্যান-ধারণা (অবশ্যই মধ্যযুগীয় নয়, বরং বিশ্বায়িত দক্ষিণপন্থী ইসলামী চিন্তাধারা) ফলাও করে প্রচার করে। অথচ, এই দক্ষিণপন্থী ক্যাম্পগুলোর, বিশেষত ওয়াহাবি, সালাফি, শিয়া দক্ষিণপন্থী চিন্তাধারাগুলোর ইসলামী বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ভুলিয়ে দেয়, আমরা বাস করছি এমন এক কালে যখন সর্বত্র পুঁজির (পুঁজি কখনোই মনোলিথিক নয়, বরং গিরগিটির মতো ক্রমাগত রং বদলাতে পারঙ্গম) জয়জয়কার।

সহজ করে বলতে গেলে, নিওলিবারেল গ্লোবালাইজেশনের হেজেমনি পশ্চিমাদের হাতে থাকলেও– বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই নিওলিবারেল পুঁজির আগ্রাসী পদচারণের বেনিফিশিয়ারি। গালফ রাষ্ট্রগুলো যেমন পুঁজির ব্যাপক বিশ্বায়ন ঘটিয়েছে, তেমনি ঘটাচ্ছে চিন, ভারত, রাশিয়া অথবা অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলো। আমরা টার্কি, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে ক্রমবর্ধিষ্ণু অর্থনীতির প্রভাবে ঘটা সামাজিক-রাজনৈতিক ডামাডোলের কথা প্রায়ই শুনে থাকি। আমরা নিওলিবারেল অর্থনীতির একটা নতুন বাঁক দেখতে পাই, আরব বসন্তের সূচনা আর তার বিভিন্ন সফল-অসফল পরিসমাপ্তির পরে । ইতিহাসে একে কীভাবে চিহ্নিত করা হবে, অর্থাৎ আরব বসন্ত কি ওয়ার অন টেররের একটি শাখা প্রশাখা মাত্র, নাকি, এর বিশেষ ও সুদূরপ্রসারী সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অভিঘাত সৃষ্টির অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা এখনো আছে, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।


আরব বসন্তের যেই অভিঘাতটি সমসাময়িক পশ্চিমা ও অপশ্চিমীয় মিডিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছে, তা হলো ইসলামী মৌলবাদের ব্যাপক বিস্তৃতি। হাল আমলের বোকো হারাম, আল-কায়েদা তো আছেই, সাথে যুক্ত হয়েছে আইসিস নামক নতুন আপদ। গুলশান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আইসিস সম্পর্কে দেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা একটা ধারণা লাভ করেছে- তারা এও জেনে গেছে র্যাডিকেল ইসলামের বীজ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে উচ্চ-মধ্যবিত্তের ঘরেও বহু আগে থেকেই পৌঁছে গেছে।

গুলশান হামলার পরবর্তী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াগুলোও গ্লোবালাইজড, যদিও আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মোটা দাগে এই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াগুলো টপ ডাউন অর্থাৎ বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত, দেশীয় প্রতিক্রিয়াগুলো বহুরূপী কিন্তু বটম আপ। যদিও স্থূলভাবে আওয়ামী ঘেঁষা ও ডানপন্থী বিএনপি জামাত ঘেঁষা প্রতিক্রিয়াগুলো অনেকাংশে এক রৈখিক বিভিন্ন বামঘেঁষা বিশ্লেষণগুলো (আমি মনে করি বামেরা বিশ্লেষণ করে এবং এটা গুরুত্বপূর্ণ) জঙ্গিবাদের মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ডিস্কোর্সের বিকেন্দ্রীকরণে (যেহেতু দুইয়ের অধিক হামলাকারী উচ্চ শ্রেণির আর ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্র ছিল) ব্যাপক উৎফুল্ল প্রতিক্রিয়া (বিশ্লেষণ শেষ পর্যন্ত অন্ধ  শ্রেণি-কেন্দ্রিক প্রতিক্রিয়ায় পর্যবসিত) ব্যাক্ত করেছে। তাদের মধ্যে বেশ কিছু আগ বাড়িয়ে ভারত-ইসরায়েল অথবা অতি উৎসাহী হলে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে দোষারোপ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে।

এই অতি সরলীকরণে ঢাকা পড়ে গেছে নিওলিবারেল গ্লোবালাইজেশনের এই কালে ইসলামী মৌলবাদের ব্যাপক সহিংস আত্মপ্রকাশ। শাহরিয়ার কবির বহুকাল ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গি ইসলামী মৌলবাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এসেছেন আর শাহরিয়ার কবিরের মতো ইসলামী মৌলবাদকে মনোলিথিকভাবে দেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়, বরং বিশ্বের জটিল ভূ-রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ‘নারী’- বিষয়ে ইসলামজাত ও কোরআন-সুন্নাহ, হাদিসের আলোকে গড়ে ওঠা ইসলামকেন্দ্রিক ও পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধ ডিসকোর্সগুলোর নারী-বিষয়ক এক কেন্দ্রিক, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রিডাকটিভ চিন্তা-ভাবনার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা।


গ্লোবালাইজেশন নারী প্রশ্নটিকে সব সমাজেই সামনের কাতারে নিয়ে এসেছে, বিশেষ করে মুসলিম সমাজগুলোতে নারীর সমঅধিকারের আন্দোলনটি হিজাব-সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। অথবা, আরো সরলভাবে বলতে গেলে, ইসলামী মৌলবাদী আন্দোলনগুলো নারী-প্রশ্নটিকে এমনভাবে সামনে এনেছে, এত ব্যাপকভাবে ইসলামী ঘরানার নারীদের সম্পৃক্ত করেছে, যেমন বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্রী সংস্থা, যার কেন্দ্রে আছে নারীর সম্মানের (ইজ্জত) প্রশ্নটি, যেমনটা করে নারীর সম্মানের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছিল উপনিবেশবাদী আন্দোলনগুলোর কালে। তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া ঘোষ বলেছেন, নাসরিনকে উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ করলে মনে হয়, তিনি মৌলবাদী পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জাতীয়তাবাদী পুরুষতন্ত্র আঁকড়ে ধরতে চাইছেন, কিন্তু নাসরিনের অবস্থান, সেটি নারীবাদী বটে, বেশ জটিল। এখানে ইসলামী মৌলবাদী নারী-মুক্তি আন্দোলন আর ৯০ পরবর্তী তসলিমা নাসরিন-কেন্দ্রিক নারীবিরোধী একইসাথে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির উত্থান বেশ লক্ষণীয়।

বাংলাদেশের মৌলবাদীরা যে একটি জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের প্রস্তাবনা সামনে নিয়ে এগোচ্ছিল, যা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সেকুলার জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী (৭১ অস্বীকার, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সংস্কৃতিকে অস্বীকার ইত্যাদি তাদের প্রকল্পের অন্তর্গত ছিল), সেখানে তসলিমা নাসরিন différance রূপে আবির্ভূত হন। একদিকে তিনি বাংলাদেশের ইসলামী মৌলবাদের বৈশ্বিক মৌলবাদী প্রেরণায় আঘাত হানেন, অন্যদিকে তিনি বিনপি-আওয়ামী লীগের বাংলাদেশ-বাঙালি কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের প্রকল্পকে অস্বীকার করে নুইয়ে পড়া পশ্চিমা-কেন্দ্রিক, উপনিবেশবাদী, আর ইউরোপকেন্দ্রিক শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত নারীবাদের ছায়াতলে আশ্রয় নেন, তসলিমা নাসরিনকে ঘিরে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের বিশ্বায়ন ঘটে।

কিন্তু, ইসলাম-বিচ্যুত তাসলিমা নাসরিন নারীর বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতার বিপরীতে অবস্থান নেন, ঘোষ আমাদের বলেন। বিশ্বায়িত তসলিমা নাসরিন কিন্তু তত দিনে লোকাল (অর্থাৎ অবিশ্বায়িত অর্থে)বিপ্লব করে ফেলেছেন, যা কি না আবার ব্যক্তিমানুষের (নাড়ী/ নারী/ স্বাধীনতাকামী, পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা অর্থে/ সাইনে) উত্থানও বটে। ঘোষের বিশ্লেষণে এবং পরবর্তীতে নাসরিনের ‘ক’ আর ‘ফরাসি প্রেমিক’-এর প্রকাশনার পর স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে নাসরিন ফিমেল সেক্সুয়াল অটোনমিকে সামনে নিয়ে এসেছেন অর্থাৎ বিবাহ, যৌনতা, সন্তান জন্মদান, অথবা যাপিত জীবনের ধারা প্রতিষ্ঠায় নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। বৈশ্বিক নারীবাদের সাথে তিনি বাংলাদেশের নারীবাদকে এইভাবেই পরিচিত করিয়ে দেন।

বিশেষত, পশ্চিমা নারীবাদের বিবর্তনের ইতিহাসে যখন উপনিবেশের শৃঙ্খলিত নারী ইউরোপ-কেন্দ্রিকতার ক্রিয়ানক ও জাতীয়তাবাদের উপলক্ষ হিসেবেই কেবল ব্যবহার হয়ে এসেছে, তাসলিমা নাসরিন তখন আবির্ভূত হন এক মেলবন্ধনের সাইন হিসেবে –সময়টাও আমাদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন আমাদের, ঠাণ্ডা যুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র, বাজার সম্প্রসারণে সিম্বল পশ্চিমের খুব দরকার। বাজার নারীকে তথা পুরুষকে নিত্যনতুন ঘেরাটোপে বন্দি করে বটে, কিন্তু মনে রাখতে হবে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা নারীরা এই সময়ে অনেকাংশে এগিয়ে গেছেন। যদিও গাত্রবর্ণ (রেইস),  শ্রেণি চরিত্র (ক্লাস) আর জটিল লৈঙ্গিক-সমতা ভিত্তিক আন্দোলনের তীব্র আঁচ এখনকার মতো পশ্চিমা নারীর অধিকার আন্দোলনে তত দিনে লাগেনি। অন্যদিকে, নব্বইয়ের দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় মৌলবাদের ডামাডোলে আর সর্বব্যাপী হেটেরোনর্মাটিভিটির প্রভাবে, মধ্যবিত্ত নারীর সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অগ্রযাত্রার চিত্র খানিকটা ঢাকা পড়ে গেছে। বাংলাদেশের শ্রমজীবী- সাধারণ কর্মজীবী নারীদের সেই সময়কার সমতাভিত্তিক আন্দোলনের চরিত্রটি ঠিক মতো দাঁড় করানো আরো জটিল, বর্তমানের নিওলিবারেল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের ব্যাপক লড়তে হচ্ছে, কিন্তু তার আন্দোলন অনেকাংশেই সামনের সারিতে চলে এসেছে।


তসলিমা নাসরিনের নারীবাদী প্রতিবাদের বিশ্বায়ন পরবর্তী বাংলাদেশের নারী প্রশ্নটিকে বহু প্রশ্ন ঘিরে রেখেছে এবং বৈপরীত্যের সূতোয় বাঁধা এই প্রশ্নগুলো রানা প্লাজা পরবর্তী, গুলশান পরবর্তী রিপ্রেজেনটেটিভ ডিস্ককোর্সগুলো এমনভাবে সামনে এনেছে যে, একদিকে প্রতীয়মান হয়ে গেছে নিওলিবারেল অর্থনীতি কর্মজীবী নারীর অধিকারের বিষয়টি অনিশ্চিত করে রেখেছে, আবার অন্যদিকে বৈশ্বিক ইসলামীকরণ আন্দোলনের প্রভাবে গড়ে ওঠা মৌলবাদ সব  শ্রেণির নারীর প্রতি আরো অসহনশীল হয়ে উঠছে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নারী সমঅধিকার বিষয়টি বেশ জটিল পরিমণ্ডলে, অর্থাৎ একদিকে পশ্চিমা বিশ্বায়ন, অতি রক্ষণশীল ইসলামী মৌলবাদের বিরোধিতা, নিওলিবারেল অর্থনীতি, ক্রমস্ফীত দক্ষিণ এশিয় জাতীয়তাবাদ, লোকাল ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় টানাপড়েন–ইত্যাদির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। মনোলিথিক ধ্যান-ধারণাগুলো দেশীয় পরিমণ্ডলে নারীর অটোনমি সর্বদাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ব্যাপক আলোচনা পাওয়া শফি হুজুরের ‘তেঁতুল তত্ত্বটি ‘ এখনো লিবারেল মধ্যবিত্ত সমাজে আলোচিত হয়। বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করা জাকির নায়েকের সালাফিবাদী নারী-বিদ্বেষ পিস টিভির কল্যাণে রক্ষণশীল উচ্চ-মধ্য-নিম্ন ঘরে ঘটা করে পৌঁছে যাচ্ছে।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মের নারীরা যে প্রাতিষ্ঠানিক আর পেশাদারি সাফল্য অর্জন করছে তা বহুল অংশে ম্লান হয়ে যাবে যদি সুবিধাবঞ্চিত ঘরের নারীদের প্রতিদিনের সংগ্রামকে আমলে না নিয়ে আর নারীর প্রতি সহিংসতার ইতিহাস সামনে না রেখে, কেবল উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের স্বার্থকে সামনে রেখে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হয়। মৌলবাদবিরোধী লড়াই একই সাথে নিওলিবারেল গ্লোবালাইজেশনের সাথে বোঝাপড়ার লড়াই এবং একই সাথে সেটি তৃণমূলের লড়াই।

বাংলাদেশে নারীকে পহেলা বৈশাখে নিগ্রহ করা আর তার বিপরীতে পহেলা বৈশাখের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি, ইউরোপে আরব অভিবাসী তরুণদের তাহাররুশ উদযাপন, ইসলামী টেলিইভাঞ্জেলিসটদের ক্রমাগত নারীবিরোধী আস্ফালন এবং বোকো হারামের ও আইসিসের সেক্স স্লেভ ডিসকোর্সের মুসলিম দুনিয়াব্যাপী মৌন সম্মতি প্রমাণ করে সন্ত্রাস, একুশ শতকের ধর্মান্ধতা আর মুক্তবাজার অর্থনীতির সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিপীড়নের সামনে নারী কত অসহায়। সেক্সুয়াল অটোনমির যে স্বপ্ন তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের নারীদের দেখিয়েছিলেন বহু আগে তা আজ পর্যবসিত হিজাব-করা/ হিজাব না-করার উটকো তর্কে। এই তর্ক যখন সমাজের নারী-ভিত্তিক চিন্তাধারাকে বাইনারি রূপ দিতে সফল হবে, সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলতাজাত ইসলামীকরণ তাতে আরো দৃঢ় ভিত্তি পাবে, নিওলিবারেল অর্থনীতির জাল বহু নারীকে শ্রমবাজারে আরো ভালনারেবল করে তুলবে।

নারীর সাফল্য তখনই অর্জিত হবে যখন সে পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণভাবে বিরোধিতা করতেও পিছপা হবে না, এর মধ্যে আছে বিবাহ প্রতিষ্ঠানকে ছুঁড়ে ফেলা, যৌনতাকে সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করা অথবা অধিকতর চিন্তার স্বাধীনতা অর্জন, তবে তা হতে হবে নিওলিবারেল ও জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপ কাটিয়ে গ্লোবাল ও লোকালের ডায়ালজিক মেলবন্ধন ঘটিয়ে। অথবা, অন্যভাবে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে, যারা কি না ঘোরতরভাবে পুরুষতান্ত্রিক, ঢেলে সাজানো। ইসলামী মৌলবাদকে বিরোধিতা করাও এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অপরাপর গ্লোবাল স্পেসের মুসলিম নারীদের আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের নারীদের মিলের থেকে অমিলই বেশি। এজন্য নারীদের আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।

আসিফ ইকবাল

লেখক : গবেষক