সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১৬

জীবিত ম্যান্ডেলা মৃত ম্যান্ডেলা

রাজনীতি এবং আধিপত্য থেকে আফ্রিকার কালো মানুষের মুক্তিদাতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী নেলসন ম্যান্ডেলার যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, সেটা দেশে দেশে রাষ্ট্রের চরিত্র, আমজনতার হাল অবস্থা, বিশ্বমানবতার বা মানুষের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ফ্রেমওয়ার্কে সময়ের পরিক্রমায় নানান মাত্রা লাভ করেছে।

আফ্রিকার দেশে দেশে তো বটেই, বাদবাকি বিশ্বেও নেলসন ম্যান্ডেলার অবস্থান, গ্রহণযোগ্যতা এবং দর্শন নানান মাত্রায় গৃহীত (বা নিগৃহীত!) হয়েছে। তাই তাঁর পরিচিতি কোনো কোনো সময় বিশ্বরাজনীতির চরিত্র, নয়া পুঁজিবাদী বিশ্বের চালক ও চলক, মার্কিন ও তার সহযোগীদের যুদ্ধবাজ পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তর্জাতিক কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থের বাটখাড়ায় মাপজোক করে উপস্থাপিত হয়েছে। উপস্থাপনার এ রাজনীতি তাঁর মৃত্যুর পরেও সমান তালে জারি আছে। তাই নেলসন ম্যান্ডেলাকে একজন মানবতাবাদী, মহান ব্যক্তিত্ব, শান্তির দূত, আত্মত্যাগের মহান আদর্শ, পারসন অব উইজডম, সহনশীলতার উদাহরণ এবং আধুনিক দক্ষিণ আফ্রিকার স্রষ্টা প্রভৃতি বিশেষণের আবরণে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে।

অবশ্যই ম্যান্ডেলার ব্যক্তিত্ব ও কৃতকর্মের বিবেচনায় এসব বিশেষণেরও ন্যায্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তাঁর বিপ্লবী রাজনৈতিক দর্শন কী ছিল, বিশ্বরাজনীতিতে তাঁর অবস্থান কী ছিল, সমাজতান্ত্রিক বনাম পুঁজিবাদী বিশ্বের রাজনীতিকে কীভাবে দেখতেন, আমেরিকা-ব্রিটিশ-ইজরাইল নেক্সাসকে কীভাবে শনাক্ত করেছিলেন, যুদ্ধবাজ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে সমালোচনা করেছেন কতভাবে এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনীতির অসম সম্পর্ককে কী হিসেবে দেখেছেন প্রভৃতি বিষয়-আশয় অদ্যাবধি সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমের জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর এবং ভীতিকর বলেই, মৃত্যুর পর একজন ‘আজন্ম বিপ্লবী’ ম্যান্ডেলাকে মানবতার চাদরে ঢেকে দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক চরিত্র আড়াল করবার একটা সূক্ষ্ম রাজনীতি আমরা লক্ষ্য করছি। এ নিবন্ধে তার সামান্য খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুর সংবাদে অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই এবং প্রত্যাশা মোতাবেকই, তামাম দুনিয়ায় শোকের মাতম উঠেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে গণমানুষ তথা নিচতলার মানুষের মধ্যে– নিপীড়িত, নির্যাতিত, বঞ্চিত মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বজন হারানোর বেদনা যেমন ডুকরে উঠছে, তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে সমাজের উঁচুতলার মানুষের মধ্যেও বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রকাঠামোর ব্যবস্থাপনায় সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণিও শোকগাথা রচনা করছেন। এমনকি বর্ণবাদের মতো ভয়াবহ অসম সম্পর্ককে যারা সমাজে নিষ্ঠার সঙ্গে জারি রেখেছে এবং নিজেদের শ্রেণিস্বার্থের জন্য নানান ছদ্মবেশে বর্ণবাদী রাজনীতির প্রয়োগ করছে, তারাও বর্ণবাদবিরোধী এ মহান নেতাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছে।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী, যারা ম্যান্ডেলার জীবতাবস্থায় বিশেষ করে তার সক্রিয় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সময়কালে তাঁকে সন্ত্রাসী, কমিউনিস্ট (গালি অর্থে!), নিকৃষ্ট প্রাণী বলে সকাল-বিকাল গালি দিতেন, তাঁরাও বিশেষণের প্রাবল্যে এবং সম্মানের ফুলঝুড়িতে ভরিয়ে দিয়েছেন ম্যান্ডেলার মৃত্যুকে।

মৃত্যু মানুষকে মহান করে দেয়। কেননা মৃত্যু মানুষকে সব ধরনের হিসেব-নিকেশের উর্ধ্বে নিয়ে যায়। তাই মৃত্যুর শোকগাথা সাধারণত সকল প্রকার ইহজাগতিক স্বার্থের উর্ধ্বে মানুষের মনের গভীর থেকে আপনাআপনি সঞ্চারিত হয়। কিন্তু সর্বজনীন মানবতাবাদের বিপ্রতীপে গিয়ে মার্কিন, ব্রিটিশ এবং ইজরাইলের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতেও এক ধরনের উপস্থাপনার রাজনীতি লক্ষ করা যায়, যেখানে পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে সমাজতন্ত্রী বিশ্বের, পশ্চিমা বনাম বাদবাকি বিশ্বের অসম সম্পর্ক, প্রভুত্বের ইতিহাস এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতার একটা আভাস পাওয়া যায়।

সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হচ্ছে, ম্যান্ডেলাকে এসব রাষ্ট্র মৃত্যু-উত্তর কীভাবে, কোন ভাষায় এবং কোন মর্যাদায় সম্মান করছে তার ভেতর দিয়ে সেসব রাষ্ট্রের তথাকথিত মানবতাবাদী এবং উদার গণতান্ত্রিক ইমেজ বাজারে বিনামূল্যে প্রচার করার একটা মওকা হিসেবে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ মৃত্যুর পরও ম্যান্ডেলা মার্কিন-ব্রিটিশ-ইজরাইল নেক্সাসের উপস্থাপনায় ব্যবহৃত হচ্ছেন রাজনৈতিক উপাত্ত হিসেবে। বিষয়টা তথ্য-প্রমাণসহ ব্যাখ্যা করা যাক।

নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পরপরই হোয়াইট হাউজ থেকে একটি অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়, যার প্রথম বাক্য হচ্ছে, ‘‘আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার একজন নিকট বন্ধুকে হারাল।’’(১) অথচ ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ নিকট বন্ধু নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা টেরোরিস্টদের তালিকায়।(২) ম্যান্ডেলার প্রতি শোক-বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট বক্তব্য শেষ করেন ছোট একটি বাক্য দিয়ে– ‘‘তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন।’’(৩)

ম্যান্ডেলাকে ভালো মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রকারান্তরের নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে জাহির করার রাজনীতি!

অথচ ২০০৩ সালে আমেরিকা যখন তার নেতৃত্বের অন্যান্য অক্ষশক্তি নিয়ে ইরাক আক্রমণ করতে যাচ্ছিল, নেলসন ম্যান্ডেলা তখন তার সমালোচনা করায়, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট এ ‘ভালো লোক’ সম্পর্কে বলেছিলেন, “একজন দুশ্চরিত্র, মার্কিনবিরোধী এবং সাদ্দামের একনিষ্ঠ সাপোর্টারের কাছ থেকে মার্কিনবিরোধিতা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। কেননা তিনি হচ্ছেন দীর্ঘদিনের কমিউনিস্ট এবং সন্ত্রাসীদের মদদদাতা।”(৪)

ম্যান্ডেলাকে সন্ত্রাসীদের মদদদাতা হিসেবে উপস্থাপনার অবিরাম কসরৎ এখনও মার্কিন মুল্লুকে অত্যন্ত যত্মের সঙ্গে– বিশেষ করে রাজনীতিক এবং একাডেমিক পণ্ডিতদের কাছে– জারি আছে।

পিটার বিইনার্ট চমৎকার বলেছেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিক এবং একাডেমিক পণ্ডিতরা নব্বইয়ের দশকের কোল্ড ওয়ারকে বর্ণনা করেন দুটি শক্তির– একটি হচ্ছে মার্কিন-সমর্থিত ‘মুক্তির শক্তি’ (ফোর্সেস অব ফ্রিডম) এবং অন্যটি হচ্ছে সোভিয়েত-সমর্থিত ‘নিষ্ঠুরতার শক্তি’ (ফোর্সেস অব টাইরানি) হিসেবে– যেখানে ম্যান্ডেলা নিষ্ঠুরতার পক্ষে ছিলেন।”(৫)

কিন্তু সেই নিষ্ঠুর লোকটির মৃত্যুর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন দরদী হয়ে উঠেছে যে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর ভাষণে ৯ ডিসেম্বর সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নেলসন ম্যান্ডেলার সম্মানে হোয়াইট হাউজ, সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সেনা স্থাপনাগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার ঘোষণা দেন।(৬) ‘দুশ্চরিত্রের কমিউনিস্ট’, ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘সন্ত্রাসীদের মদদদাতা’র মৃত্যুতে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে– যেটি সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র জেহাদে লিপ্ত– কমিউনিস্টদের জাতশত্রুতে পরিণত করা একটি দেশ– কেন তাঁর প্রতি এত বড় সম্মান দেখাচ্ছে?

এখানেই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত উদার গণতন্ত্রের গলাবাজি– মানবতাবাদের দোহাইকে জায়েজ করার এবং মানবতাবাদের চাদর দিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলার অস্তিত্বের যে রাজনৈতিক সত্ত্বা– তাকে আড়াল করার সাম্রাজ্যবাদী কূটকৌশল।

ব্রিটিশকুলও এ রাজনীতিতে কম পাকাপোক্ত নয়। নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তো রীতিমতো সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “নেলসন ম্যান্ডেলা কেবল আমাদের সময়ের হিরো নন, তিনি সবসময়ের সর্বকালের হিরো।”(৭)

অথচ এ ডেভিড ক্যামেরনই ১৯৮০ এর দশকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন তার রুমে ‘হ্যাঙ ম্যান্ডেলা’ বা ‘ম্যান্ডেলাকে ফাঁসিতে ঝুলাও’ শিরোনামে একটি ছবি টাঙিয়ে রাখতেন,(৮) যা নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক মিডিয়াতে ব্যাপক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁকে তাঁর সময়ের ‘নায়ক’ হিসেবে অভিহিত করায় বিশ্বমিডিয়ায় ইতোমধ্যে ডেভিড ক্যামেরনকে ‘হিপোক্রেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

উপমহাদেশের বিখ্যাত সাংবাদিক এমজে আকবর ‘দ্য সানডে গার্ডিয়ান’-এ হিপোক্রেটের হিপোক্রেসির চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন–(৯) ‘‘ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেছেন, তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ, কেননা তিনি মানুষের মধ্যকার শ্রেষ্ঠত্বটাকেই বের করে আনতে পেরেছিলেন। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব আপনি তখনই উপলব্ধি করবেন, যখন আপনি তাঁর সঙ্গে বা তাঁর সাহচর্যে থাকবেন।’’(১০)

অথচ ২০০২ সালে ম্যান্ডেলা যখন ‘ওয়ার অন টেরোরিজম’-এর নামে আফগানিস্তানে মার্কিন-ব্রিটিশ আক্রমণের সমালোচনা করেন, এ টনি ব্লেয়ারই নেলসন ম্যান্ডেলাকে অর্থাৎ তাঁর ভাষায় একজন ‘শ্রেষ্ঠ’ মানুষকে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মানুষ বলে গালি দিয়েছিলেন। এটাই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনীতির নীতিহীন রাজনীতি। তাদের প্রয়োজনে যেমন তারা কাউকে পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ’ মানুষ বানাতে পারে, আবার তাদের প্রয়োজনেই তারা একই মানুষকে পৃথিবীর ‘নিকৃষ্ট’ মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে! ইরাক, আফগানিস্তান এবং ইজরাইলের প্রশ্নে ম্যান্ডেলার অবস্থান রযাডিক্যাল ছিল বলেই ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি ম্যান্ডেলাকে ‘নিকৃষ্টতম মানুষ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে।(১১)

ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মন্তব্য আরও চমকপ্রদ। ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “মানুষ তাঁকে [নেলসন ম্যান্ডেলাকে] মনে রাখবে একটি নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার পিতা হিসেবে এবং নৈতিকতার বিচারে একজন শ্রেষ্ঠ ‘মরাল লিডার’ হিসেবে।”(১২)

এ নেতানিয়াহুই ম্যান্ডেলাকে ইয়াসির আরাফাতের পরে ‘ইজরাইলের সবচেয়ে বড় শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর মুক্তির প্রায় দুই সপ্তাহ পর প্যালেস্টাইনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতকে আলিঙ্গন করে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘ইজরাইল হচ্ছে একটি টেরোরিস্ট রাষ্ট্র, যারা নিরস্ত্র এবং নিরীহ আরবদের নিষ্ঠুরভাবে জবাই করছে’–(১৩) নেতানিয়াহুই তখন ম্যান্ডেলাকে ইজরাইলের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কী এমন ঘটেছে যে, ইজরাইলের চিরশত্রু হঠাৎ করে ‘মরাল লিডার’-এ পরিণত হলেন?

এটাই উপস্থাপনার রাজনীতি। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইজরাইলের এ নেক্সাসকে ম্যান্ডেলা যত চমৎকারভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তাদের সম্মিলিত অন্যায়কে যখন বাদবাকি বিশ্ব অনেকটা ‘মনে না নিলেও মেনে’ নেওয়ার নীতি নিয়ে রাজনীতি করছিলেন– ম্যান্ডেলা তখন উচ্চকণ্ঠে তার প্রতিবাদ করেছিলেন এবং বিশ্ববাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন এ তিন বলয়ের যৌথ মিথ্যাচার, তিন অ্যালাইয়েন্টের সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং এ তিন মিত্র কর্তৃক বিশ্বব্যাপী জারি রাখা সাদা বনাম কালোর রাজনীতির ‘হিডেন’ এজেন্ডা।

ইরাক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে ২০০২ সালে ম্যান্ডেলা বলেন, “বুশ এবং ব্লেয়ার কেউই কোনো ধরনের প্রমাণ দিতে পারেননি যে ইরাকের কাছে জীবনবিধ্বংসী মারাত্মক কোনো অস্ত্র আছে। অথচ আমরা সবাই জানি, ইজরাইলের কাছেই বরং এ ধরনের অস্ত্র আছে। কিন্তু আমরা সেটা নিয়ে কোনো কথা বলি না। কেন এক দেশের জন্য এক নীতি আর অন্য দেশের বেলায় অন্য নীতি? তার কারণ একটা হচ্ছে ব্ল্যাক, আরেকটা হচ্ছে হোয়াইট।’’(১৪)

ম্যান্ডেলা এভাবেই মার্কিন-ব্রিটিশ-ইজরাইলের বর্ণবাদী রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন।

কিন্তু আজ যখন ম্যান্ডেলা জীবনের পরপারে চলে গেছেন, তখন তাঁকে উপস্থাপন করা হচ্ছে মহান মানবতাবাদী হিসেবে; সময়ের হিরো, শ্রেষ্ঠ মানুষ কিংবা মরাল লিডার হিসেবে। আর এ আখ্যা দেওয়ার ভেতর দিয়ে তাঁকে এক ধরনের সুফি, দরবেশ কিংবা চার্চের পাদ্রিমার্কা নরমেটিভ, অবজেকটিভ এবং ‘আ পলিটিক্যাল’ ইমেজ দেওয়া হচ্ছে। কেননা ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক দর্শনের গুণকীর্তন করা এবং তাঁর রাজনৈতিক দর্শন বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা করা প্রকারান্তরে মার্কিন-ব্রিটিশ-ইজরাইলের আধিপত্যবাদী পররাষ্ট্রনীতির জন্য হুমকি জিইয়ে রাখারই সমান।

অন্যদিকে, এসব অতিমানবীয়, অতি মহান এবং হাইপার ডোজ পারসোনালিটি ডিসকোর্স দিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকে সম্মান দেখানোর ভেতর দিয়ে মূলত তারা নিজ নিজ দেশের– মার্কিন, ব্রিটিশ এবং ইজরাইল– মানুষের কাছে নিজেদের উদারনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য যেমন একটি পাবলিসিটির স্পেস তৈরি করছেন– অন্যদিকে বিশ্ববাসীর কাছে ম্যান্ডেলাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখানোর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা ঘরানার ‘মানবতাবাদ’-এর বিশ্ববাজারে নতুন চাহিদা ও কদর বানাচ্ছেন।

তাই ম্যান্ডেলাকে ‘অতিমানবীয়’ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার এই প্রয়াস, এটা মূলত মানবতার চাদরে ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক সত্তা ঢেকে দেওয়ার একটা রাজনীতি।

ধন্যবাদ ম্যান্ডেলা। জীবতকালে যেমন তুমি এসব পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী এবং সাদা-কালোর বর্ণবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে নিজের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে খোদ নিজেকেই এক কালান্তরের কিংবদন্তী করে তুলেছ– তেমনি তুমি তোমার জীবনাবসানের মধ্য দিয়েও সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির যে কদর্য চেহারা তা আরও একবার উন্মোচিত করলে। তাই জীবিত ম্যান্ডেলার চেয়ে মৃত ম্যান্ডেলা অধিকতর প্রেরণাসঞ্চারী।

নিখিল বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, মেহনতি মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য বৈশ্বিক রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ এবং আধিপত্যবাদবিরোধী যে লড়াই জারি আছে, সে লড়াইয়ে তুমি সবসময় এক অশেষ অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে ছিলে, আছে এবং থাকবে।

ম্যান্ডেলা, তোমার মৃত্যু আমাদের আরও বিপ্লবী করে তোলে। তাই তুমি রবে নিরবে হৃদয়ে মম।