বুধবার, ১৪ জুন, ২০১৭

অমর বিপ্লবী: চে গুয়েভারা

জীবন মৃত্যুতেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কারও কারওরও মৃত্যুকে কুর্নিশ করে ইতিহাস। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রক্তমাংসের দেহ ফেলে তাঁরা উঠে যান অমরত্বের এমন সোপানে; যার আর ক্ষয় নেই। ক্রুশকাঠে হত্যার পর কবর থেকে পুনরুত্থান ঘটেছিল নাজারেথের যিশুর। আর চেকে গুলি করে হত্যার ঘটনা হয়ে
উঠেছে মানবতার জন্য আত্মদানের আধুনিক মিথ। মৃত্যুই তাঁকে অমর করেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন বিপ্লবের যিশু।

১৯৬৭ সালের অক্টোবরে চের মৃত্যুসংবাদ পৃথিবী জানতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তখন লিখেছিল, ‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।’ কথাটা সত্য হয়নি। কিউবা বিপ্লবের নায়ক, বিশ্ববিপ্লবী চে গুয়েভারা জীবিতকালেও রূপকথার নায়ক ছিলেন। মৃত্যুর পর হয়ে উঠলেন এক বৈশ্বিক মিথ। মৃত্যুর পরও লড়ে চললেন এই যোদ্ধা। মহাকাব্যের কাহিনির মতো আর্জেন্টিনার এই চিকিৎসক জগতের লাঞ্ছিত-ভাগ্যহতদের মুক্তির দিশারি হয়ে উঠলেন।

গত শতকের ১৯৬০-এর দশকের পরের সব বিপ্লবেই চের আত্মদানের আবেগ জেগে উঠেছিল—দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইরান, ফিলিপাইন থেকে নিকারাগুয়া, চিলি থেকে ভেনেজুয়েলায়। সেটা ছিল এক অশান্ত তারুণ্যের দশক। ইউরোপ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত চলছে যুব বিদ্রোহ। বাংলাদেশের তরুণেরা গণ-আন্দোলন, অভ্যুত্থান হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের দিকে ছুটছে। আফ্রিকার বণর্বাদবিরোধী আন্দোলন, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ভারতের নকশাল আন্দোলন। দুনিয়ার লাখো তরুণ চের পথে জীবন দিয়েছেন।

১৯৫৬ সালে একদল যোদ্ধাসহ ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে সাগর পাড়ি দিয়ে চে এসে নামেন কিউবার উপকূলে, এক অসম্ভব উদ্দেশ্য নিয়ে। কিউবায় অভিযান চালিয়ে তাঁরা উচ্ছেদ করবেন আমেরিকার অনুগত স্বৈরশাসক বাতিস্তাকে। শুরুতেই দলের ৮২ জন গেরিলা নিহত হন। অথচ দুই বছরের মাথায় অসম্ভব সাহসিকতা নিয়ে হাভানায় বিজয় পতাকা ওড়ালেন চে। আমেরিকার নাকের ডগায় প্রতিষ্ঠা করলেন লাতিন আমেরিকার প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। মাঝারি উচ্চতার এই বিপ্লবীর ভাবমূর্তি তখন পরাশক্তির সমান। টাইমস পত্রিকার পাঠক জরিপে তাঁকে পাওয়া যায় বিশ শতকে বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী ২৫ জনের মধ্যে নবমতম স্থানে।

‘বিপ্লবের এই কঠিন কাজে আমাদের মৃত্যু এক নিয়মিত দুর্ঘটনা।’ এক ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধার মৃত্যুতে তিনি লিখেছিলেন। মৃত্যু আসবেই কিন্তু তা জাগাবে ‘যুদ্ধ ও বিজয়ের নতুন ডাক’। চে গুয়েভারার মৃত্যু হতে পারত ১৯৫৪-৫৬ সালে মেক্সিকোতে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণের সময়। মৃত্যু হতে পারত ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বরে কিউবার উপকূলে গেরিলা দল নিয়ে অবতরণের পরপরই আসা আক্রমণে। তিনি নিহত হতে পারতেন তখন থেকে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদের যেকোনো বিন্দুতে। তিনি নিহত হতে পারতেন আফ্রিকার কঙ্গোতে বিপ্লবী যুদ্ধ চালানোর পরিস্থিতিতে। তিনি নিহত হতে পারতেন কিউবার পিগস বে সৈকতে আগ্রাসী মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে কঠিন যুদ্ধে। কিন্তু নিহত হলেন কিনা বলিভিয়ার জঙ্গলে। ঝুলিতে তখন তাঁর এক নোটখাতাভর্তি প্রিয় কবিদের কবিতা। গেরিলা শিবিরের আগুনের আলোয় তা পড়তেন। সিআইএ পরিচালিত বলিভিয়ার সেনাবাহিনী হঠাৎই পেয়ে গেল শত্রুপক্ষের এই মুকুটের মণিকে।

ডায়েরিতে লিখেছিলেন কমান্দান্তে চে, ‘আমি ভাবতে শুরু করি, মরে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ সেটাই, যখন মনে হবে সব শেষ হয়ে গেছে। জ্যাক লন্ডনের একটি পুরোনো গল্প মনে পড়ছে। তাতে গল্পের মূল চরিত্র একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে গরিমার সঙ্গে নিজের জীবনের সমাপ্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
শত্রুসৈন্যদের সঙ্গে সারাটা বিকেল যুদ্ধ করার পর গুলি লেগেছিল তাঁর পায়ে। আরেক গুলিতে ছিটকে যায় হাতের অস্ত্র। ঘাতকেরা যখন এগিয়ে আসছিল, তখন তিনি ‘নিজের জীবনের সমাপ্তির প্রস্তুতি’ নিচ্ছিলেন মহাকাব্যের বীরের মতো একা।

চিলির কবি পাবলো নেরুদা তাঁর আত্মস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘দুর্ভাগা বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার রাষ্ট্রীয় হত্যা ছিল এক মর্মান্তিক আঘাত। তাঁর মৃত্যু ঘোষণাকারী টেলিগ্রাম দুনিয়ার ওপর দিয়ে ভক্তিমাখা শীতল শিহরণের মতো বয়ে গেল। তাঁর বীরোচিত করুণ জীবনকে প্রণতি জানিয়ে লেখা হলো লাখ লাখ শোকগাথা।’ বাংলা ভাষার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও লিখলেন, ‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’ 

ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে চে, ছবি: আলবের্তো কোর্দা, ১৯৬১দুই.
আর্জেন্টিনার কর্দোবা পাহাড় থেকে রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে এলেন তরুণ ছাত্র আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ। খরচ চালাতে ছয় ঘণ্টা শ্রম আর পড়ালেখার জন্য ছয় ঘণ্টা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রটির আবার দারুণ আগ্রহ উচ্চতর গণিতের জটিল সব তত্ত্বে। শুনতেন মধ্যযুগীয় ক্লাসিক সুরকার ভিভালদির সংগীত, পড়তেন দার্শনিক হাইডেগারের দর্শন। লিখতেন কবিতা, চালাতেন উচ্চাভিলাষী প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান। ১৭ বছর বয়সে ‘দার্শনিক অভিধান’ সম্পাদনা করা শুরু করেন। ১৯৫০ সালে বয়স যখন ২২, বাইসাইকেলে ছোট মোটর লাগিয়ে ঘুরে এলেন দেশের ভেতরের ৪ হাজার কিলোমিটার পথ। পরের বছর আবার বেরুলেন মোটর বাইকে। ঘুরে এলেন সমগ্র মহাদেশ। তাঁকে নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলো পত্রিকায়। ওই দুঃখপীড়িত শোষিত মহাদেশের মুক্তির কান্না সে সময়ই তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। মানবতার করুণ কঠিন বাস্তবতাই তাঁকে করে তুলেছিল বিপ্লবী। এই যাত্রার অভিজ্ঞতা তিনি লিখে রাখতেন ডায়েরিতে। পরে সেটা মোটরসাইকেল ডায়েরি নামে জনপ্রিয় বই আকারে প্রকাশিত হয়। আরও পরে তা থেকে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র।

একবার মায়ের স্তন ক্যানসার ধরা পড়ল। ছাত্র ছেলেটি বাড়িতে গবেষণাগার বানিয়ে চিকিৎসার উপায় খুঁজতে গবেষণা চালাতে লাগল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কুষ্ঠরোগীদের সেবা করার সময় নিজের ভবিষ্যৎ পথটাও ঠিক করে ফেলেছিলেন। এমন ভালোবাসা, নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার এমন উদগ্র বাসনা দিনে দিনে মানবতার মুক্তির সাধনায় তাঁকে আরও সক্ষম ও শক্তিশালী করে তুলেছিল। অথচ ছোটবেলা থেকেই অ্যাজমায় ভুগতেন। শরীর উপযুক্ত নয় বলে সামরিক বাহিনীতে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। অথচ সেই রোমান্টিক তরুণকেই আমরা পরে দেখতে পাই, অসাধারণ সামরিক প্রশিক্ষক, গেরিলা যুদ্ধের রূপকার এবং কিউবা বিপ্লবের দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে।

সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়ার আগে চে জড়িয়ে পড়েছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ গুয়াতেমালার সামাজিক বিপ্লবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাধায় সে দেশের ভূমি সংস্কার ব্যর্থ হওয়া তাঁকে বদলে দেয়। বিপ্লবের পথে বাড়ি ছাড়ার সময় মাকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যারা নিজেদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে, সশস্ত্র সংগ্রামই তাদের জন্য একমাত্র সমাধান এবং আমার এই বিশ্বাসে আমি অটল। আমাকে অনেকে অ্যাডভেঞ্চারার বলবে, হ্যাঁ আমি তা-ই; তবে ভিন্ন ধরনের। আমি সেই লোক, যে তার বিশ্বাসের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি।...কখনো-সখনো বিশ শতকের এই ভাগ্যসন্ধানী ছোট্ট সৈনিকের কথা ভেবো মা।’

সেই ছোট্ট সৈনিক, যিনি আহত শত্রুসেনার সেবা করতেন, প্রেমিকাকে ছেড়ে যিনি চলে যেতেন নতুন রণাঙ্গনে, যিনি নির্দয়ভাবে অন্যায়কারীকে হত্যার আদেশ দিতেন, যিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীতে দেশের পর দেশে ভিয়েতনামের মতো লড়াই চলুক, সেই চের সত্যিকার চেহারা ঢেকে দেওয়া হচ্ছে তাঁরই বাহারি পোস্টারে। যে পুঁজিবাদকে তিনি ঘৃণা করতেন, সেই পুঁজি ও তার বাজারে চে বিক্রি হন টি-শার্টে, কফিমগে, পোস্টারে, চাবির রিংয়ে এবং কোথায় নয়?

চে যে দুনিয়ার জন্য লড়াই করেছিলেন, সেই দুনিয়া আসেনি। মুক্ত মানুষের সেই মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন ও লড়াই আরও পিছিয়ে গিয়েছে। তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী জীবনও অর্ধেক শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। পাশাপাশি মিথের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছেন সত্যিকার অপরাজিত চে। নতুন মানুষের বদলে পৃথিবী ভরে গেছে একদিকে আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদীতে, আরেক দিকে দুস্থ ও দরিদ্র মানুষে। সংগ্রামের বদলে আজকের তারুণ্যের বড় অংশটাই রাংতার মতো চকচকে জীবনের জন্য সব বাজি রাখতে রাজি। মুক্তির সংজ্ঞা বদলে গেছে ব্যক্তিগত সুখ ক্রয়ের পণ্যবাদে।


তিন.

তারপরও কেন চের স্মৃতি? কেন চের জনপ্রিয়তা? সম্ভবত আমাদের সময় যত অস্থির, আপসকামী ও পলায়নপর হচ্ছে, ততই অন্তরের গভীর অপরাধবোধের মতো করে চের কথা মনে পড়ছে।

ভীরু মানুষ যেমন বীরপূজা করে, তেমনি করে চে এখনো এই নৈতিকতা হারানো দুনিয়ার নৈতিক ভরকেন্দ্র হয়ে আছেন। যে পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষের ৪০০ কোটিই দরিদ্র, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে প্রতি মিনিটে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, যেখানে নতুন করে বিভিন্ন জাতির ঘাড়ে চাপছে শোষণের কঠিন জোয়াল, সেখানে চের মৃত্যু আপসকামীকে অপরাধী করে দেয়, আর মুক্তিকামীকে পথ দেখায়।

মুক্তিযুদ্ধের শহীদ তরুণের বয়স কখনো বাড়ে না। চেও চিরকাল আগামীর তরুণের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। আহত ও বন্দী মানুষটির বুকে গুলি চালিয়ে তারা থামিয়ে দিতে চেয়েছিল ইতিহাসের একটি শক্তিকেন্দ্র। কিন্তু সেই শক্তিকেন্দ্র অফুরান হয়ে উঠল।

চে আপসকামী মানুষদের আরও বহুকাল অপরাধী করে রাখবেন। 

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক