সোমবার, ১৯ জুন, ২০১৭

হৃদয়ের যুক্তির দার্শনিক: ব্লেইজ প্যাসকাল

ব্লেইজ প্যাসকালের বয়স তখন মাত্র উনিশ। ট্যাক্স কমিশনার বাবাকে দেখতেন, খাতাপত্রে লম্বা লম্বা জটিল হিসাব করছেন। তা দেখে প্রায় ৪০০ বছর আগে এই তরুণ তৈরি করে বসলেন পৃথিবীর প্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর। রাজার কাছ থেকে এর উৎপাদনের মালিকানা অধিকারও আদায় করেন। ওই সময়ের হিসাববিদেরা
দেখলেন, এই জিনিস বাজারে এলে তাঁদের চাকরি শেষ। তাঁরা বাদ সাধলেন। ইতিহাসের প্রথম ইনফরমেশন হাইটেক ব্যবসা মার খেয়ে গেল। এতে তিনি দুঃখ পেলেন, কিন্তু বাকি দুনিয়ার লাভ হলো। বাকি জীবনে যেসব কাজ তিনি করে গেলেন তাতে গণিত, অর্থনীতি, দর্শন, পদার্থবিদ্যা এগিয়ে গেল বহুদূর। তাঁর অবদানের কথা মনে রেখেই প্যাসকাল নামের কম্পিউটার ল্যাংগুয়েজের নাম রাখা হয়েছে কত দিনই বা আগে? ১৬৬২ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু না হলে আর কী হতো কে জানে!
ছোটবেলাতেই ছেলের প্রতিভা দেখে বাবা এতিয়েন প্যাসকাল ভেবেছিলেন, একে কম বয়সে গণিত শেখানো ঠিক হবে না। কিন্তু কোনো তালিম না পেয়েও ১২ বছর বয়সে তিনি ইউক্লিডের প্রথম ৩২ প্রতিপাদ্য বের করে ফেলেন। বাবা বুঝলেন, এই ছেলেকে আটকে রাখা যাবে না। গণিতের গৃহশিক্ষক রাখা হলো। ফল হলো এই, ১৫ বছর বয়সে প্যাসকাল কোনিক সেকশনের মতো জটিল গণিতের অসাধারণ কতগুলো মৌলিক প্রমাণ আবিষ্কার করে প্রবন্ধ লিখে হইচই বাধিয়ে দিলেন। সেই প্রমাণ আজ প্যাসকাল থিওরেম বলে পরিচিত। এই তত্ত্ব এতই ক্রান্তিকারী ছিল যে কেউ বিশ্বাস করতে পারল না এটা এক কিশোরের আবিষ্কার। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক রেনে দেকার্ত সরাসরি অভিযোগ এনে বললেন, এটা আসলে প্যাসকালের বাবার কাজ, ছেলেকে বিখ্যাত করার ধান্দায় কিশোর প্যাসকালের নামে ছাপানো হয়েছে। ঘটনাটা নিয়ে সেই সময়ের ফরাসি দেশে দুই যুগ ধরে কোলাহল আর তর্ক-বিতর্ক চলল।
ফরাসি দার্শনিক, গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকালের জন্ম ১৯ জুন ১৬২৩ সালে। কোনো স্কুল বা কলেজে তিনি লেখাপড়া করেননি, বাবার মাধ্যমে লেখাপড়ার প্রাথমিক হাতেখড়ির পর স্বশিক্ষিত হন।


একটি ওয়েবসাইট তাঁদের ক্যাসিনোতে খেলতে উৎসাহ বাড়ানোর জন্য লিখেছে, ‘আসুন, একটি দান খেলে প্যাসকালকে শ্রদ্ধা জানাই।’ কথাটায় ধন্দ লাগা স্বাভাবিক। তবে কথাটা একেবারে ফেলনা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গণিতের সম্ভাবনা তত্ত্ব আবিষ্কারের ইতিহাস। এই তত্ত্ব প্যাসকাল যৌথভাবে তাঁর সময়ের আরেক মেধা পিয়েরে দ্য ফার্মার সঙ্গে রচনা করেন। আর এই দুই প্রতিভাকে এক জায়গায় আনার কৃতিত্ব এক দেউলিয়া জুয়াড়ির। আঁতোয়ান গামবো ছিলেন ফরাসি অভিজাত বর্গের লোক। নিজের সর্বনাশ ঘটানোর জন্য চিন্তাভাবনা করে তিনি জুয়া খেলা বেছে নিলেন। এবং প্রত্যাশিতভাবে সফলও হলেন। কিন্তু জুয়ার দানের হিসাব কষতে গিয়ে একটা ভীষণ জটে পড়ে গেলেন তিনি। হাল ছেড়ে না দিয়ে হিসাব মেলানোর জন্য দ্বারস্থ হলেন প্যাসকালের। যে প্যাসকাল অবসর সময়ে দর্শন চর্চা করেন, বাতাসের চাপ মাপার ব্যারোমিটার তৈরি করেন, সেই তিনি জুয়াড়ির সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে গেলেন। পরামর্শ নিতে হাজির হলেন ফার্মার কাছে। এই দুই প্রতিভা জুয়া খেলায় জেতার নিশ্চিত পথ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন সম্ভাবনা তত্ত্ব। যে তত্ত্ব ছাড়া আজকের শেয়ারবাজার থেকে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ পর্যন্ত অচল।

এরপর প্যাসকালের মাথায় অন্য এক চিন্তা। তিনি এমন যন্ত্র বানাতে চান, যা একবার চালু করলে কোনো শক্তি বা জ্বালানি খরচ না করেও চিরকাল চলতে থাকবে। আর তা করতে গিয়ে এমন এক কল বানালেন, যা আজ ক্যাসিনোতে রুলেট নামের জনপ্রিয় খেলা।

পানির চাপ মাপতে একটি পরীক্ষা চালানোর কায়দা উদ্ভাবন করেন প্যাসকালসিরিঞ্জ ও হাইড্রোলিক প্রেস এবং তরলে প্রযুক্ত বল যে সবদিকে সমান ক্রিয়াশীল, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে এই তত্ত্ব আবিষ্কার করে তিনি চিরতরে বিজ্ঞান পরিত্যাগ করেন। গণনাযন্ত্র তৈরির পরিশ্রমের পর তাঁর দুর্বল স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তা আর ঠিক হয়নি। ১৬৪৮ সালের পরে জানসেনপন্থায় দীক্ষিত হন। ১৬৫৪ সালে বাইরের পৃথিবী ছেড়ে তিনি আশ্রমে চলে যান।
প্যাসকালের এই আশ্রমবাসের পেছনে ছিল সে সময়ের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাজনীতি। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে অস্থিরতা, হানাহানি আর দারিদ্র্য ছিল সবর্ব্যাপী। জার্মানিতে রক্তের স্রোত বইয়ে দেওয়া ধার্মিকদের যুদ্ধ, ইংল্যান্ডে পার্লামেন্টের সঙ্গে রাজার বাহিনীর লড়াই, সর্বোপরি প্রোটেস্ট্যান্ট আর ক্যাথলিকবাদের ছদ্মবেশে অবক্ষয়ী সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে উদীয়মান পুঁজির লড়াই। ১৬২৪ থেকে ১৬৪৮ পর্যন্ত ৩০ বছরব্যাপী এই লড়াইয়ে শেষ পর্যায়ে ফ্রান্স যোগ দেয়।
প্যাসকাল দেখতে পেলেন, ইউরোপের পথে পথে বাস্তুহারা ক্ষুধার্ত লোকের ভিড়। শান্তি আর সুস্থিতিকেই মনে হলো পরম কাম্য। দৈব হস্তক্ষেপ ছাড়া যে মানুষ ভালো হতে পারবে, সে বিশ্বাস তাঁর হারিয়ে গেল। তিনি একটা প্রয়োজনীয় মিথ্যে খুঁজে বের করলেন, ‘যখন কোনো কিছু সম্পর্কে সত্যটা অজানা, তখন একটা সাধারণ মিথ্যা দিয়ে মানুষের মনটাকে স্থির রাখাই ভালো।’ এই জগতের হানাহানিকে অস্বীকার করে এমন কিছুতে তিনি মুক্তি খুঁজলেন, যেখানে কোনো কিছুই তাঁকে স্পর্শ করবে না।
প্যাসকালের বানানো বিশ্বের প্রথম যান্ত্রিক গণনাযন্ত্রপ্যাসকাল বাঁচতে চেয়েছিলেন পশু আর দেবদূতের মধ্যবর্তী স্তরে। মানুষ দেবদূত নয়, পশুও নয়। দুর্ভাগ্য হলো, যে দেবদূতের মতো আচরণ করতে চায়, সে-ই পশু হয়ে যায়। মধ্যপথে মানুষ যে দেবদূত হতে চাইছে, এ কারণে তিনি তাদের ভৎর্সনা করতেন। আবার তারা শুধু মানুষ হয়ে আছে বলেও তাদের গালমন্দ করতেন। তিনি খাবার দরকার অনুযায়ী হিসাব করে খেতেন। এমনকি তাতে খিদে না মিটলেও খাবার ছেড়ে উঠে পড়তেন। পাছে কোনো জাগতিক আনন্দ তাঁকে স্পর্শ করে ফেলে, এই ভয়ে তিনি কাতর হয়ে থাকতেন। প্যাসকাল বিয়ে করেননি, কারণ এতে স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টির প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। প্যাসকাল তাঁর অসুস্থতাকে মেনে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। সার্বক্ষণিক মাথাধরা, গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা ও অনিদ্রার জন্যও তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতেন। অত্যধিক পরিশ্রম আর দুর্বলতায় তাঁর অকালবার্ধক্য দেখা দেয়। গুটিবসন্ত আক্রান্ত দরিদ্র এক পরিবারকে নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বোনের বাড়িতে চলে যান শুশ্রূষা নিতে। সেখানে ১৬৬২ সালের ১৯ আগস্ট মাংসপেশির খিঁচুনিতে মারা যান।
সবকিছুর পরও প্যাসকালের কাছে মানুষই ছিল মূল্যবান, সে ক্ষুদ্র ও ক্ষণজীবী হওয়া সত্ত্বেও। মানুষ মহাবিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল এক নলখাগড়া। কিন্তু এই নলখাগড়া চিন্তা করতে পারে। তাকে নিশ্চিহ্ন করতে মহাবিশ্বের সামান্য শক্তি, আদ্র৴তা বা পানিই যথেষ্ট। কিন্তু সে ধ্বংস হয়ে গেলেও ধ্বংসকারী মহাবিশ্বের চেয়ে সে মহৎ। কারণ সে তার বিনাশের কথা জানে। কিন্তু বিশাল মহাবিশ্ব তার শক্তির ব্যাপারে কিছুই জানে না।
কেবল কেনাবেচার মাপে সবকিছু বিচার করার আজকের যে পৃথিবী, তা সাবালক হচ্ছিল প্যাসকালের কালে। যেসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তিনি করছিলেন, সেগুলো পণ্য তৈরি আর বিক্রির জগৎকে ডেকে এনেছিল। এখানে কেবল বুদ্ধির খেলা, তাতে হৃদয়ের যোগ নেই। সবচেয়ে বড় অন্যায়কেও যে শুধু বুদ্ধি দিয়ে যৌক্তিক প্রমাণ করা যায়, প্যাসকাল তা জানতেন। এই ছাঁচ তিনি পছন্দ করেননি। প্যাসকাল বললেন, ‘দর্শনকে যদি ব্যঙ্গ করো, তাহলেই তুমি একজন সত্যিকারের দার্শনিক।’ সবকিছুকে একটিমাত্র ছাঁচে ফেলা, তার বাইরে সব ভুল—এই ভাবনা প্যাসকালের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন ছিল।
প্যাসকাল খাঁচার মধ্যে মানুষের ভবিষ্যৎ হাঁসফাঁস অবস্থা দেখতে পেয়েছিলেন। রুগ্ণ শরীরের প্যাসকাল বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষ প্রতিনিয়তই একটা ছাঁচ করে। আবার তার বাইরে গিয়েই তার নিজের সৃষ্টিকে অস্বীকার করে। একটা ব্যবস্থাকে সে চিরকালীন বলে মেনে নেয় না। একই খাঁচায় সে চিরকাল বাস করে না। পূর্ণতার খোঁজে সে অপূর্ণকে সে অস্বীকার করে। তাই তিনি বললেন হৃদয়ের যুক্তির কথা। যান্ত্রিকতার বিপরীতে তা নিঃসন্দেহে ছিল এক বড় বিদ্রোহ। তিনি বললেন, হৃদয়ের একটি নিজস্ব যৃক্তি আছে, নিছক যুক্তি কখনো তাকে বুঝে উঠতে পারে না। প্যাসকাল ছাঁচের মধ্যে বাঁচতে চাননি। মানুষের কল্পনা আর সৃজনশীলতা যখন শুধু লাভক্ষতির জেলখানায় আটকা পড়ে যাচ্ছিল, তখন প্যাসকাল এর থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন—নিজের, মানুষের কল্পনাশক্তির, মানুষের সম্ভাবনার।

জাভেদ হুসেন: লেখক ও অনুবাদক