৩৫ বছর পূর্বে স্বঘোষিত ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী (পূর্বতন ক্যাসিয়াস ক্লে) দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের পর জন্ম নেওয়া এই দেশটির বয়স তখন মাত্র সাত বছর। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিওন স্পিংক্সের কাছে হেভিওয়েট খেতাব
হারাবার পর আলী তাঁর স্ত্রী ভেরোনিকাকে সঙ্গে নিয়ে এক সপ্তাহের সফরে বাংলাদেশে আসেন।
হারাবার পর আলী তাঁর স্ত্রী ভেরোনিকাকে সঙ্গে নিয়ে এক সপ্তাহের সফরে বাংলাদেশে আসেন।
তাঁর এই সফর নিয়ে, ‘মোহাম্মদ আলী গোজ টু ইস্ট : বাংলাদেশ আই লাভ ইউ’, নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করা হয়েছিল। তবে প্রথমে মোহাম্মদ আলী পৃথিবীর অপর প্রান্তে যাওয়ার এই প্রস্তাবে বেঁকে বসেছিলেন, কারণ সম্প্রতি বক্সিং-রিং-এ পরাজিত হওয়ার পর মানুষের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে তিনি ভীত ছিলেন। আলী তখন চোখে গাঢ় সানগ্লাস পরেছিলেন শুধু বাংলাদেশের প্রখর গরম থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য নয়; বরং স্পিংক্সের কাছ থেকে যে নৃশংস উপহার পেয়ে তাঁর চোখ ফুলে গিয়েছিল তা ঢাকার জন্যও এর প্রয়োজন ছিল। তবে আলীর উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
তাঁকে স্বাগত জানাতে প্রায় বিশ লক্ষ উন্মত্ত ভক্ত বাংলাদেশের রাজধানী, ঢাকার বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ সফরকালে আলী এই দেশটির মনোরম নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত কয়েকটি স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, জগদ্বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সংরক্ষিত ব্যাঘ্র এলাকা এবং ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট—সুন্দরবন, সিলেটের মনোরম চাবাগান; হ্রদের তীরে অবস্থিত অপরূপ সুন্দর রাঙ্গামাটি শহর; এবং উপকূলবর্তী কক্সবাজার জেলা। এমনকি তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং একটি পাসপোর্টও দেওয়া হয়, যা পেয়ে তিনি সরস মন্তব্য করেন : ‘যদি কোনোদিন আমাকে আমেরিকা থেকে বের করে দেওয়া হয়, তাহলে আমার আরেকটি দেশ তো আছেই।’
আলীর সফরকালে সম্ভবত উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ঢাকা স্টেডিয়ামে। সেখানে ১২ বছর বয়সী একটি বাঙালি ছেলের সঙ্গে তিনি ‘মুষ্টিযুদ্ধ প্রতিযোগিতার’ নাটকে অংশ নেন এবং হর্ষোত্ফুল্ল জনতার হাততালি আর উল্লাসধ্বনির মাঝে ছেলেটি তাঁকে ‘নকআউট’ করে। আলীকে কক্সবাজারে এক খণ্ড জমি উপহার দেওয়া হয় এবং তাঁর সম্মানে একটি স্টেডিয়ামেরও নামকরণ করা হয়। সেই প্রামাণ্যচিত্রে আলী আবার বাংলাদেশে ফিরে এসে সেখানে একটি বাড়ি নির্মাণের কথাও বলেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘যদি আপনি স্বর্গে যেতে চান, তবে চলে আসুন বাংলাদেশে’।
১৯৭০-এর শেষ দিকে আলীর বক্সিং ক্যারিয়ার প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছিল। তবে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী তাঁর একটি বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল, তিনি এই গ্রহের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সবার কাছে অত্যন্ত চেনা-পরিচিত একজন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। তখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি একজন বিতর্কিত এবং বিপরীতধর্মী মানুষ হিসেবে পরিচিত হলেও, মূলত ভিয়েতনাম যুদ্ধে তাঁর স্পষ্ট বিরোধিতার কারণে আলী অধিকাংশ বিদেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্রমাগত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। তবে তাঁর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে ইসলামি জগতে এবং কৃষ্ণাঙ্গদের আত্মসম্মান ও জাতীয়তাবোধ তুলে ধরার কারণে তিনি সাব-সাহারা আফ্রিকায় প্রশংসিত ছিলেন। তবে যাঁরা আলীকে পর্যবেক্ষণ করতেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আশ্বস্তবোধ করলেন, যখন এই মুষ্টিযোদ্ধা নেশন অব ইসলামের ভয়ংকর ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষা থেকে দূরত্ব বজায় রাখলেন। তাঁর বন্ধু ম্যালকম এক্স ১৯৬৫ সালে নিহত হওয়ার আগে তা-ই করতেন। এছাড়া পূর্ববর্তী দশকে একজন সমাজচ্যুত ব্যক্তির অবস্থান থেকে নাটকীয়ভাবে তাঁর অবস্থান ওলট-পালট হয়ে এমন দাঁড়িয়েছিল যে, এমনকি হোয়াইট হাউসের নতুন বাসিন্দা, প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও তাঁকে আলিঙ্গন করেন।
প্রকৃতপক্ষে এসময়ে আলী তখন একজন ‘পৃথিবীব্যাপী কূটনীতিজ্ঞ ব্যক্তিত্বে’ পরিণত হয়েছেন আর সারা পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছেন। তাছাড়া অনুন্নত দেশগুলোতে তিনি অবিস্মরণীয় কয়েকটি মুষ্টিযুদ্ধের প্রতিযোগিতা যেমন—১৯৭৪ সালে জায়ার—বর্তমান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে, ‘রাম্বল ইন দি জাংগল’ এবং ১৯৭৫ সালে ফিলিপাইনে ‘থ্রিলা ইন ম্যানিলা’য় অংশ নেন। যার ফলে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র, মুসলিমপ্রধান দেশে তাঁকে একজন বীরের মতো অভ্যর্থনা জানানো হয়।
তবে বিদেশে প্রমোদবিহারকালে তিনি উগান্ডার ইদি আমিন এবং ইরাকের লৌহমানব সাদ্দাম হোসেনসহ বেশ কয়েকজন সংশয়পূর্ণ চরিত্রের সঙ্গে মেলামেশা করেন। এঁরা দুজনেই অবশ্য অকুণ্ঠভাবে আলীর প্রশংসা করেছিলেন। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ।
তিনি যদি বেঁচে থাকতেন এবং যদি কোনো দিন বাংলাদেশে ফিরে আসতেন তাহলে কক্সবাজারে তাঁর নামে যে জমিটি রয়েছে সেখানে আমরা কী দেখতে পেতাম। দেখতে কি পেতাম সাগরমুখী কোনো অবকাশযাপন কেন্দ্র করে তিনি সমুদ্র উপভোগ করছেন!
অনুবাদ : কাজী আখতারউদ্দিন
পলাশ ঘোষ, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস অবম্বনে (সংক্ষেপিত)
Find Nobin Kontho on Facebook