সোমবার, ২৬ জুন, ২০১৭

ঈদ আমাদের নতুন দিনের সন্ধান দেয়

ঈদের মানে বুঝি কি? না। তা–ই নিয়ে এ নিবন্ধ। আল্লাহ যখন দুটি ঈদ দিলেন মুসলমানদের জন্য, তঁাদের অনেকেই ভাবলেন ৩০ দিন না খেয়ে ও সারা রাত ইবাদত করে একটি দিন আসবে যখন সকালে উঠে যেতে হবে ঈদের মাঠে। তারপর? ঈদ শেষ হলো। এতে খুশি কোথায়, আনন্দ কোথায়? এ তো শুধু আত্মনিবেদন, নিজের নিগ্রহ, শুধু দেওয়া, এখানে তো নেওয়ার কিছু নেই। এটাই বোঝার ভুল। দেওয়ার মধ্যেই আনন্দ, দেওয়ার মধ্যেই সুখ, দেওয়ার
মধ্যেই ঈদের প্রকৃত সম্মান, সেটি আমরা বুঝতে পারিনি। ঈদের মাঠে অসংখ্য ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে থাকে সামান্য একটু খাবারের প্রত্যাশায়। আমরা নতুন কাপড়চোপড় পরে, আতর লাগিয়ে, চোখে সুরমা দিয়ে আলিঙ্গন করি দুটি ঈদকে। এখানে কতটুকু স্বার্থত্যাগ, কতটুকু জীবনের সাধের জলাঞ্জলি, তা কি ভেবে দেখেছি? এখানেই ঈদের আনন্দ লুকিয়ে আছে।

পৃথিবীর বাইরে যা কিছু, সবই লুকোনো। আল্লাহ যা দেবেন আমাদের স্বার্থত্যাগের বিনিময়ে তার শত ভাগের এক ভাগও কোথাও লেখা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে তোমাকে এমন কিছু দেব যা তোমাদের কল্পনার অতীত। বিধর্মী লেখকেরা এটাকে হাস্যকর করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় নিয়োজিত প্রথম দিন থেকেই। কখনো হুর পরি, কখনো গেলমানদের অন্যায় দৃষ্টিকটু উপমা স্থাপন করে। তা তো নয়। আল্লাহ চেয়েছেন পরিপূর্ণ সুষমায় পরিপূর্ণ আনন্দে আমাদের ভাসিয়ে দিতে। সেখানে কোথাও জাগতিক দৈহিক সুখের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে, এমন সুখ যা পৃথিবীতে কেউ কল্পনাও করেনি। নর-নারীর জৈবিক সুখ এর কাছে কিছুই নয়। বংশবৃদ্ধির প্রয়োজনে যে মিলনটুকুর সঙ্গে আমাদের পরিচয়, তা এর কাছে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত।

পরজীবনের চর্চায় যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের কিছু বই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। একখানে পেলাম এক ভদ্রলোক খুব ফল খেতে ভালোবাসতেন। তাঁকে বেহেশতে এমন একটি ফল দেওয়া হলো, যার স্বাদ সব ফলের নির্যাস। বিদেশিরা কোরআনের এই জায়গাটি পাঠ করেছে। পানীয়টির নাম দিয়েছে: ‘স্মুদি’। আমেরিকায় অনেক ফলের দোকানে এটি পাওয়া যায়। দাম অনেক বেশি। আমাদের আলোচ্য ফলটি এত বড় যে এর সামান্যতম অংশ কেউ খেয়ে শেষ করতে পারবে না। বেহেশতের সেই ফলটি কত আকর্ষণীয় হতে পারে, তার কল্পনা আমাদের মাথায় ধরবে না। আমি প্রায়ই পিপীলিকার কথা বলে থাকি। পিপীলিকা আমার পড়ার ঘরটির কল্পনায় মাথায় স্থান দিতে পারে না, তারপর গুলশান, তারপর ঢাকা, তারপর বাংলাদেশ, তারপর সমস্ত পৃথিবী, তারপর সৌরজগৎ, তারপর মহাজগৎ। আমাদেরও তা-ই। আমাদের কল্পনায় বেহেশতের তেমনি অবস্থান।

যাঁদের সঙ্গে বাস প্রায়ই ঠাট্টা করেন আমার সঙ্গে। বলেন, পৃথিবীর সুখ উৎকৃষ্ট মদ্যে। এখানেই তাঁরা যতটুকু পেয়েছেন তার সুখ্যাতি তাঁরা করবেনই। প্রভুর কাছে আছে শারাব [পানীয়], যার তুলনা হতে পারে না। নাম দিয়েছেন: ‘সারাবান তাহুরা’। এমনি কোরআনে আছে নদীর তুলনা, ঝরনার ঝিরিঝিরি বয়ে যাওয়ার কথা। সবকিছুই ঊহ্য। যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

আমাদের সামনে প্রবাহিত গঙ্গা-সিন্ধু-নর্মদা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র। আরও হাজার নদী। নদীর পারে গেলেই আল্লাহ প্রবহমান রহমতের কথা খানিকটা অনুভব করতে পারি। বেহেশতের নদী কেমন হবে, তা ভেবে আকুল হই। প্রায়ই বলে থাকি: ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবি যমুনা’। আরও বলি: ‘বিগলিত করুণা রহমান রহিম’। বইগুলো পড়ে দেখবেন।

আরব দেশে নদী নেই। তাই ওরা নদী দেখলে উতলা। ঠিক তেমনি যেখানে পাহাড় নেই, সেখানে আমরা উতলা হয়ে গেয়ে উঠি: ‘কোথায় এমন ধূসর পাহাড়, আকাশ তলে মেশে’। যেখানে ধান হয় না, সেখানে গেয়ে উঠি: ‘এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে’। পৃথিবীর সৌন্দর্যই যদি মানুষকে এতটা উতলা করতে পারে, তাহলে কল্পনার অপর পারে যে বেহেশতের অবস্থান, তার কথা ভাবব না কেন?

যাকে ভালোবাসি, তাকে যদি না পেয়ে থাকি, তাহলে তাকে সেখানে পাব না কেন? যেমনটি নজরুল বলেছেন: ‘সেথা নিত্য মিলনে ভুলিব আমরা এই বিরহের ক্ষতি?’ পৃথিবীতে যা আমরা পাইনি, কোনো দিন পাব না, সেখানে পরম করুণাময় আমাদের জন্য তা প্রস্তুত রেখেছেন। এটাই সাফল্য। পৃথিবীতে কে রাজা-মহারাজা হলো, সেটা সাফল্য নয়। ঈদ আমাদের সেই সাফল্যের ইঙ্গিত দেয়।

তাহলে পৃথিবীতে কেন এত অসহ্য কষ্টের মধ্যে জীবন কাটান? কেন খাওয়া নেই, ভালো পরিধানের জন্য ভালো বস্ত্র নেই? নেই মাথার ওপরে চাল? যেখানেই যাই সেখানেই হাহাকার। কেন মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ, কেন কিছু মানুষের এগুলো কুক্ষিগত করে রাখার অভিলাষ? কেন ৯০ভাগ লোক বঞ্চিত হবে? এ কেমন পৃথিবী? এ কেমন বিচার তোমার? তাহলে তুমি কেন পাঠালে এ অবিচারের পৃথিবীতে? শুধু বেহেশতের লোভ দেখিয়ে আমাদের জীবনকে কেন করছ প্রতিদিন লাঞ্ছিত? এরই উত্তর: দুই ঈদ। পরের ঈদে আত্মদান ওই কোরবানি আসলে নিজের কোরবানি। এটা কেউ বোঝে না। নিজকে কোরবানি করো আল্লাহর ওয়াস্তে। ওই পশু হলো তোমার মনের পশু। আমরা মানুষ ও পশু একসঙ্গেই। আসুন, মানবতাকে উজ্জীবিত করি। রোজার ঈদে প্রতি রোজা আনবে তোমার জন্য নতুন সম্মান। যে সম্মান রাজার চেয়ে বেশি। তোমার ভুখা মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। তোমার প্রতিটি ইবাদত, তোমার প্রতিটি সেজদা আল্লাহর কাছে এত পছন্দ, যে তোমার জীবনের প্রতিটি গুনাহ এমনভাবে মুছে দেওয়া হবে যেন তুমি কোনো গুনাহ করোনি। এটাই ঈদের প্রতিশ্রুতি। যাঁরা রোজা রাখবেন

তাঁদের জীবন হবে মাধুর্যমণ্ডিত, এ জীবনেও, পর জীবনেও। যদি কোনো কষ্ট আসে তাহলে সেখানে হবে ধৈর্যের পরীক্ষা। যে ধৈর্যের পরীক্ষায় প্রথম হবে, সে-ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। যারা আল্লাহর কথার অবাধ্য, তাদের সঙ্গে আল্লাহ দেখা করবেন না। তারা পতিত হবে এমন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যেখানে কোনো আলো প্রবেশ করতে পারবে না। আমরা ‘ব্ল্যাকহোল’-এর কথা শুনেছি। সেই অসম্ভব দুঃখ-কষ্টের দোজখ কি কারও কাম্য হতে পারে? তাহলে এই কদিন আল্লাহর সঙ্গে যারা যুদ্ধ করে চলেছে, তারা আছে বোকার স্বর্গে। ঈদের সত্যিকার মূল্য নতুন কাপড় পরা নয়, নতুন টুপি পরা নয়, নতুন তসবি হাতে নেওয়া নয়, নতুন করে আল্লাহকে পাওয়া, নতুন করে তাঁর প্রতি সেজদা দেওয়া, প্রতিটি বঞ্চিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। মানুষকে ভালোবাসুন, সবকিছু মানুষের জন্য বিলিয়ে দিন। যেমনটি করেছেন আমাদের নবী (সা.)। এটিই আদর্শ, এটিই পথ। আর কোনো পথ নেই, সব পথ অন্ধকারের পথ। যেদিন ক্ষমা পাবেন, সেই দিনটিই মূল্যবান। বেহেশতের অলিন্দ থেকে ভেসে আসবে অপার্থিব সুগন্ধ। নানা বই পড়ে জানতে পেরেছি অপার্থিব সুগন্ধির কথা। খানিকটা শেয়ার করি। হয়তো ভালো লাগবে। যখন কোনো সুকাজে জড়িয়ে পড়ি আল্লাহ কোনখান থেকে সুগন্ধ পাঠিয়ে দেন। আর কেউ পায়নি, শুধু আমি। কয়েকজন বুজুর্গ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁরা এর উত্তর দেননি। শুধু বলেছেন তুমি যা দেখেছ, যা পেয়েছ, তাকে সত্য বলে জেনো। যে নামেই ডাকি-তে খানিকটা আভাস দিয়েছি। যাঁরা পড়তে চান তাঁদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি সেই অপরূপ দেশের কথা, যার স্বপ্ন আমাদের সবার চোখে। স্বপ্ন হলেই হবে না। হতে হবে তা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে সকাল। মুসলমানদের পুরো জীবনই বেহেশতের প্রস্তুতি। জীবনকে তারা মূল্য দেয় সামান্যই। সারা দিন না খেলে আমাদের যে কষ্ট হয়, তা কি আল্লাহ বোঝেন না? একটু পানির জন্য তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়, তা কি তার অজানা? রাতের খাওয়া ও ভোর রাতের খাওয়া ক্ষুধার কষ্ট হয়তো মিটিয়ে দেয়। কিন্তু সারা দিন ক্লান্তি আমাদের ছাড়ে না। এই জন্য যে আমাদের ঈদ হলো বিলিয়ে দেওয়ার ঈদ।

দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর আগের কথা। মসজিদে যাচ্ছি আর আসছি। একজন বৃদ্ধকে দেখি ভোরবেলা থেকে মসজিদে। তাকে একলা পেয়ে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এত ভোরে রোজ সকালে আসেন, এখানে কি কারও সঙ্গে দেখা হয়? আল্লাহকে কি চিনতে পেরেছেন? তিনি আপনাকে কিছু দিয়েছেন? চোখের পানিতে কি কখনো সয়লাব হয়েছেন? তাঁর উত্তর শুনে আমি হাঁ হয়ে গেলাম। বললেন, ‘আমি মুরুক্ষু, আল্লাহরে চিনি না, তাঁকে দেখিনি, তাঁকে অনুভব করিনি। আল্লায় কইসে নমাজ ফইরতে, তাই নমাজে আসি।’

বুঝে পড়া আর না বুঝে পড়ার তফাত অনেকখানি। আল্লাহ এখানেই বর্তমান প্রতি মুহূর্তে। এই যে আমি লিখছি, আল্লাহর নির্দেশে। অন্য লেখকেরা শুনে হাঁ। ওরা বলছে, আব্বাসী সাহেব, বলেন কী? উনার বক্তব্য তো পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। হ্যাঁ ভাই, এইটি বলার জন্যই আমার এ নিবন্ধ। আল্লাহ আপনার পাশেই আছেন। তিনি সারা জীবন সর্বক্ষণ আপনাকে গাইড করার জন্য প্রস্তুত। শুধু দুটি ঈদের দিনের জন্য নয়, বছরের ৩৬৫ দিন আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। আপনি চোখের পানিতে তাঁকে খুঁজে পাবেন। তিনি আপনার চোখের পানি মুছে দেবেন। তিনি আপনার সমস্ত সমস্যার সমাধান করবেন। ধৈর্য ধরুন। তাঁকে ডাকুন। তিনি সহজেই ধরা দেবেন। দুটি ঈদ আমাদের নতুন দিনের সন্ধান দেয়।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব





Find Nobin Kontho on Facebook