মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৭

স্মৃতির শহর | শান্তনু মজুমদার

ঢাকার লক্ষণীয় পরিবর্তনগুলোর অন্যতম হচ্ছে মধ্যবিত্ত শব্দটার মানে আমূল পাল্টে যাওয়া, ছোটকালেও কয়েকবার ঢাকায় এসেছি। আমাদের এলাকায় একটা নাটকের দল ছিল ফ্রেন্ডস ক্লাব। আমার বাবা ছিলেন ক্লাবের প্রধান ব্যক্তি। ফ্রেন্ডস ক্লাব শিল্পকলা একাডেমিতে শো করতে এসেছিল কয়েকবার। যত দূর মনে করতে
পারি, দলের সঙ্গে আমিও ঢাকা এসেছিলাম একবার। মধ্য-আশির দশকে জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেওয়ার জন্য পর পর তিন বছর ঢাকায় এসেছিলাম। স্টেজ পারফরম্যান্সে ভীষণ ভয় পেতাম, তাই রচনা লিখন বলে একটি প্রতিযোগিতা ছিল সেটা বেছে নিয়েছিলাম। ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতাটি হতো শিশু একাডেমিতে। অপূর্ব সে স্মৃতি। শিশু একাডেমির বাইরে বেরোলেই দোয়েল চত্বর। দেখতেই থাকতাম। এটা যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তা বোধ হয় শোনেছি। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম বলে মনে হয় না। একদিন একটা কাণ্ড হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে শিশু একাডেমি থেকে গুলিস্তান চলে গিয়েছিলাম। এরপর ফিরে আসার রাস্তা তো খুঁজে আর পাইনি। পরে কিভাবে যেন চলে এসেছিলাম।
মধ্য-আশিতে মনে আছে নটর ডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঢাকায় আসি। আমার স্কুলের বাংলার শিক্ষক রেজা স্যার আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। আমরা উঠেছিলাম মুহসীন হলের নিচতলার মাঠের দিকে একটা রুমে। স্যারের কোনো আত্মীয় বোধ হয় পড়তেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। রোজার শেষের দিক। পুরো হল বলতে গেলে ফাঁকা। স্যার আমাকে রেখে গেছেন কিছু কেনাকাটা করতে। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল গোলাগুলি। সেই আমার প্রথম গুলির শব্দ শোনা। সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম। অসহায় বোধ করেছিলাম। আমি নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম কিন্তু সেভাবে থাকার জায়গায় সুবিধা না থাকায় শেষমেশ এলাকায় চলে যাই।
ঢাকার সঙ্গে আমার বলতে গেলে স্থায়ী সম্পর্ক ১৯৮৮ সালের পর থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কোচিং করার জন্য আমি ঢাকায় চলে আসি। থাকতাম আমার এক চাকরিজীবী কাজিনের সঙ্গে ধানমণ্ডির ১৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু ভেতরের দিকে আধাপাকা বাড়ির একটা রুমে। কোচিং থেকে তেমন কোনো বিদ্যা লাভ হয়নি। কিন্তু সেই আমার ঢাকা যাপন শুরু। বাড়ির মালিকের দ্বিতীয় পক্ষের ছোট ছেলে এলাকার উঠতি মাস্তান। সে জেল খাটে, ক্ষুর দিয়ে পোঁচ লাগায়। তার সঙ্গে আমার এক ধরনের দোস্তালি হয়ে যায়। সে কোনো দিন স্কুলে যায়নি; কিন্তু তার গার্লফ্রেন্ড ইডেন কলেজের। সে আমাকে কোনো দিন সাগরেদ বানাতে চায়নি। আমি তার কাজকর্মে ‘ইমপ্রেসড’ হচ্ছি এটা দেখেই তার ভালো লাগত। সে সময় মাঝেমধ্যেই বড় রাস্তার উল্টাপাড়ে ধানমণ্ডি চলে যেতাম হাঁটতে। ধানমণ্ডি তখন বেশ সুনসান; বড়লোকদের থাকার উপযোগী নিরিবিলি একটা জায়গা। আমার মতো বহিরাগতরা লেক দেখতে, হাওয়া খেতে কিংবা হাঁটতে যেত। এখন ধানমণ্ডির বাড়িওয়ালারা ধনী থেকে অতি ধনী হওয়ার জন্য বাড়িগুলোকে বহুতল বানাচ্ছে। বাংলাদেশি পুঁজির গতিধর্মের জায়গা থেকে এটা আমাকে এতটুকু চমকায় না, বিরক্ত করে না। আবাহনী মাঠেও যেতাম। তখন ঢাকার ফুটবলের বড় সুদিন। আবাহনী ক্লাবের প্র্যাকটিস দেখাটা বড় এক ব্যাপার। অনেক মানুষ জমত। শেখ আসলাম, মোনেম মুন্না অনেক নাম মাথায়। একটা কথা বলে রাখি, ঢাকার অবস্থা এখন খুব খারাপ আর তখন ভালো ছিল—এ রকম আমার একেবারেই মনে হয় না।
যা হোক, এরপর আমি প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হই। এক বছর গচ্চা দিয়ে ১৯৮৯-৯০ শিক্ষাবর্ষে আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার শুরু হলো আবারও আমার ঢাকাজীবন। আমরা এসেই দেখেছি বিক্ষুব্ধ ক্যাম্পাস। দ্বিতীয় সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন। ১৯৯০ যত গড়িয়েছে ক্যাম্পাস তত উত্তাল হয়েছে। এরশাদের একেবারের শেষের দিকে, একদিন লেকচার থিয়েটারে আমাদের ক্লাস নিচ্ছেলেন সরদার ফজলুল করিম স্যার। তিনি আমাদের পড়াচ্ছিলেন প্লেটোর ন্যায়তত্ত্ব। এমন সময় উত্তরপাড়ার হলগুলো দখল করে রাখা এরশাদের গুণ্ডাদের হটানোর অভিযান শুরু করে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। অস্ত্রের ব্যবহার দুই পক্ষেই হয়েছিল। কিন্তু আমার মনে আছে শত শত সাধারণ ছাত্র সেদিন স্রেফ একটা লাঠি হাতে নিয়ে ক্রল করে করে মলচত্বর হয়ে সূর্য সেন হলের দিকে এগিয়েছিল এরশাদের গুণ্ডাদের তাড়াবে বলে। ছাত্রনেতারাই তখন আমাদের হিরো। তাঁদের অনেকের ভাষণ শোনার জন্য আমরা কী রকম উদগ্রীব হয়ে থাকতাম! ১৯৯০ সালের পরে তাঁদের অনেকেই আর ঠিক জায়গায় থাকতে পারেননি। কেউ কেউ আবার জীবন-জীবিকার জন্য অতিসাধারণের বৈশিষ্ট্যপ্রাপ্ত হয়েছেন। খারাপই লাগে। শুধু ছাত্রসংগঠনগুলো নয়, আমার এ সময়ের স্মৃতিতে সমান গুরুত্বের সঙ্গে আছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
১৯৯০ সালের পর থেকে আমার কাছে ঢাকার লক্ষণীয় পরিবর্তনগুলোর অন্যতম হচ্ছে মধ্যবিত্ত শব্দটার মানে আমূল পাল্টে যাওয়া। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও যাবতীয় টানাপড়েনসহ যে মধ্যবিত্ত এরা এখন নিতান্ত অনুজ্জ্বল। ফাস্ট ফুড, শপিং, অযথা ইংরেজি কপচানো নতুন এক মধ্যবিত্তের মহাবিরক্তিকর উপস্থিতি দেখি এখানে-সেখানে। এরা মানিব্যাগসর্বস্ব মধ্যবিত্ত। এদের চিত্তবিনোদনের মূল জায়গা শপিং কমপ্লেক্সগুলো। এদের মনোরঞ্জনের জন্য নানা আয়োজন দেখি চারপাশে। খুব বাজে লাগে। ঢাকা কি তবে কোনো দিন আর মধ্যবিত্তবান্ধব হবে না? দরিদ্রবান্ধব হবে না? এখন নগরের যে বিস্তার ঘটেছে তা পুরোপুরি উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও ধনীদের জন্য। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের কোনো প্রবেশাধিকার সেখানে নেই। তাহলে কী হবে? দেশের রাজধানী, দেশের প্রধান শহর এমন হবে কেন? তথ্য-উপাত্ত বা খুব একটা যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারব না। তবে ইদানীং আমার মনে হয়, ঢাকা মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আগেই আমরা কি নতুন একটা রাজধানীর কথা ভাবতে পারি? ঢাকাকে পরিত্যাগ করার জন্য নয়; বরং ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমানো দরকার।
এতক্ষণের কথাবার্তা শুনে মনে হতে পারে ঢাকা নিয়ে বুঝি আমার সুখের কোনো বার্তা নেই। কথাটা ঠিক না। এই শতকের প্রথম কয়েক বছর পর্যন্তও আমরা বন্ধুরা মনের সুখে ঢাকায় থাকাটা উদ্যাপন করেছি। দিনের ঢাকা তো বটেই। রাতের ঢাকা; ভোরের ঢাকা সব উপভোগ করেছি। এক-দুই-তিন দিন নয়। বছরের পর বছর ধরে। শামসুর রাহমানের মাতোয়ালা রাইত আমরা আমাদের মতো করে বুঝতাম। একটা সময় ছিল যখন আমরা এ শহরে দিনরাতের ভেদ খুব একটা করতাম না। ছিনতাইকারী অমুক-তমুক সবই ছিল। ওনাদের সঙ্গে যে দু-একবার দেখা হয়নি তা-ও নয়। কিন্তু কী আছে। রাতবিরাতে কয়েকখানা খোলা রিকশায় বন্ধুরা সব। নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে বুড়িগঙ্গা নদী কোথায় নয়? একজন শুধু বললে হয়, ‘চল বেরোই। ’

শান্তনু মজুমদার, শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

শ্রুতলিখন : কবীর আলমগীর






Find Nobin Kontho on Facebook