শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৭

ফার্স্ট বয়দের দেশ! | কাজী কাউছার হামিদ

ছোটবেলায় পড়ালেখার প্রতি উত্সাহ দেওয়ার জন্য মা প্রায়ই বলতেন, ‘পড়াশুনা করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’। আরো একটু বড় হয়ে বাংলা বইয়ে পড়তাম ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত।’ আজ স্নাতক শেষের দিকে বইয়ের পড়া সেই কথাগুলোর সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাই না। কারণ, জীবন চলার পথে গিয়ে এখন দেখি একসময়ে ক্যাম্পাসে
পড়াশুনায় দাপিয়ে বেড়ানো সেই বড় ভাই আজ বেকার কিংবা টিউশন-কোচিং করে কোনোভাবে জীবন যাপন করছে। নতুবা নিজের ভালো লাগার বিষয়কে বিসর্জন দিয়ে কম বেতনের ভিন্ন কোনো পেশায় নিজেকে বেঁধে রেখেছে, প্রতিনিয়ত খুঁজছে বাঁচার ভালো কোনো অবলম্বন। একসময়ের বিভাগের সেরা ছাত্রীটি পড়াশুনার সাথে চাকরির বাজারে নিজেকে মিলাতে না পেরে আজ সে আদর্শ গৃহিণীর ভূমিকা পালন করছে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে যদি একজন অর্থনীতিবিদকে প্রশ্ন করা হয় যে, ‘একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ কী?’  তাহলে হয়তবা উত্তর আসবে কর্মমুখী শিক্ষিত জনশক্তি। সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা প্রায় ৫৬ লক্ষ। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কি.মি. প্রায় আট হাজার। মাথাপিছু আয় ৫৫ হাজার ২৫২ মা.ড.। আর বাংলাদেশের কর্মমুখী জনশক্তির সংখ্যা ৬৬ শতাংশ। পৃথিবীর সর্বাধিক উর্বর ভূমির এই দেশ, বিশাল সমুদ্র সম্পদ আর শিক্ষিত জনশক্তি নিয়েও বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে সকল দিক থেকে। বাংলাদেশের ক্রিকেট, তৈরি পোশাক কিংবা শান্তি রক্ষী সেনা বাহিনী ব্যতীত বাঙালি জাতির গর্বকরার মত কোনো কিছুই নেই। আর এর সমস্যার মূলে যেতে হলে প্রথমে আসবে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা।
আমার এক ছাত্রী কুমিল্লার একটি ইংরেজি মাধ্যমের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তার পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা ৯টি। আর বছরে ৩টি সাময়িক পরীক্ষা হয়ে থাকে। প্রতিদিন ক্লাসের হোমওয়ার্ক, সিডাব্লিউ, আর ডাব্লিই কিংবা কুইজ টেস্টসহ নানান পরীক্ষা। ক্লাসের পরে সে কোচিং করে বাসায় ফিরে আবার তার জন্য দু’জন টিচার । ছাত্রীর মায়ের খুব আফসোস ৯০০ নাম্বারের পরীক্ষায় তার মেয়ে মাত্র ৮৮৯ পেয়েছে, সে এখন তার প্রতিবেশীকে মুখ দেখাবে কী করে? দেশের এই চিত্র এখন প্রতিটি ঘরে ঘরে। আবার এই শিক্ষার্থীরা যখন ৫ম কিংবা ৮ম শেণিতে উঠে তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেকে সেরা প্রমাণ করার জন্য কিংবা অভিভাবকরা নিজের ছেলে-মেয়েকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য লিপ্ত হয় অসম প্রতিযোগিতায়। শিক্ষার্থী কী শিখল সেটা বিষয় নয় বরং সে এপ্লাস পেল কিনা সেটাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষাপদ্ধতিতে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা এক নাম্বারে। সেখানে একজন প্রাথমিক শিক্ষার্থীর কোনো হোমওয়ার্ক নেই। খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, ভাষা শিক্ষা, ঘুরতে যাওয়া, ট্রাফিক সিগন্যাল জানা, আদবকায়দা শিক্ষা দেওয়া হয়। আরেক এশিয়ার দেশ জাপানের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথমেই শিখান হয় হ্যালো, ধন্যবাদ ও দুঃখিত শব্দের ব্যবহার । শিক্ষা দেওয়া হয় টয়লেট পরিষ্কার, ভাষা শিক্ষা, নিজের বিছানা ও বই-পত্র গোছান, ট্রাফিক আইন মানা, শিক্ষা দেওয়া হয় বিনা টিকিটে ভ্রমণ না করার; যার ফলে একজন শিক্ষার্থী হয়ে উঠছে একজন আদর্শবান ছাত্র ও স্বনির্ভর যা আমাদের দেশে দেখাই যায় না।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও আবারো সে গতানুগতিক চিত্র। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য আবার শুরু হয় প্রতিযোগিতা। ১২ থেকে ১৬টি বই, ক্লাস, কোচিং প্রাইভেটের পিছনে দৌড়াতে গিয়েই চারটি বছর চলে যায়। অথচ চীনে এই সময়ে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কর্মমুখী শিক্ষা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে স্বনির্ভর করার জন্য। ভারতে এই সময়ে শিক্ষার্থীদের বইয়ের সংখ্যা থাকে মাত্র ৭টি। উচ্চস্তরে আরো খারাপ অবস্থা। প্রথমেই একজন শিক্ষার্থীকে ১০০ নাম্বারের এমসিকিউর মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী প্রথম হোঁচট খায় তার পছন্দের বিষয় পড়া নিয়েই। এরপর শুরু হয় থিওরিটিক্যালি পড়াশুনা, যে যত বেশি মুখস্থ করতে পারে সে তত মেধাবী ছাত্র। তাকে দেওয়া হয় গোল্ড মেডেল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয় আর্থিক অনুদান। আর যে ছেলেটি মুখস্থনির্ভর পড়াশুনায় ভালো করতে পারে না, সে হয় খারাপ শিক্ষার্থী। থিওরিটিক্যাল শিক্ষার কারণে কিংবা চাকরি বাজারের অপরিকল্পিত ব্যবস্থার কারণে মেডিক্যাল কিংবা বুয়েটে পড়া শিক্ষার্থী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পরিবর্তে সে প্রথম বর্ষ থেকেই দৌড়ায় সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে। আরেকটি বড় ভুল হলো  অমেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। টিআইবির মতে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় রাজনীতিক বিবেচনায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে টাকার পরিমাণ ১০-১৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। আবার শিক্ষকদের আপগ্রেডেশন হয় অনেকটা রাজনৈতিক বিবেচনায়। যার ফলে শিক্ষকরা পড়ানোর পরিবর্তে মিছিল, মিটিং কিংবা মানববন্ধন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। যার ফলে ঘটছে শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, হাতাহাতি কিংবা মারামারির ঘটনা।
অন্যদিকে ফিনল্যান্ডে বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের চাকরি থাকে সাময়িক। এখানে চাকরি নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের মতামতের উপর। প্রতি কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া হয়। এখানে শুধু পিএইচডিধারীদেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যা ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দিয়েছে প্রথম হওয়ার স্বীকৃতি। আর এসব কারণে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না পৃথিবীর সেরা হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে।
n লেখক :শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়





Find Nobin Kontho on Facebook