সোমবার, ২৭ জুন, ২০১৬

রাজনীতির রোমান্টিক পর্বের অবসান | ফরহাদ মজহার

বাংলাদেশের রাজনীতি ‘অস্থিতিশীল’ হয়ে উঠছে, এটা নতুন কোনো কথা কিংবা নতুন কোনো খবর নয়। রাজনৈতিক ‘অস্থিতিশীলতা’র মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আমাদের একটি স্থি্িতশীল সমাজ ও স্থিতিশীল রাজনীতি উপহার দেবে এমনটাই কথা ছিল। সেটা ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধকে প্রকট আবেগ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের বয়ানে পরিণত করার মধ্য দিয়ে বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতি আমরা নিজেরাই জন্ম দিয়েছি। এখন তা দানবের মতো আমাদের গ্রাস করতে উদ্যত।

স্বাধীনতা অর্জনের রাজনীতি ও যুদ্ধ আর নিজেদের একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে পরিগঠিত করার লড়াই সম্পূর্ণ দুই প্রকার ও সম্পূর্ণ দুই ভিন্ন প্রকৃতির লড়াই। একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা স্থান করে নিতে সক্ষম কিনা সেটা বোঝা যায় রাষ্ট্র গঠনসংক্রান্ত চিন্তাভাবনায়। ক্ষমতা, রাষ্ট্র, রাজনীতি, শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার সংকট প্রকট। সেই উপলব্ধিটুকু আমাদের পুরোপুরি হয়েছে বলে মনে হয় না। অস্থিতিশীলতার কারণ এখানেও নিহিত। বাংলাদেশ কেন অস্থিতিশীল সেই প্রশ্ন অনুসরণ করলে আমরা এখনকার ‘অস্থিতিশীলতা’র সঙ্গে আগের পর্যায়গুলোর মিল ও অমিল বুঝতে পারব। এখন তার পর্যালোচনা খুবই দরকার। একাত্তরের মতো কোনো প্রকার সহিংস ও রক্তাক্ত পরিস্থিতি আসন্ন কিনা সেটা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে উঠেছে।

অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কেন সমাজ ও রাজনীতিতে তৈরি হয় সেটা রাজনৈতিক দলের দৃশ্যমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত দিয়ে বোঝা যাবে না। বাস্তব পরিস্থিতিকে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সমাজের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক স্তর ও মতাদর্শিক লড়াই, ইতিহাস ইত্যাদি নানা ক্ষেত্র থেকে নানাভাবে বোঝার দরকার আছে। একেকটি কালপর্বে সমাজের সামগ্রিক পরিস্থিতির মূল সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় সম্পর্কে একটি সাধারণ মতামত গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সীমা ও সম্ভাবনা সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মত দ্বারা কম-বেশি ঠিক হয়। দুই-একটি উদাহরণ দেয়া যাক।

কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার মানুষ দীর্ঘ সময় ঔপনিবেশিক ইংরেজ ও হিন্দু-জমিদার মহাজনের বিরুদ্ধে লড়েছে। তার হাত থেকে মুক্তি চেয়েছে। ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার অর্থ বুঝেছে, একই সঙ্গে হিন্দু জমিদার মহাজনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া। তার সমাধানও তারা সেভাবেই ভেবেছে ও সেভাবেই করেছে। সমাধান মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। যে সাধারণ মত পাকিস্তান পর্বে গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যেই তার সীমা ও সম্ভাবনা নিহিত ছিল।

জমিদার-মহাজনের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে পূর্ব বাংলার জনগণের আলাদা রাষ্ট্র দরকার- বলা বাহুল্য, বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সেটা ভালো লাগেনি। তারা প্রথমবার বাংলা ভাগ হওয়ার বিরোধিতা করেছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন আবার ভাগের কথা উঠল তখন তা সমর্থন করেছে। অবিভক্ত বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে হতো। সমাধান হিসেবে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছি। এখানে রাগ অভিমান রাগারাগির কিছু নাই। সত্য হল, হিন্দু-মুসলমান নিজেদের একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত ভাবতে পারেনি।

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এলো রাজনীতির রোমান্টিক যুগ। পূর্ব পাকিস্তানে নতুন যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধর্ম পরিচয়ের বিপরীতে নিজেদের ‘বাঙালি’ ভাবতে শুরু করল, তাদের জগৎ থেকে তারা ইসলামকে খারিজ করে দিতে চাইল। এটা কোনো বদ মতলবে বা হিন্দুদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তারা করেনি। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালিত্বের যে ধারণার সঙ্গে তারা ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত সেটা উচ্চ বর্ণের হিন্দুর জগৎ। সেটাই বাঙালির পরিচয়। সেখানে বেদ, উপনিষদ, পূজা, অর্চনা সবই আছে; কিন্তু কোরআন-হাদিস, ইবাদত, বন্দেগি- এসব নাই। যারা সেই কথা তুলল, তাদের সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা করা হল।

রাজনীতির রোমান্টিক পর্বে বাঙালির মুক্তির চিন্তার অর্থ দাঁড়াল পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশ স্বাধীন করা এবং ইসলামের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিচ্ছেদ চিরস্থায়ী করা। এটা ছিল অবাস্তব চিন্তা আর এই অর্থেই রাজনীতির এই কালটাকে রোমান্টিক বলছি। ধর্ম ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রই এই পর্বে দুষমন হয়ে দাঁড়াল। সদর্থে ভাবলেও এই রোমান্টিকতাকে সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষ ভাবার কোনো কারণ নাই। বাংলা সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় নির্মাণের পরিসর থেকে ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসকে খারিজ করে দেয়া ছিল চরম সাম্প্রদায়িক একটি পর্ব। কিন্তু প্রবল রোমান্টিকতা এই বিশ্বাস জনপ্রিয় করে তুলেছিল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারলে দুধে-ভাতে বাঙালির জীবনে সুখের ফোয়ারা উথলে উঠবে। এই রাজনৈতিক রোমান্টিকতা ঊনসত্তরের পর থেকে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ অবধি প্রবলভাবেই জারি ছিল।

সত্তরের দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক মনোগঠনে ঠিক কী প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে কোনো সিরিয়াস আলোচনা চোখে পড়েনি। তবে অনুমান হলেও নিশ্চিত বলা যায়, ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ অথবা ‘সোনার বাংলা’ ধরনের রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার ক্ষয় শুরুর কাল সেটি। এই সেই সময় যখন পেটিবুর্জোয়া তরুণরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে শুরু করেছে, যুদ্ধ করা যত সহজ, রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা তত সহজ নয়। বিশেষত যুদ্ধোত্তর দেশের অবকাঠামো পুনর্গঠন, প্রশাসনে শৃংখলা আনা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা খুবই বিশাল একটি কাজ।

পঁচাত্তরের পরের পর্বকে আমি বলি সাংবিধানিক পর্ব। রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে দলীয় মতাদর্শ জনগণের ওপর চাপিয়ে না দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে ধীরে ধীরে জনগণের সচেতন হওয়ার কাল। এই পর্বটি দীর্ঘ, কণ্টকময় ও কঠিন। কিন্তু এটা স্বীকার করতে হবে যে, আশির দশকের আগে সাংবিধানিক তর্ক খুব কমই হয়েছে, কিংবা হলেও তা জনগণকে খুব কমই আকৃষ্ট করেছে। বাংলাদেশে সাংবিধানিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা ও তর্ক আগের চেয়ে বেড়েছে, এটা সবাই স্বীকার করবেন। মানের দিক থেকে এসব বিতর্ক মাঝে-মধ্যে নিু হলেও রাষ্ট্র গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই উপলব্ধি আগের চেয়ে বেড়েছে। শুধু আবেগে চিড়া ভিজবে না, এই বোধটুকু পোক্ত হচ্ছে।

কিন্তু এই রাষ্ট্র গঠনের তর্ক এখনও আইনি তর্কে সীমিত। রাজনীতি ও রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে কন্সটিউটিশনের সম্পর্ক এখনও বাংলাদেশে অস্পষ্ট। যদিও বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের স্তর চেনার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিতর্ক সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য ও ছহি জায়গা। এখানেই সমাজের চিন্তা দুধ থেকে মাখন তোলার মতো ভেসে ওঠে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান করতে চাইলে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আদৃত ও বাস্তবসম্মত বলে বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশে গুম, খুন, হত্যা, হত্যাকারীদের পার পেয়ে যাওয়া, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের ভূমিকা, অকথ্য দমন-পীড়নের রাজনীতি ও প্রতিশোধপরায়ণতা আমাদের যতই হতাশ করুক, আসলে হতাশ হওয়ার কিছু নাই। বাংলাদেশ পিছিয়েছে বলা যাবে না, এগিয়েছে।

দুই

কোন যুক্তিতে বাংলাদেশ এগিয়েছে সে সম্পর্কে আরও দুই-একটি কথা বলে আমি আজকের লেখাটি শেষ করব।

বাংলাদেশে কাল্পনিক রাজনৈতিক রোমান্টিকতার পর্ব মোটামুটি শেষ হতে যাচ্ছে। সামনে অনেক বড় লড়াই আসন্ন। ডান কিংবা বাম কোনো রাজনীতিতেই রঙিন ফানুস দেখিয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের গল্প বানিয়ে যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র খাড়া করা হয়েছে, তার খিলান এখন অত মজবুত নয়। ক্ষমতার পক্ষে সমর্থন আদায় করতে কীভাবে কোটি কোটি টাকা চুরি ও পাচার হচ্ছে তা দেখেও এটা বোঝা যায়। অবশ্য যদি বুঝি যে কোনো আদর্শগত কারণে ক্ষমতাসীনরা টিকে নাই। তাদের দুটি মাত্র হাতিয়ার। এক. জনগণকে ক্রমাগত এবং ত্রাস কায়েমের মধ্য দিয়ে শাসন। দুই. ক্ষমতার সঙ্গীদের অবাধ লুটপাট করতে দেয়া। স্রেফ লুটপাটের সুবিধা দিয়ে ক্ষমতার ভিত্তি টিকিয়ে রাখা। এটা বালুর বাঁধের মতো। ভাঙবে।

দ্বিতীয় অগ্রগতি আমি দেখছি ক্ষমতাসীনদের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে। ক্ষমতাসীনরা যদি আসলেই সন্ত্রাস দমন করতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে ক্রমাগত আইএসের নামে বা বেনামে হত্যাকাণ্ড সরকার বন্ধ করতে পারছে না কেন? শুধু তাই নয়, আইএস ও আল কায়দার উপস্থিতি সরকার ক্রমাগত অস্বীকার করার কারণে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমেছে।

নরেন্দ্র মোদি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি নাক গলাচ্ছেন। সুষমা স্বরাজ শেখ হাসিনার সরকারের কর্মকাণ্ডে আস্থার কথা বললেও প্রকাশ্যে আস্থার কথা বলাটাই মূলত আস্থাহীনতার লক্ষণ।

সত্য যে অনেকেই বলছেন, একটা ঝড় আসছে। কিন্তু তাকে হতাশার রঙ দিয়ে বিষণ্ণ করে দেয়ার কোনো কারণ নাই। কারণ অতীতের চেয়ে আরও অনেক স্পষ্টভাবে আমরা আমাদের কর্তব্যগুলো জানি ও বুঝি। পুরনো প্রাসাদ ভেঙে পড়বে। পুরনো কড়ি-বর্গা-ইট-পাথর কোনো কাজে আসবে না।

আমাদের নতুন করে গড়তে হবে।

ফরহাদ মজহার

২৪ জুন ২০১৬/ ১০ আষাঢ় ১৪২৩, শ্যামলী