গত বিশ ত্রিশ বছরে পশ্চিমা বিশ্বে সম্ভবত শেক্সপিয়রের পর রুমি তুমুল জনপ্রিয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রুমির প্রতি আগ্রহের যেন শেষ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ গবেষকই মনে করেন, সর্বকালের অন্যতম সেরা মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমি।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার যে, তের শতকের পারস্যের ক্ষণজন্মা এই কবিকে ঘিরে রহস্যও কম নয়। শামস তাবরেজির সাথে রুমির সম্পর্ক নিয়ে আছে বেশ ঘোরালো কাহিনি।
রুমির জন্ম হয়েছিল সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী পরিবারে। সেসময়কার পূর্বাঞ্চলীয় পারস্য সাম্রাজ্য খোরাসানের রাজপরিবারের সাথে রুমির মায়ের আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় তাদের সাথে ছিল গভীর সম্পর্ক। তাঁর বাবা ছিলেন বিচারবিভাগীয় উপদেষ্টা।
শৈশব থেকেই সামাজিক সম্পর্ক, বন্ধুত্বের জন্য রুমির ছিল বেশ সুনাম। খুব সহজেই মিশতেন। অপরদিকে তাঁর ছিল উন্নত ব্যক্তিত্ব। একবার কোনিয়ের এক স্বর্ণকারের সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু সমাজে তিনি অভিজাত শ্রেণির লোক ছিলেন বলে স্বর্ণকারের সাথে খুব বেশি মিশতে পারতেন না। তাই শ্রেণিগত দূরত্ব ও বৈষম্য নিরসনে একপর্যায়ে তিনি তাঁর ছেলেকে স্বর্ণকারের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে তাঁদের সম্পর্ককে সামাজিকভাবে স্বাভাবিক করেন।
রুমির সাথে যখন শামসেত তাবরিজির পরিচয় হয় তখন তাবরিজির বয়স ষাটের কোঠায়। তাবরিজি একধরনের সমাজবিরোধী এবং জেদি মানুষ ছিলেন। তবে বিস্ময়করভাবে তাবরিজি ছিলেন খুবই শক্তিশালী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ।
তাঁকে লোকে ‘পাখি’ বলে ডাকতেন। তাঁকে নিয়ে মানুষের ছিল বিপুল কৌতূহল। রহস্যঘেরা ছিল তাবরিজির জীবন। এর বড় কারণ, তিনি এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না। খুব দ্রুত জায়গা বদল করে অন্যত্র চলে যেতেন। তবে তাবরিজি সবসময় একজন প্রভাবশালী সাগরেদ খুঁজতেন। ভাবতেন তাঁর একজন যোগ্য উত্তরসূরি প্রয়োজন। শেষপর্যন্ত রুমির মধ্যেই সেই গুণ খুঁজে পেলেন তাবরিজি।
যখন রুমির একুশ বছর, তাবরিজি তখন তাঁর শিষ্য হওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে জানান। পরে ভেবে দেখলেন, বয়সটা মোটেও তাঁর সাগরেদ হওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। তিনি আরো ষোল বছর অপেক্ষা করলেন।
তাবরিজির সাথে যে নিবিড় এবং গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা-ই রুমিকে তাঁর পূর্ণ শিষ্য হওয়ার ব্যাপারে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। একসময় রুমি তাঁর জন্মভূমিতে গুরুকে নিয়ে আসেন। এরপর এক নতুন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁদের।
তাবরিজি ভূমিহীন দরিদ্র ছিলেন। তার ওপর ছিলেন মারাত্মকভাবে সমাজবিরোধী। এতটাই বদমেজাজি ছিলেন যে, শিশুদের কাছে তাবরিজি রীতিমতো আতঙ্ক ছিল। এতকিছুর পরও বেশ স্ববিরোধীভাবে গড়ে ওঠা তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তিমত্তা ছিল অসাধারণ। কিন্তু তাঁর কাছে রুমি কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল এটি এক বড় প্রশ্ন। প্রথমত, রুমির ব্যক্তিত্ব ছিল সাংঘাতিকরকম আকর্ষণীয়। ধীরে ধীরে তাবরিজির কাছে রুমির ব্যক্তিত্ব একটি বড়সড় ইস্যু হয়ে ওঠে। অপরদিকে তাবরিজির গতিবিধি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, শ্রেণিগত অবস্থান, ধর্মকর্ম কোনোকিছুই চলমান সমাজের জন্য অনুকূল ছিল না। এমনকি একপর্যায়ে তাবরিজিকে তাঁর ধর্মকর্মের জন্য হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। তাবরিজিকে বলে দেওয়া হয়, এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে, না হয় হত্যা করা হবে। সবমিলিয়ে তাবরিজিকে নিজের এলাকায় এনে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখোমুখি হন রুমি। তবে গভীর সংকটে পড়ে তাবরিজিকে কোনিয়ায় ফিরে যেতে হয়।
সমাজের প্রথাগত সংস্কৃতির ভয়ে দমে যাননি রুমি। কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিতে হয় তাঁকে। তাই সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে স্বর্ণকারের সাথে যে কৌশল নিয়েছিলেন, একই পন্থা অনুসরণ করলেন রুমি তাবরিজির ব্যাপারেও। সামাজিক সীমাবদ্ধতার তুলনায় রুমি তাঁর শক্তির ব্যাপারে পুরোপুরি সচতেন ছিলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, তাবরিজিকে তাঁর পরিবারে তাঁর সমাজে যে করেই হোক স্থান দেবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী রুমি তাঁর খুবই কাছের সেময়ে কিমিয়াকে শামস তাবরিজির সাথে বিয়ে দেন।
কিমিয়ার তখন পনেরো বছর বয়স। কথিত আছে, কিমিয়ার সাথে বিয়ে হওয়ার পর জীবনে প্রথম তাবরিজি কারো প্রেমে পড়েন। তাবরিজি আরো বেশি বিস্মিত মুগ্ধ হয়ে পড়ে রুমির প্রতি। শিষ্য বানাতে গিয়ে পরিস্থিতিতে পড়ে শিষ্যের কন্যাকে বিয়ের ঘটনা তাঁর জীবনে এক স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে যায়।
বিয়ের মাত্র কয়েক মাস পর কিমিয়া হঠাত্ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রী বিয়োগের বিষয়টি গভীর আঘাত হানে তাবরিজির জীবনে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে রুমি-তাবরিজির সম্পর্কের প্রায় সমাপ্তি ঘটে।
কথিত আছে, কিমিয়ার চলে যাওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাবরিজি অদৃশ্য হয়ে যান। যেন বনের পাখি বনেই ফিরে গেল। কিন্তু তাবরিজি আদৌ রহস্যময় হয়ে গেলেন, হারিয়ে গেলেন নাকি কোনো পক্ষ তাঁকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে দুনিয়া থেকে চিরতরে অদৃশ্য করে ফেলে—এমন গুঞ্জন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তখন। পরবর্তীকালে এ নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়।
তাবরিজির এভাবে হঠাত্ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে বহু গল্প থাকলেও, অনেকে এর বাস্তব কারণ তলিয়ে দেখাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কেউ কেউ মনে করেন, কিমিয়ার মৃত্যুর পর তাবরিজিকে যারা ধর্মদ্রোহী বলে খুন করার হুমকি দিয়েছিল তারাই তাঁকে গুম করে খুন করে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, তাঁর হত্যার ঘটনায় রুমির কনিষ্ঠ পুত্রের হাত রয়েছে। কারণ সেবান কিমিয়ার প্রতি তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু তাকে তাবরিজির সাথে বিয়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় কনিষ্ঠ পুত্র। কিমিয়ার মৃত্যুর বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে পূর্বের প্রতিশোধ নিতে তাবরিজিকে গোপনে হত্যা করে তার এই সত্ভাই।
কিন্তু এতসবের জন্য কি তাহলে রুমিই দায়ী? অনেকে মনে করেন, তাবরিজির মতো এমন বয়ষ্ক একটা লোকের সাথে তাঁর কিশোরী মেয়ে কিমিয়াকে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে জোর করা উচিত হয়নি। যেকারণে মেয়েও গেল, তাবরিজিও গেল।
কিন্তু তাবরিজিকে হত্যা কিংবা তাঁর অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা এতটা ঐতিহাসিক হয়ে উঠল কেন? অনেকেই মনে করেন, রুমির ঐতিহাসিক হয়ে ওঠার মূল কারিগর তাবরিজি। তাবরিজির অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পুরো ঘটনা রুমির ঐতিহাসিকতাকে আরো প্রকট আকারে হাজির করে। তাবরিজির পক্ষিময়তা, রসহ্যময়তা, আধ্যাত্মিক চৈতন্য, সমাজের প্রথাগত আচারবিরোধিতা, রসিকতা ও একইসাথে তীব্র পৌরুষ রুমির জ্ঞান, মনন ও প্রজ্ঞায় নিবিড় প্রভাব ফেলে। তাবরিজির স্বপ্ন ও তপস্যা ছিল একজন ‘মাস্টার শিষ্য’। আর সেই সাধনার ফসলই হলো রুমি। রুমির আত্মার মধ্য দিয়ে তাই তাবরিজির রুহের নিরাকরণ ঘটে। দুই আত্মার রসায়নের মাধ্যমে গুরু-শিষ্য চির ঐতিহাসিক হয়ে ওঠে।
শাহাদাত্ তৈয়ব
শাহাদাত্ তৈয়ব